শীতকাতুরের ডায়েরি
বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণের মধ্যে গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরতের পাশাপাশি শীত ও সমানভাবে উপস্থিত | সব ঋতুতেই বাঙালি কম-বেশি নস্টালজিয়াকাতর হয়ে পড়ে, শীতের ক্ষেত্রে ও তারব্যতিক্রম ঘটে না | নলেন গুড় থেকে ফেলুদার আবির্ভাব , সার্কাস থেকে থিয়েটারের মঞ্চস্ত হওয়া দর্শকের সামনে , এছাড়াও বইকাতুরে বাঙালির প্রিয় বইমেলাও বছরের এই সময়ইঅনুষ্ঠিত হয় | কালীপুজো ও ভাইফোটার রেশ কাটতে না কাটতেই শীতের অপেক্ষায় মুখিয়ে থাকে আপামোর বাঙালি | একসঙ্গে এত সব পার্বণ , এত মজা , এত আনন্দ পৃথিবীর আরকোথাও দেখা যায় বলে মনে হয় না আমার | শীতবস্ত্র পরিহিত উষ্ণতার উপস্থিতিতে একরকমের আবেগপূর্ণ গ্রহণযোগ্য উদারতাকে সঙ্গী করে মানুষ বেরিয়ে পরে এই কিছুদিনের জন্যযেখানে শুধুই আনন্দ ডানা মেলে , শুধুই উত্সবের রঙে মানুষ নিজেদের রাঙিয়ে তোলে |
যৌবনের প্রথম প্রেমের সুচনা বা শেষ প্রেমের হারিয়ে যাওয়াও এ সময় ঘটে প্রবলভাবে | লেকের ধার থেকে — নন্দন চত্বর সব জায়গায় এক সদ্য ঘটিত প্রেমের আবেগমিশ্রিত উষ্ণতারছোয়া দেখা যায় | দুর্গাপুজোর অষ্টমীর অঞ্জলি থেকে শুরুটা ভালো হয়…. বড়দিনে , নতুন বছরের শুরুতে সেটা পাকাপোক্ত একটা জায়গা লাভ করে , তারপর বইমেলা ও সরস্বতী পুজোয়অনুভূতি এক্সচেঞ্জ হতে না হতেই তীরে এসে তরী ডুবে যায় | শুরুটা ভালো হলেও শেষটা ঘেঁটে যায়….. তারপর তো চন্দ্রবিন্দু বা কবীর সুমন আছেনই এই ডিপ্রেশন থেকে উদ্ধার করারজন্য | প্রথমে ফুচকা , কাটলেট ভাগ করে ভালবাসা বিনিময় , ঠিক তার কিছুদিন পরেই একে অপরের প্রতি কটুক্তি ও অভিযোগের ঝুলি বিনিময় , এই অভিযোগের ঝুলি যেন বাবা মায়েরঅভিযোগের ঝুলির থেকেও বৃহৎ | এইসব অভিজ্ঞতা আমার নিজেরও হয়েছে তাই আর কি এত ভালো করে বলা…. এখনও অবধি দু ‘বার সম্পর্কের জাহাজে পাড়ি দেওয়ার চেষ্টাকরেছিলাম তবে মাঝসমুদ্রে গিয়ে জাহাজ ডুবলো দু ‘বারই ; লেঙ্গি খাওয়ার ব্যাপারটা কিন্তু চিরকালের আমার , আজ থাক সে বিষয়ে না হয় পরে কোনদিন বলব |
দক্ষিন কলকাতায় বড় হওয়া সত্বেও দক্ষিন কলকাতার বিলাসিতা , প্রাসাদসম অট্টালিকা , আধুনিক সব শপিং মল – রেঁস্তরা আমার বাঙালিয়ানার শিকড়কে কখনই গ্রাস করতে পারেনি |ছোট থেকেই নাটক , সিনেমার প্রতি আলাদা একটা সখ্যতা জন্মেছিল | তখন ক্লাস এইট বা নাইনে পড়ি , মামার হাত ধরে বড়দিনের ছুটিতেই প্রথম নাটক দেখতে যাওয়া তপন থিয়েটারে |তারপর বেরিয়ে আপনজনের কবিরাজি , কাটলেট দিয়ে সান্ধ্যভোজন সারা… এছাড়া প্রথম উত্তর কলকাতা ভ্রমন , প্রথম সাবেকিয়ানাকে এত কাছ থেকে দেখে আপন করে নেওয়া | প্রথম হলে গিয়ে ফেলুদার সিনেমা দেখাও নতুন বছরের শুরুতেই , তারপর যদিও সেটা একটা নেশায় পরিণত হয়ে যায়… মানে শীতকাল মানেই ফেলুদা মাস্ট ; এছাড়া স্কুলের বার্ষিকঅনুষ্ঠান , বইমেলা এগুলো তো আছেই | তাই এখনও শীতকাল আসলেই ছোটবেলার সেই স্মৃতিগুলোর কথা প্রচন্ডভাবে মনে পড়ে | কথাও যেন একটা প্রবল নস্টালজিয়া কাজ করে ,সম্মুখীন হই বারেবারে সেই ফেলে আসা দিনগুলির | তাই স্বভাবতই , চিরকাল আমার কাছে শীতকাল ও নস্টালজিয়া একে অপরের সঙ্গী হয়েই বেঁচে থাকবে |