LaughaLaughi

You Create, We Nurture

I got a story to tell

বড়দিন

বছরের এই সময়টা খুব স্পেশাল. পুরোনো বছরের শেষ আর নতুন বছরের শুরুর মধ্যেকার এই যে একটা সপ্তাহ, ঠিক যেন যা কিছু খারাপ, যা কিছু দুঃখ, হতাশা, ব্যর্থতাকে ঝেড়ে ফেলে এক নতুন আশার আলো, উদ্দীপনা, উৎসাহ নিয়ে সাফল্যকে স্বাগত জানানোর সন্ধিক্ষণ। ছোটবেলায় অবশ্য এতশত বুঝতাম না। তখন বছরের এই শেষ সপ্তাহটা মানে শুধুই বড়দিন, মেলা, পিকনিক আর নতুন বছর আসছে যেখানে বারবার খাতায় সাল লিখতে গিয়ে ভুল করে পুরোনো সাল লিখে ফেলা হয়। আমি মফঃস্বলের মেয়ে, এখানে চাকচিক্য বড় শহরের তুলনায় অনেকটাই কম বরাবর, তবে হুজুগ বা আন্তরিকতা কম নয় মোটেই। আমি আবার ‘মেয়েবেলার’ সুদীর্ঘ তেরোটা বছর (প্রি-প্রাইমারি থেকে ক্লাস ১২) মিশনারি স্কুলে পড়ার দরুন এই সময়টা আমার কাছে একটু অন্যরকম, একটু বেশি স্পেশাল।

আজ থেকে বেশ কয়েক বছর পিছিয়ে গেলে জীবনটা তখন একদম অন্যরকম ছিল। খ্রিস্টান স্কুল বলে বড়দিনের সময়ে আমাদের স্কুল ছুটি পড়ে যেতো, খুলত নিউ ইয়ার কাটিয়ে। ওহ্ হ্যাঁ, বলে রাখা ভালো যে ‘খ্রীস্টমাস’ কথাটার থেকে ‘বড়দিন’ শব্দটার সাথেই বেশি টান অনুভব করতাম সেদিন, আজও তাই করি। তো যা বলছিলাম, বড়দিনের ছুটি আমাদের কাছে একটা বেশ জম্পেশ ব্যাপার ছিল সেই সময়। আর বড়দিনের এক সপ্তাহ আগে আমাদের স্কুলে একজন আসতেন গ্রিটিংস কার্ড বিক্রি করতে। আমাদের বড়দিদিমণি আগে থেকে জানিয়ে দিতেন তাঁর আসার সময়, আর ব্যস, আমাদের উত্তেজনার পারদও চড়তে শুরু করত ওমনি। তারপর নির্দিষ্ট দিনে টিফিনের সময়ে এক অফুরন্ত আনন্দের পসরা নিয়ে তিনি হাজির, সেও কি স্যান্টক্লজ এর আসার মত ছিলনা খানিকটা? পঞ্চাশ পয়সার কার্ডও পাওয়া যেত তখন, থাকতো পাঁচ, দশ টাকার কার্ডও তবে সেই সময়ে দু-তিন টাকার রংবেরঙের কার্ড ছিল অনেক বেশি মনোগ্রাহী আর যাকে বলে বাজেট ফ্রেন্ডলীও। আমি আবার নিজে হাতে কার্ড বানাতাম খুব। আর্ট পেপার, জলরঙ, অভ্র, চুমকির আমার সে এক অন্য সংসার ছিল। তারপর সেইসব কার্ড আর পোস্টকার্ডে লেখা চিঠি ডাক মারফত পৌঁছে যেত কোলকাতায় থাকা আমার পিসতুতো দাদা দিদিদের কাছে। আরও আনন্দের ছিল যখন সেইসব চিঠির প্রত্যুত্তরও এসে পৌঁছাতো ডাকপিয়নের হাত ধরে। আজকাল কেউ আর চিঠি লেখে না, কার্ড বানায় না, আজকের হোয়্যাটসঅ্যাপের জিআইএফ উইশ এর যান্ত্রিকতায় সেদিনের অপটু হাতে লেখা চিঠির উষ্ণতাটা কিন্তু পাইনা। একবার বড়দিনের সময়ে আমাদের স্কুলে শুনেছিলাম বিদেশ থেকে জাহাজে করে উপহার আসবে, সেই উপহার যদিও এসে পৌঁছায়নি কোনো কারণে কিন্তু তাতেও দুঃখ ছিলনা কারণ আমাদের কাছে এমন অনেক মুহূর্ত ছিল যা গিফট না আসার দুঃখকে কাছে ঘেঁষতেই দেয়নি। কার্ড পর্ব সাঙ্গ হলে বড়দিনের আগেই একদিন স্কুলে যীশখ্রীস্টের জন্মদিন পালন করা হতো। নিজেরা ক্লাসরুম সাজাতাম রঙিন কাগজ আর মোমবাতি দিয়ে, চাঁদা তুলে ফ্রুটকেক কিনে নিয়ে যেতাম, যেটা আমাদের ক্লাসটিচার দিদিমণি কেটে আমাদের ভাগ করে দিতেন, ক্যারল গাওয়া হতো সবাই একসাথে, বড়দিদিমণি সেদিন স্কুলের সবার জন্যে বিশেষ প্রার্থনা করতেন। পরে কলেজে অনেক খ্রীস্টমাস সেলিব্রেশনস হয়েছে, পার্টি করেছি, সেইসব অন্যরকম মজা ঠিকই কিন্তু একসাথে ক্যারল গাওয়ার রোমাঞ্চটা হয়নি।

আমাদের বাড়ির কাছেই ক্যাথলিক চার্চের মাঠে বড়ো করে মেলা হয় বরাবর। আর হতো পঁচিশে ডিসেম্বরের সন্ধ্যেয় দারুণ বাজির প্রদর্শনী, যেটা দেখার জন্যে ভিড় জমাত সারা শহর। বাইরে থেকেও আসতো প্রচুর লোক। আজ বিভিন্ন রকমের ফায়ারক্র্যাকার এতোটাই সহজলভ্য যে তখনকার মতো সারা বছর অপেক্ষা করতে হয়না বাজির রোশনাই দেখার জন্যে। স্বাভাবিকভাবেই সেই প্রদর্শনীর জৌলুষ বা তার গ্রহণযোগ্যতা দুইই আজ যেন বয়সের ভারে ন্যুব্জ, বাতিলের খাতায় তার নাম উঠলো বলে। আমি নিজেও শেষ কবে সেই বাজি ফাটানো দেখতে গেছিলাম মনে পড়েনা আর।

সেই সময়ে এখনকার মতো খ্রীস্টমাসের কার্নিভাল ছিলোনা, হরেকরকম ব্র্যান্ডেড কেকের সম্ভার ছিলনা। ছিলনা হোয়্যাটসঅ্যাপ এর বার্তা, রকমারি ডেকোরেশনস আর তার সামনে সেলফি তুলে সোশ্যাল মিডিয়া এ পোস্ট করা। তখন বড়দিনের আগের দিন আমার অফিস ফেরতা মা লোকাল বেকারী থেকে একটা বড়ুয়ার কেক নিয়ে আসত, যেটা অবশ্য মা এখনও আনে প্রতি বছর। কোনোদিন খ্রীস্টমাস এ বিদেশী স্টাইলে মোজা ঝুলিয়ে স্যান্টাক্লজ আসার অপেক্ষা করা হয়নি কারণ ওই বিদেশী ঘরানার উদযাপনের সাথে অভ্যস্তই ছিলামনা সেই সময়। সেই অর্থে এখনের চেয়ে তখনের আমির ছোট্ট পরিসরে অনেক কিছুই ছিলনা। কিন্তু, সেই ছোট্ট আমির যা কিছু ছিল, তা আজকের অনেক পাওয়াকেই হয়তো ছাপিয়ে যাবে। আমার আমির তখন একটা বড়দিনের মেলা ছিল, মা বাবা দুজনের সাথে সেই মেলা ঘুরে মাটির খেলনাবাটি কিনে বাড়ি ফেরা ছিল, বাড়ির সবাই মিলে হইহই করতে করতে পিকনিকে যাওয়া ছিল ( সে গল্প পরে একদিন হবে ), হাতে তৈরি কার্ড আর ডাকবাক্সে আসা চিঠিপত্র ছিল, একটা স্বল্পদামী বড়ুয়ার কেক ছিল, একটা কম গ্ল্যামারাস কিন্তু মনের একদম কাছাকাছি থাকা উৎসবের আমেজ ছিল, সর্বোপরি আমার আমির একটা সাধারণ কিন্তু নিরুদ্বেগ জীবন ছিল।

Facebook Comments Box

LEAVE A RESPONSE

Your email address will not be published. Required fields are marked *

A whole time doctor, ameture writer, part time food photographer and dancer... Basically I'm jack of all trades, master of none?