পুরুষতন্ত্র আসলে নারীকে ততটা স্বাধীন দেখতে চায় যতটা হলে তাদের সুবিধা হবে। নারী এখনো পুরুষদের কাছে ভোগ্যপণ্য ছাড়া বিশেষ কিছুই নয়! বলতে খারাপ লাগলেও এটাই সত্যি যে আমাদের সমাজের বেশিরভাগ পুরুষ এখনো এই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। অনেকেই মনে করে নারী স্বাধীনতার অর্থ হল পুরুষদের দমিয়ে নারীদের স্বেচ্ছাচারিতা। আসলে স্বাধীনতা আর স্বেচ্ছাচারিতা যে ভিন্ন সেটা সম্পর্কে তাদের ধারণা সঠিক না থাকার ফলাফল এটি। নারীরা তাদের যোগ্যতা দিয়ে সাহসিকতার সঙ্গে যেটুকু অধিকার অর্জন করেছে সমাজের একাংশ আজও সেটাকে সমর্থন করেনা।
সমস্যাটা অবশ্য কেবলমাত্র পুরুষদের নয়, আমাদের সমাজব্যবস্থাই তাদের এই ধারণার দিকে ঠেলে দিয়েছে। বহু মেয়েরাও এইসব ধ্যানধারণা বহন করে। একজন পুরুষ একজন নারীর সাথে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হওয়ার অর্থ দুজনেই সম্পর্কটিকে সমাজের সামনে ধর্মীয়ভাবে কিংবা আইনি মতে স্বীকৃতি দিচ্ছে। অথচ আজও আমাদের সমাজের বহু মেয়েরাই মনে করে পুরুষরা বিয়ে করে তাদের স্ত্রী হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। উল্টোটাও তো ভাবা প্রয়োজন। একজন মেয়ে বিয়ে করে একজন ছেলেকে তার স্বামী হিসাবে স্বীকৃতি দিচ্ছে। আসলে বেশ কিছু ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায় মেয়েরা নিজেরাই নিজেদের আত্মসম্মান ভুলে নিজেদের চিন্তাভাবনাকে অবদমিত করে রাখে। এর ফলস্বরূপ দিনবদলের স্বপ্ন বাস্তবে অধরাই থেকে যায়।
“ম্যারিইটাল রেপ” এই টার্মটির সাথে আমরা অনেকেই বর্তমানে পরিচিত। কিন্তু এই ব্যাপারে সমাজ মোটেই সচেতন নয়। আসলে নারীর যৌন স্বাধীনতা থাকতে পারে সেটা আমাদের সমাজ এখনো বিশ্বাস করেনা। যৌন স্বাধীনতার অর্থ সম্পর্কে অনেকের মনেই সংশয় আছে… তারা মনে করে যৌন স্বাধীনতার অর্থ যে কারোর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা। এটা ভুল ধারণা। এর প্রকৃত অর্থ হল যৌন সম্পর্কে অনিচ্ছুক হলে সেটা নির্দ্বিধায় অপরজনকে বলতে পারা এবং অপরজনের দায়িত্ব সঙ্গী/সঙ্গিনীর ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে মান্যতা দেওয়া। এই সম্মানটুকু প্রতিটি নারী তার স্বামীর থেকে প্রত্যাশা করতেই পারে। কিন্তু, ভারতের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির অধিকাংশ বিবাহিত নারীরাই অন্য অনেককিছুর মতোই যৌন স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত। কথাতেই আছে “রক্ষকই ভক্ষক”! (যদিও নারীর পাশে সহযোদ্ধা এবং বন্ধুর প্রয়োজন থাকলেও রক্ষকের প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করিনা। )
“কন্যাদান উঠে যাওয়া উচিত” এটা বর্তমানে বহু মেয়েদের মনের কথা। কিন্তু তা বাস্তবায়িত করার পথে বাঁধা আসছে। কন্যাদান ব্যতীত বিবাহের বিরুদ্ধে কিছু পুরুষের যুক্তি প্রতিটা নিয়মের পিছনেই নাকি কার্যকারিতা আছে তাই বিয়ের সময় কন্যা সম্প্রদানেরও প্রয়োজন আছে। সহজ কথা হল কন্যা কোনো বস্তু নয় এবং কোনো মানুষকে দান করা সম্ভব নয়। আসলে সব পুরুষরাই নারীদের দুর্বল ভাবে, নীচু চোখে দেখে এমন নয় কিন্তু বহু পুরুষরাই চিরাচরিত নিয়মগুলো দেখতে অভ্যস্ত এবং সেগুলোকে নিয়ে তারা কখনো গভীরভাবে ভাবেনি, কিংবা এসব নিয়ে তাদেরকে কেউ ভাবিয়ে তোলেনি। অনেকে চিন্তাভাবনা না করেই তাই নিয়মভাঙার বিরোধিতা করছে। আসলে আমি বিশ্বাস করি, পুরুষ কখনোই নারীর শত্রু নয়। আমাদের শৈশব থেকে যা যা শেখানো হয় সেগুলোই অনেকসময় আমাদের ভিতরে নানা ভেদাভেদ তৈরি করে। আমাদের সমাজের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সুবিধাভোগী মানুষগুলো আসলে সকলের শত্রু আর এরাই এই বিভাজনের পরিকাঠামো গড়ে তুলেছে।
আন্তর্জাতিক নারী দিবসে তাই এটাই চাইবো নারীরা নিজেরা নিজেদের সম্মান করুক, নিজেদের অধিকার অর্জনে সচেষ্ট হোক এবং নিজেদের ইচ্ছেপূরণের ভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে এগিয়ে চলুক। আশা রাখি, এই এগিয়ে চলার পথে পুরুষদের তারা পাশে পাবে। এটা বোঝা প্রয়োজন যে নারীজাতির উন্নয়ন পুরুষদেরও সামনের সারিতে এগিয়ে দেয়। নারীশক্তির বিকাশ ঘটলে সমাজের চোখরাঙানী ক্রমশ ম্লান হয়ে যাবে এবং বৈষম্যহীন নতুন দিন আসবেই।