রঙ রুটে

রঙ রুটে

 

ল্যাপটপটা বন্ধ করার সাথে সাথেই আগে কি সুন্দর অন্ধকার হয়ে যেত চারপাশ। কি সুন্দর একটা নিস্তব্ধতা বিরাজ করতো চারপাশে, চোখ বন্ধ করার মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ঘুম চলে আসতো হনহনিয়ে। কিন্তু সুখ কি আর চিরকাল থাকে? বিগত কয়েকদিন ধরে ঘর পুরোপুরি অন্ধকার হচ্ছেনা। মোবাইলটা খুলে হাঁ করে ওয়ালপেপারের দিকে তাকিয়ে থাকছে সায়ন। ওতে শালিনীর একটা সেলফি। গায়ের রঙ ফর্সা ধবধবে, চোখ দুটো বড় বড় করে ঠোঁটটা একটু বেঁকিয়ে তোলা।

প্রতিদিন রাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে ওই ছবি দেখে যে কী পায় বুঝি না। আগে তাও গেম খেলতো, এটা সেটা ঘেঁটে দেখতো। এখন শুধু শালিনী আর শালিনী। রাত তিনটে অবদি ওয়ালপেপার দেখা, ঘন ঘন
হোয়াটসঅ্যাপ চেক করা, দু-একবার প্রোফাইল ঢুঁ মেরে আসা চলতেই থাকে…

নিজে ঘুমোবিনা ঘুমোস না, প্রতিদিন রাত দুটো নাগাদ কিশোর-রফিকে কানের সামনে নিয়ে এসে আমারও ঘুম ভাঙানো চাই। যতবারই বলেছি কানে ইয়ারফোন গুজে শোন, গম্ভীর গলায় জবাব দিয়েছে ওভাবে শুনলে
ঠিক ফিলিংসটা আসেনা। এই নিয়ে যে আমাদের মধ্যে খিস্তাখিস্তি হয়নি এমনটা নয়, কিন্তু একবার হোঁচট খেয়ে প্রেমে পড়েই গেলে কে শোনে কার কথা। আর প্রেমটা যদি একতরফা হয় তাহলে তো পোয়া বারো। খেতেও ভাল্লাগেনা, ঘুমোতেও ভাল্লাগেনা। আর সবচেয়ে বড় কথা হল কেন যে ভাল্লাগেনা সেটা ভাবতেও ভাল্লাগেনা। অগত্যা ওর পরিস্থিতির কথা ভেবে বাধ্য হয়ে মাঝরাতে রফি-কিশোরকে অ্যাকসেপ্ট করা ছাড়া আমার কোনো উপায় ছিল না। আজকাল আমারও শোয়ার পরই মনে হয় কখন গান শুরু হবে, কোন কোন গানগুলো বাজবে, আর অবশেষে কোন গানটা বাজতেই থাকবে, আভি না যাও ছোড়কার? নাকি মেরি ভিগি ভিগি সি?

যথারীতি রুটিনটা আজও একইরকম চলছিল। আধো আলো ছায়াতে ঘরের ভেতর জমে উঠেছে রফি-কিশোরের আড্ডা, আমিও মনে মনে গুনগুন করছি। হঠাৎ গানটা বন্ধ হয়ে ভোঁওওওও করে সায়নের ফোনটা কাঁপা শুরু করলো। এতরাতে কে ফোন করবে? সায়নের মা অবশ্য মাঝেসাজে রাতে ফোন করে, মুখে বলে ভুল করে চলে গেছে কিন্তু আদতে দেখতে চায় যে নেশা করে রয়েছে কিনা। কিন্তু তাই বলে রাত দুটো নাগাদ? কে করেছে? বলতে গিয়ে চোখ গিয়ে ঠেকলো মোবাইল স্ক্রীনটার দিকে। তাতে জ্বলজ্বল করছে নামটা, শালিনী।

হাঁ করে কিছুক্ষণ স্ক্রীনটার দিকে চেয়ে তড়িঘড়ি করে স্লাইড করলো সায়ন।
— হ্যালো!
— ষাঁড়ের মতো চেঁচিয়ে হ্যালো বলার কী হল?
ওপাশ থেকে শালিনীর গলাটা অস্পষ্ট কিন্তু শুনতে পাওয়া যাচ্ছে।

নিজের সাথে ষাঁড়ের তুলনাটা হয়তো সায়ন নিতে পারেনি। তাই কিছুক্ষণ চুপ করে তারপর বললো, “ও কিছু না, তুই এত রাতে? কী ব্যাপার?”
শালিনী বললো, “কাল সকাল সকাল একটু আসতে পারবি? তোকে আমি কিছু দিতে চাই।”
সায়ন এবার বেশ জোর গলায় বললো, “কী দিতে চাস?”
শালিনী বললো, “কালকেই দেখতে পাবি।”
সায়ন বললো, “কখন আসতে হবে?”
শালিনী বললো, “ন’টার দিকে, পারবি তো?”
সায়ন বললো, “কেন পারবো না? ন’টার আগেই
এসে পড়বো।”
শালিনী বললো, “থ্যাঙ্ক ইউ।”
সায়ন এবার বললো, “ধ্যাত বেস্টফ্রেন্ডকে কেউ থ্যাঙ্ক ইউ বলে? বলছি একটা চুমু…”
শালিনী বললো, “ধ্যাত, বেস্টফ্রেন্ডকে কেউ চুমু খায়? সকাল সকাল এসে পড়বি কিন্তু, মনে থাকে
যেন, আমি রাখছি।”

মোবাইলের আলোটা একবার জ্বলে আবার নিভেও গেল, সায়ন কানে ফোনটা তেমনই ধরে।
তোকে ও বেস্টফ্রেন্ড কবে বানালো? আমার প্রশ্নটায় সম্বিত ফিরলো সায়নের। তারপর বেশ গম্ভীর গলায় বললো, “পরশুদিন।”
আমি আর কথা বাড়ালাম না, ওপাশ ফিরলাম। কাল কী দিতে পারে শালিনী সায়নকে?

হাঁটতে হাঁটতে হাঁফ ধরে আসছিল, সায়নকে বললাম, “একটা টোটো ধর। আর কতক্ষণ?”
সায়ন বললো, “এইতো চলেই এসছি, ওই যে গলিটা দেখছিস, ওখান দিয়ে মিনিট পাঁচেক হাঁটলেই আরেকটা গলি, ওখান দিয়ে মিনিট পাঁচেক হাঁটলেই…”
আমি বললাম, “আরেকটা গলি?”
সায়ন বললো, “ওসব ছাড়। শালিনী আমাকে কী দিতে পারে বলে মনে হয় তোর?”
আমি বললাম, “গোলাপফুল?”
সায়ন বললো, “হুরর, এত ছোটো মানসিকতার কেন তুই? বড় করে ভাব। হয়তো মুখে বলতে পারছে না বলে কাগজে লিখে দেবে।”
আমি বললাম, “লাভলেটার?”
সায়ন বললো, “হুম তবে মডার্ন। আধুনিক কবিদের ফোর লাইনারগুলো থাকবে তাতে। মাঝে ছোট্ট করে সেই তিনটে ম্যাজিক্যাল শব্দ… আহা! ভাবতেই গাঁয়ে কাঁটা দিচ্ছে।”

পিজির নীচেই দাঁড়ানো শালিনী। পরনে লাল রঙের একটা কুর্তি। কাঁধ থেকে কোমর অবদি একটা ঝোলা ব্যাগ। ওই ব্যাগেই কি তবে লাভলেটারটা আছে? কিন্তু তার জন্যে ব্যাগের কী দরকার?

আমাদের দেখেই হাসিহাসি মুখ করে এগিয়ে এল।
সায়ন অস্ফুটে একবার বললো, “ভাই বুক ঢিপঢিপ করছে, হার্টঅ্যাটাক-ট্যাটাক…
আমি বললাম, “না না, ওসব হয়।”
শালিনী এগিয়ে এসেই বেশ সুন্দর করে প্রথমে গুডমর্নিং জানালো আমাদের। এবার জিনিসটা দেওয়ার পালা। শালিনীর হাত চলে যাচ্ছে ঝোলা ব্যাগের দিকে। আমি আর সায়ন দুজনেই পলক ফেলতে পারছিনা।

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে শালিনী জিনিসটা বের করে আনলো, জিনিসটা নয় বরং জিনিসগুলো বললে ভালো হবে।
সায়ন জিনিসগুলো দেখে একবার ভ্রু কুঁচকে গাল চুলকোতে চুলকোতে শালিনীকে বলল, “অ্যাঁঁ, খাতা?”
শালিনী এবার একটু আলগা হাসি হেসে বলল, “হ্যাঁ, আসলে পরীক্ষা সামনে জানিসই তো, একটাও অ্যাসাইনমেন্ট লেখা হয়নি। তোর তো হাতের লেখা খুব সুন্দর, যদি একটু লিখে দিস খুব উপকার হবে।”
সায়ন গাল চুলকোতে চুলকোতেই বলল, “হ্যাঁ? অ্যাসাইনমেন্ট?”
শালিনী বললো, “তিনদিনের মধ্যে দিলেই হবে। সোমবারে সাবমিশন। তাই তো সকাল সকাল আসতে বললাম, নয়তো তোরই অসুবিধে হতো। কীরে পারবি তো? নয়তো
রক্তিমকে বলে দেখবো।”
সায়ন কিছু না বলে শালিনীর হাত থেকে খাতাগুলো নিয়ে নিল। ওই মুহূর্তে ঠিক কী এক্সপ্রেশন দেওয়া উচিৎ আমার জানা নেই। ভীষণ জোরে হাসি পেলেও পরিস্থিতি যখন হাসতে মানা করে, ওই
সময়টাকে বাগে আনা মুশকিল। তবুও শালিনী আর সায়নকে ছেড়ে চোখের সামনে যা যা দেখলাম, আকাশ, মেঘ, গাছগাছালি, চায়ের দোকান, দেবের সিনেমার পোস্টার সবকিছুর দিকে এমনভাবে তাকিয়ে রইলাম যেন
কিছুই হয়নি।

লেখার কথা কার, লিখতে হবে কাকে! সায়ন আরেকটু বড় করে ভাবতে পারলো না কেন? মেসে ফেরার পর কয়েক ঘণ্টা কেটে গেছে। সায়ন খাতাগুলো একবার করে হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখছে আবার রেখে দিচ্ছে।
আমি এই বিষয়ে কথা বাড়াতে চাইছি না। কারণ এক্সপেক্টেশন যখন লাভলেটার হয়, আর রিয়েলিটিটা অ্যাসাইনমেন্টের খাতা, তখন আঘাতটা খুব একটা ছোটো তো নয়।
হঠাৎ সায়ন আমার দিকে তাকিয়ে বললো, “তোর মনে হচ্ছে না শালিনী আমাকে ইউজ করছে? একবারের জন্যেও মনে হচ্ছে না?”
আমি জোর গলায় বললাম, “এইতো, এইতো বুঝেছিস তবে।”
সায়ন হাতে ধরে থাকা খাতাটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বললো, “সায়ন সেনগুপ্তকে ব্যবহার? সায়ন সেনগুপ্তকে? কালকেই যদি ওর মুখের উপর গিয়ে খাতাগুলো ছুঁড়ে না দিয়ে এসছি আমার নামও সায়ন সেনগুপ্ত নয়।”
আমি সায়নের পিঠে একটা চাপড় মেরে বললাম, “কেয়া বাত। আরে মেয়ে অনেক
আসবে জীবনে।”
সায়ন সম্মতিসূচক মাথা নাড়লো।

রাতে খাওয়াদাওয়া করে শুয়েছি কিছুক্ষণ হল। আজকে ঘর পুরোপুরি অন্ধকার। রফি-কিশোরও নেই। এত তাড়াতাড়ি সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে ভাবতে পারিনি। ভাবতেই পারছিনা সায়ন ঘুমিয়ে নাক ডাকাও শুরু করে
দিয়েছে। প্রশান্তি নিয়ে ওপাশ ফিরলাম। আবার আগের মতো সব। ভালো লাগছে, আবার একটু খারাপও লাগছে। রফি-কিশোরের সাথে আড্ডাটা খারাপ ছিল না। ভাবতেই ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়েছি কখন ঠিক নেই।
ঘুমের মধ্যেই দেখছি আলো আর আলো। ওইতো রফি-কিশোর এলো ঘরে, গান ধরলো। বাপরে এতো রিয়েলিস্টিক স্বপ্ন? চোখ খুলেই ধড়ফড়িয়ে উঠলাম। দেখি ঘরের টিউব লাইটটা জ্বলছে, গান ধরেছে কিশোরকুমার।
আর চেয়ার থেকে টেবিলে ঝুঁকে মন দিয়ে অ্যাসাইনমেন্ট টুকে যাচ্ছে সায়ন…
আমায় উঠতে দেখেই বললো, “যতটা দেখছি তিনদিনের ভেতর কমপ্লিট হয়ে যাওয়া তো উচিৎ। বলেই আবার মন দিল খাতায়…”

কিছুক্ষণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে আমি আবার শুয়ে পড়লাম। খুব যে অবাক হয়েছি এমনটা নয়। কয়েকদিনের ভেতরে যেটুকুই যা হয় সেটা নেহাত ঠুনকো তো নয়। হয়তো সব সম্পর্কই গোড়ায় এরকম একটু-আধটু রঙ রুটে চলে। তবে এভাবেও যদি আঁকড়ে ধরে থাকা যায়, ক্ষতি কি?

Facebook Comments Box
Staff Writer

Editorial Team of LaughaLaughi

Recent Posts

SVF Music Unveils April Edition of “Banglar Gaan Indies”

Following the resounding success of the inaugural edition, SVF Musicproudly announces the arrival of the…

4 months ago

Mimi Chakraborty and Nabila to Star Alongside Shakib Khan in ‘Toofan’

Amidst ongoing speculations regarding the leading lady opposite Shakib Khan in the upcoming film 'Toofan',…

5 months ago

Why Does a Rich Chicago Law Firm Keep Suing Indian Tribes?

This article originally appeared in DC Journal: https://dcjournal.com/why-does-a-rich-chicago-law-firm-keep-suing-indian-tribes/ Why does a deep-pockets Chicago law firm keep…

9 months ago

Anupam Roy’s ‘Aami Sei Manushta Aar Nei’ is a Musical Masterpiece

In a spectacular celebration coinciding with the birthday of the iconic actor Prosenjit Chatterjee, the…

10 months ago

অনুষ্কা পাত্রর কণ্ঠে শোনা যাবে দে দে পাল তুলে দে

হিমেশ রেশামিয়ার পর সুরাশা মেলোডিজ থেকে অনুষ্কা পাত্রর নতুন গান পুজো আসছে মানেই বাঙালির নতুন…

10 months ago

Srijit Mukherji’s Dawshom Awbotaar is On a Roller Coaster!

The highly awaited trailer of grand Puja release, "Dawshom Awbotaar", produced by Jio Studios and…

10 months ago