” উঁফ্,একটা চা-এর খুব প্রয়োজন, কী বলেন প্রোফেসর দত্ত?”
” হ্যাঁ প্রোফেসর বাসু চা হলে মন্দ হয় না, গত তিন ঘণ্টা ধরে উত্তরপত্র দেখতে গিয়ে মাথাটা বেশ ঝিমঝিম করছে।”
” তা যা বলেছেন, আজ তো আমরা দুজন ছাড়া আর কোনো প্রোফেসর উপস্থিত নেই। সকালে অনেকেই এসে ছিলেন, দুপুরের সময়টা আজ দেখছিআমার আর আপনার পড়েছে। ”
“যাক, আর কী করা যাবে। কলেজে ঢোকার সময় দেখছিলাম রাকেশ আছে। বোধহয় আজকে ওর গার্ড দেওয়ার কথা। ওকে ডেকে দুটো কড়া চা আনতে বলে দি। ”
প্রোফেসর বাসু রাকেশ কে হাক দিল। কিন্তু ওর কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। টিচার্স রুম থেকে বেল বাজালো প্রোফেসর বাসু তবে রাকেশ-এর কোনো হদিস নেই।
“কোথায় গেছে কে জানে? নতুন কাজে এসেই ফাঁকিবাজি। দরকারে কোনো পাত্তা নেই তার। আমাদের রামদয়াল ভালো। গেট থেকে এক পা নড়ে না। আমি নিজে গিয়ে দুটো চা নিয়ে আসি দত্ত। ওটা ছাড়া আর কাজ এগোনো যাবে না। ”
এই বলে প্রোফেসর বাসু চা আনতে চলে যান। পুরো কলেজে তখন আমি একা। ঘড়ির কাঁটার শব্দ কেমন যেন বাজছে। সব দিক নিশ্চুপ। মাথার উপর পাখার বনবন আর খাতার পাতার খসখস শব্দ আমার সঙ্গী। খাতা দেখার মধ্যে নিজেকে ব্যস্ত রাখ ছিলাম, এমন সময় আবার আমার লাল পেনের কালি শেষ হয়ে গেল। পুরো টিচার্স রুম খুঁজে একটাও পেন পেলাম না।
“একটু আগে শেষ হলে বাসু কে বলতে পারতাম একটা পেন আনার জন্য। ”
হঠাৎ খাতাগুলোর উপরে চোখ পড়তেই দেখলাম একটি নিখুঁত সোনালী পেন খয়েরি ডোড়াকাটা পড়ে আছে।
“এই পেনটা এখানে কী করে? এতো খুঁজলাম একটি পেন পেলাম না কোথাও, আর এটা এতো সামনে ছিল দেখতে পেলাম না। হয়তো আমি খেয়াল করিনি। ”
পেনটা দিয়ে যখন লিখতে গেলাম কী রকম অদ্ভুত লেখা পড়ছিল, কালিকা যেন গাঢ় লাল রঙ, ঠিক রক্তের মতো। আমি আমার মতো করে লিখলেও লেখার ধরন আলাদা ছিল – সেটা আমার নয়। অদ্ভুত লাগছিল আমার। আমি চেয়ার থেকে উঠবো এমন সময় প্রোফেসর বাসু চলে এলেন।
“দ্ত্ত এনাও চা। কলেজের গেটে রামদয়াল কে দেখলাম, শুনলাম রাকেশ- এর জ্বর তাই সে বাড়ি চলে গেছে। কী ব্যাপার এতো অস্থির কেনো? ”
নিজের চোখের ভুল ভেবে এই পেনের লেখা আমি বাসু কে দেখালাম। সেও চমকে উঠলো। আমি যা দেখছি তার চোখে ও তাই ধরা পড়েছে। আমরা দুজনেই বাকরুদ্ধ, কপাল বেয়ে ঘাম ঝড়ে পড়ছে আমাদের দুজনেরই।
টিচার্স রুম থেকে বেড়িয়ে বোস আর আমি রামদয়াল কে ডাক দিলাম সে ছুটে এসে আমাদের অবস্হা দেখে থমকে গেল।
“কী হয়েছে স্যার? কিছু আনতে হবে। ”
কাঁপা স্বরে আমি বললাম,
” টিচার্স রুম বন্ধ করে দাও। আমরা বাড়ি যাব। ”
” কিন্তু স্যার পাঁচটা অবধি থাকার কথা, এখন চলে গেলে আমার ডিউটি শেষ হয়ে যাবে। ”
” এই ঘটনার পরে এখানে কী করে থাকবো বলো? ”
“কী ঘটনা স্যার? ”
“তবে এসো দেখাচ্ছি। ”
টিচার্স রুমে ঢুকে পেনটা চোখে পড়লো না, একেবারে অদৃশ্য। তবে অদ্ভুত লাল লেখাটা ছিল তখনও। ওটা রামদয়াল কে দেখিয়ে সবটাই বললাম প্রথম থেকে। কিন্তু সব শুনে ও একটুও অবাক হলো না।
“এই রকম ঘটনা কী করে ঘটলো রামদয়াল? ”
“স্যার আপনারা নতুন এসেছেন তাই হয়তো জানেন না এই কলেজে এক দশক আগে এক ছাত্র, পড়াশোনাতে বেশ ভালো, শিক্ষকদের সম্মান করতো। কলেজে ঢুকেই সব শিক্ষকদের পেন উপহার দিয়েছিল। কিন্তু সিনিয়রদের অত্যাচারের মুখে পড়ে প্রাণ হারায়। সে শিক্ষকদের জানিয়ে ছিল তবে কেউ আমল দেইনি। আপনাদের আগে এই ঘটনা অনেকের সাথেই ঘটেছে। তবে কেউ কথা বলে না এই ব্যাপারে। আগে শুনেছি এই ঘটনা আমি। স্যার আপনারা ্যবেড়িয়ে গেলে তালা দিয়ে দেব। ”
রামদয়াল কথাগুলো অনায়াসে বলে চলে গেলে আমি আর প্রোফেসর বাসু দুজনেই হতভম্ব হয়ে বসে রইলাম। সব সাড় যেন হারিয়ে গেছে।
তবে সেই কী আমাকেও দরকারে ওই অদ্ভুত পেন দিলো!
কলেজ থেকে বাড়ি ফিরে খুব অস্থির লাগছিল। আমার স্ত্রী জিজ্ঞেস করলো, “তোমার আজ এতো দেরি হলো ফিরতে? তোমায় এতো অস্থির দেখাচ্ছে কেনো? ”
“হ্যাঁ, একটু কাজ ছিল। সেইরকম কিছু নয়, একটু ক্লান্ত লাগছে, বিশ্রাম নিলে ঠিক হয়ে যাবো। ”
রঞ্জা কে কিছু জানাতে পারলাম না। ওর সাথে আর বেশি কথা না বলে ঘরে চলে গেলাম। ভাবলাম একটু ঘুমালে স্বস্তি লাগবে। কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসছে না। চোখ বন্ধ করলে শুধু ওই পেনটা আর রক্তের মতো গাঢ় লাল কালির লেখাগুলো ভেসে উঠছিল চোখের সামনে। আর পেনটা অদৃশ্য হয়ে যাওয়া সেটাই বা ভুলি কীভাবে। রামদয়ালের কথাগুলো কানে বাজছিল। সব কিছু কেমন তালগোল হয়ে যাচ্ছিলো। এর মধ্যে শুনলাম
“স্যার, আপনিও কী আমায় বিচার দেবেন না অন্যদের মতো? ওরা আমার ওপর অত্যাচার করেছে। ওদের কোনো শাস্তি হয়নি স্যার। কেউ আমায় বাচানোর জন্য হাত বাড়িয়ে দেয়নি। আমার মা অনেক কষ্ট করে এই কলেজে আমায় ভর্তি করেছিলো। আমি অনেক স্বপ্ন নিয়ে ভর্তি হয়েছিলাম এই কলেজে। আপনাদের মতো আমিও প্রোফেসর হতে চেয়ে ছিলাম। মা-এর একমাত্র সম্বল ছিলাম আমি। আমার মা আয়ার কাজ করতেন। ভেবেছিলাম পড়াশোনা করে মা-এর পাশে দাঁড়িয়ে সব কষ্ট ঘুচিয়ে দেবো তাঁর। কিন্তু ওরা আমার স্বপ্নগুলো পুরণ করতে দিলো না। আমার মা সহ্য করতে না পেরে তিনিও প্রাণ হারিয়েছিলেন। ওরা আমার মা-এর মৃত্যুর জন্যও দায়ী। আমার অসম্পূর্ণ স্বপ্নগুলোর বিচার চাই। আমার প্রতিকার চাই স্যার। আপনি করবেন না প্রতিকার ? ”
চমকে উঠলাম আমি। বুঝলাম ওটা স্বপ্ন ছিল। ঘড়িতে তখন রাত তিনটে। ঘটনাগুলো ভাবতে ভাবতে চোখ দুটো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। স্বপ্নটা দেখার পর থেকে একটুও শান্তিতে বসতে পারলাম না। বাকি রাত টেবিলে বসে কাটিয়ে দিলাম। স্বপ্নটা মনে পড়লে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে। কিছুতেই বুঝতে পারছি না কীভাবে তাঁর মৃত্যুর প্রতিকার করবো?
পরের দিন সকালে,
“এতো তাড়াতাড়ি বেড়োচ্ছ যে? সবে তো ৯টা বাজে।
“কাজ আছে একটু রঞ্জা, তাই যেতে হবে তাড়াতাড়ি। ”
“তুমি কিছু লুকিয়ে যাচ্ছো আমায়? ”
“সময় মতো তোমাকে সব বলবো রঞ্জা। আমাকে পারতেই হবে। ”
“কী পারতে হবে তোমায়? ”
“এখন আমি আসি, পরে কথা হবে । ”
রঞ্জা কে এড়িয়ে কলেজের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। প্রোফেসর বাসু কে ফোন করে একটু আগে কলেজে আসতে বলে দিয়েছিলাম। টিচার্স রুমে প্রোফেসর বাসুর সাথে দেখা হয়। আমি রাতের স্বপ্নটা বিস্তারিত ওনাকে জানালাম। প্রোফেসর বাসু ও শুনে অবাক হলেন।
“প্রোফেসর বাসু কীভাবে তাঁকে বিচার দেবো আমি। আমি যে কিছু তেই শান্তি পাচ্ছিনা । ”
“কিন্তু প্রোফেসর দত্ত আমি বা আপনি সেই ঘটনার সময় ছিলাম না। ”
“জানি প্রোফেসর বাসু। তাঁর উপর অত্যাচারের প্রতিকার করতে না পারি আমিও তাঁর কাছে অপরাধি হয়ে যাবো বাকিদের মতো। একটা চেষ্টা করতেই হবে আমায়। ”
“প্রোফেসর দত্ত তাহলে আমাদের একবার প্রিন্সিপাল স্যারের সাথে কথা বলে বিস্তারিত জানতে হবে। ”
প্রিন্সিপাল স্যারের অফিসে ঢুকতে টেবিলের পেন দানিতে চোখে পড়লো সেই একই রকম পেন- সোনালি খয়েরি ডোড়াকাটা।
“আসুন প্রোফেসর দত্ত, বলুন”
“স্যার এই পেনটা আপনি কোথা থেকে পেয়েছেন? ”
“এইটা, আমাকে এক ছাত্র উপহারে দিয়ে ছিল।”
“দশ বছর আগে দিয়ে ছিল কী স্যার? ”
“প্রোফেসর দত্ত আপনি কীভাবে জানলেন? ”
“এই বিষয়ে কথা বলতেই এসেছি স্যার ।”
“দশ বছর আগের পুরানো কথা আমি আপনার সাথে বলতে ইচ্ছুক নই। ”
আগের দিন দুপুরের আমার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা আর স্বপ্নটা তাকে বিস্তারে জানালাম।
“সবটা বললাম আপনাকে। এর পরেও কী আপনার মনে হচ্ছে না নির্দোষ ছেলেটার বিচার হওয়া দরকার? ”
স্যার আমার কথার কোনো উত্তর দিলেন না। কথাগুলো বলে টিচার্স রুমে এসে প্রোফেসর বাসুর সাথে কথা বলছিলাম এমন সময় রামদয়াল এসে বললো
“স্যার,প্রিন্সিপাল স্যার আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। ”
আমি স্যারের অফিসে ঢুকতেই
“প্রোফেসর দত্ত বলুন আমি এই বিষয়ে কীভাবে সাহায্য করতে পারি? ”
“অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। ওই ছাত্রটির ব্যাপারে বিস্তারিত বলুন স্যার? ”
“ওর নাম অয়ন দে। বি. এ বাংলা ওনার্সের ছাত্র ছিলো। খুব মেধাবী ছাত্র ছিল। ফাইনাল ইয়ারের ছাত্ররা ওকে সহ্য করতে পারতো না। ওরা ওর থেকে তিরিশ হাজার টাকা চেয়েছিলো। ওরা জানতো ওর সামর্থ্য নেই। তাই ওরা হুমকি দেয় ওকে যে টাকা দিতে না পারলে ওর মা কে হত্যা করবে। যদি ওর মা কে বাঁচাতে হয় তাহলে যেন ও নিজে আত্মঘাতী হয়। ও সবটাই আমাদের জানিয়ে ছিলো কিন্তু… ”
“কিন্তু আপনারা কেউ ওর কথায় আমল দেননি, তাই তো স্যার? ”
“না প্রোফেসর দত্ত, আমরা কেউ বুঝতে পারিনি ও ওদের কথা শুনে আত্মহত্যার পথ বেচে নেবে। ও এই কলেজ ক্যাম্পাসে মারা যায়। সেদিন আর আমরা কিছু করতে পারিনি। ”
“ও যাদের নামে অভিযোগ করেছিল তাদের নাম আপনার মনে আছে স্যার? ”
“হ্যাঁ আছে , তারাও তুখোড় ছিল পড়াশোনাতে। দশ বছর আগে কলেজের বদনাম হবে ভেবে ঘটনাটার সাথে আপোষ করে ছিলাম। তবে আর করবোনা আপোষ। ”
“এর একটি বিহিত করতে হবে। আপনি ওদের ডেকে পাঠান কলেজে আজকেই ওদের পুলিশের হাতে তুলে দেবো আমরা। আইন ওদের অপরাধের বিচার করবে। ”
সেদিন বাড়ি ফিরে চোখটা জুড়িয়ে আসছিল ঘুমে, অদ্ভুত শান্তি লাগছিল নিজের।
“জানি না কতটা বিচার পেলো সে? ”
“ধন্যবাদ স্যার। আজ আমি বিচার পেয়েছি আর আমার অপরাধিরা শাস্তি। আজ আমিও খুব শান্তি পেয়েছি স্যার। আমার স্যারেদের দেওয়া পেনগুলো আজ মান পেয়েছে।”
ঘুমটা হঠাৎ করে ভেঙে গেলো। সে আবার এসেছিল। তবে জেনে শান্তি পেলাম সে আমার থেকে যা চেয়ে ছিলো, আমি দিতে পেরেছি। সাময়িক ক্ষন এর জন্য হলেও সে আমাকেও পেনটা দিয়েছিল, তার মান আমি রাখতে পেরেছি, নিরাশ করিনি তাঁকে।
পরের দিন সকালে কলেজে যেতেই প্রিন্সিপাল স্যার ওই পেন টি আমাকে দিয়ে বললেন
“প্রোফেসর দত্ত এই পেনটি আমি উপহারে পেলেও এটি আপনার প্রাপ্য। ”
~সমাপ্ত
Following the resounding success of the inaugural edition, SVF Musicproudly announces the arrival of the…
Amidst ongoing speculations regarding the leading lady opposite Shakib Khan in the upcoming film 'Toofan',…
This article originally appeared in DC Journal: https://dcjournal.com/why-does-a-rich-chicago-law-firm-keep-suing-indian-tribes/ Why does a deep-pockets Chicago law firm keep…
In a spectacular celebration coinciding with the birthday of the iconic actor Prosenjit Chatterjee, the…
হিমেশ রেশামিয়ার পর সুরাশা মেলোডিজ থেকে অনুষ্কা পাত্রর নতুন গান পুজো আসছে মানেই বাঙালির নতুন…
The highly awaited trailer of grand Puja release, "Dawshom Awbotaar", produced by Jio Studios and…
This website uses cookies.