‘স্ত্রৈণ’ শব্দটি জীবনে কখনো না কখনো নিশ্চই শুনেছেন। প্রথম বার শুনে সে উচ্চারণ করতে যতই ঠেক খেতে হোক না কেনো, বলার ধরন দেখে মানে বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়! আমাদের সমাজে এখনো শব্দটি উচ্চারণকালে দাঁতে দাঁত চেপে, চোখে একরাশ ঘৃণা নিয়ে, অনেকটা অবজ্ঞা করে কোনো এক পত্নীব্রতা পুরুষের উদ্দেশ্যে বলতে শোনা যায়। আমার কথা আপনারা বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, তবে আদর্শ পত্নীব্রতা পুরুষ বলতে দশরথ পুত্র রাম এর চেয়ে যোগ্য উদাহরণ আর নেই। মনে নেই সেই লাইনটা? কি যে করেন মশাই! উনিশ-বিশ তো বাদই দিলাম, আমাদের একুশের দোরগোড়ায় এসেও যাত্রা মঞ্চ কাঁপালো যে দৃশ্য— সীতা হরণের পর রাম বিলাপ করে বলছেন, “সীতা বিনা আমি যেন মণিহারা ফণী” ভাবতে পারছেন সে কী উপমা! আর আমি তো ছোটো থেকে একটাই ডায়ালগ শুনে আসছি— ‘বউ হারালে বউ পাওয়া যায় রে পাগলা, মা হারালে মা পাওয়া যায় না!’ আহা রে! বউ যেন ছেলের হাতের মোয়া মুড়কি! স্ত্রীভক্ত রামচন্দ্রকেও কি স্ত্রৈণ বলে গালিগালাচ করেন নাকি! যে স্বামী স্ত্রীর বিশেষ অনুরাগী, তাকে স্ত্রৈণ বলা হয়। এটা কোনো ভারিক্কি চালের গালাগালি নয় মশাই!
এতো গুলো কথা গায়ে পড়ে বলার একটা কারণ বলি তবে, শুনুন! সেদিন টিভি চালিয়ে নিজের ঘরোয়া কাজ করছি, কোনো একটা বাংলা সিরিয়াল দেখে একটু থমকে দাঁড়ালাম। জমজমাট সীন— নায়কের পিতৃদেব নায়কের কোনো একটা কাজে রেগে গেছেন, ওনার মুখটাকে জুম করে দেখানো হচ্ছে— তারপর তিনি হঠাৎ করে দাঁত খিঁচিয়ে কৃত্রিম এবং হাস্যকর ভাবে মাথা নাড়িয়ে ঘৃণা ভরে বলে উঠলেন,“স্ত্রৈণ কোথাকার! ছিঃ!” ব্যাপারটা বেশ ইন্টারেস্টিং লাগলো। কিন্তু ঘটনার আগাগোড়া কিছুই জানিনা, সবটাই তাই বোধগম্য সীমার ওপর দিয়ে গেল। পড়ে মায়ের কাছে আগের ঘটনা শুনে বুঝলাম নায়ক নাকি নববিবাহিতা স্ত্রীকে চাকরির পরীক্ষা দিতে নিয়ে গিয়েছিল বাড়ির অমতে লুকিয়ে মিথ্যে বলে। আমার তো আর হাসি ধরে না। এই সামান্য কারণে বাপ ছেলেকে বউয়ের চামচে বললো! আবার সেই দেখি পরের এপিসোডে গিন্নির পান সেজে দিচ্ছে। সেদিন চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলেছিলাম,“স্ত্রৈণ ছেলের যোগ্য স্ত্রৈণ বাপ!”
তবে আরেকটা ঘটনা শুনুন— পাশের বাড়ির ঠাকুমা দেখি খুব চেঁচামেচি করছে। আমি গুটি গুটি পায়ে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। পরের বাড়ির হাঁড়ির খবর নেওয়া আমার স্বভাব নয়, তবুও কেনো জানিনা সেদিন একটু ঝগড়ার ধরণটা অন্য রকম লাগলো। অন্যদিন শুনি কাকিমার ওপর চেঁচায়, ভাসা ভাসা কথা গুলো শুনে বুঝলাম এই বাক্ বর্ষণ চলছে নিজের ছেলের ওপর, মানে কাকুর ওপর। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে একটু কান খাড়া করে ভালো করে শোনার চেষ্টা করলাম। এখানেও দেখি সেই একই ডায়ালগ— স্ত্রৈণ। মনে হয় ঠাকুমা সেই সিরিয়াল দেখেই শিখেছে। চেঁচাচ্ছে শুনতে পাচ্ছি— “এতো দিন তুই বউয়ের হাতে হাতে কাজ করে দিতিস, বাসন মেজে দিতিস তাও মেনে নিয়েছি; কিন্তু তা বলে বউয়ের কাপড় কাচবি? আমাদের বুঝি বাচ্চা হয়নে? কটা ঝি চাকর ছিল তখন? তোর বাবা বুঝি আমায় মাথায় করে রাখতো! না কি তোর ঠাকুমা আমার কাজ করে দিত? এক্কেবারে হাতের পুতুল করে ফেলেছে…” আরো কত মন্তব্য— কম বেশি সবারই ধারণা আছে নিশ্চয়ই, বাকি আর কী কী বলা হতে পারে।
দেখবেন যে শব্দটা মনে একবার দাগ কাটে, সেটা আপনি রণে-বনে-জলে-জঙ্গলে যেখানেই শুনুন ঠিক কানে এসে ঠেকে। আবার সেটা যদি একটু খটমট শব্দ হয় তো কোনো কথাই নেই। এরকমই স্ত্রৈণ শব্দটা আজকাল কেমন যেন লোকের মুখে মুখে শুনছি। তার মানে এর আগে কি মানুষ এই শব্দ ব্যবহার করতো না! করতো। আমার ততটা কানসয়া হয়নি, তাই শুনেও খেয়াল করিনি বা গুরুত্ব দিইনি। যাই হোক আসল কথায় আসি, বেলার দিকে তারকেশ্বর-হাওড়া গামী ট্রেনের লেডিস কামড়ায় বসে আছি। বেশ ফাঁকা। আমার কিছুটা তফাতে দুই ভদ্রমহিলা জমিয়ে সাংসারিক গল্প শুরু করেছেন— কার শ্বাশুড়ি ভালো কার মন্দ, জা কুটোটি নারেনা লাবলা লবলা লাবলা… হঠাৎ করে সেই মোক্ষম শব্দটি কানে এলো—“জানেন দিদি আমার ভাজ হয়েছে এক জিন্তিরিস মাল। ঘরের কথা কী আর বলবো, জানি ওপর দিকে থুতু ছুঁড়লে নিজের গায়েই পড়ে, তবু বলতেও হয়। আমার ভাইকে এক্কেবারে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছে। বউয়ের মা কি সব তুক গুন করেছে জানি না বাবা! আমার ভায়ের চালের ব্যাবসা, খুব নাম করা দোকান। এখন ক’বছর একটু মন্দা যাচ্ছে তাই! নাহলে… আর ভাজ একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করে! আমার মা বারণ করেছিল, ভাই বললে পেয়েছে যখন ছাড়বে কেন… সকালে উঠে ভাত চাপাবে আমার ভাই, বউয়ের টিফিনটা পর্যন্ত ভরে দেয় জানেন! মহারানী সেই সন্ধ্যে আটটায় ফেরেন।” টানা দশ মিনিট এক মহিলা বলে গেলেন, আর একজন সম্মতি সূচক ঘাড় নেড়ে চললেন। আমিও বেশ রসালো একটা গল্প উপভোগ করলাম।
তবে আমার মনে কটা প্রশ্ন জেগেছে। আচ্ছা যে পুরুষ স্ত্রীর ইচ্ছা ও যোগ্যতার সম্মান করে, সে কি স্ত্রৈণ? কিংবা যে পুরুষ গর্ভবতী স্ত্রীকে কাজে সাহায্য করে, কাজের মধ্যে তোমার আমার ভেদ রেখে না সে স্ত্রৈণ? সংসারের অর্থনৈতিক হাল যদি স্ত্রী নিজের কাঁধে তুলে নেয়, আর স্বামী যদি ঘর সংসার সামলায়
তবে কি সেই পুরুষকে স্ত্রৈণ বলে?
‘যত মত তত পথ’। যত মানুষ তত মত— মতামত আপনারাই দেবেন।
কলমে– অর্যমা