বাবাই আর বাচ্চাটা…
ঢং ! একটার ঘণ্টা শোনা গেলো লেকটাউনের মাঝে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা বড় ঘড়িটায়। শব্দ শুনে বেঞ্চিতে শুয়ে থাকা চাদরটা আর একবার ভালো করে টেনে নিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল বাবাই।ঘড়ির শব্দটায় আজকাল আর ঘুম ভাঙেনা ওর… আসলে, অভ্যাস হয়ে গেছে! ঠিক যেমনটা বেঞ্চিতে শোয়া, কিংবা দু’বেলা আধপেটা খেয়ে কিংবা না খেয়ে থাকাটা ওর অভ্যেস, ঠিক তেমনই…
জন্মের পর থেকেই লেকের ধারের বেঞ্চিটাই ওর আর ওর ভাইয়ের বেডরুম, ড্রয়িংরুম সবকিছু। ওদের বৃষ্টিতে ছাতা বলতে সম্বল গাছের তলা, আর শীতে সহায় ওই তেল চিটচিটে ছেঁড়া কাঁথা!
বাবাই যে লেকের ধারের বেঞ্চিটাতে ঘুমায়, সেই লেকের উল্টোদিকে একটা বড় বাড়ি আছে। বাড়িটার সামনে একটা বড় খোলা বারান্দা, এমনকি একটা গ্যারেজও আছে।
বাবাই দেখেছে গ্যারেজটায় একটা চকচকে সাদা রঙের গাড়ি রাখা থাকে, একটা কাকু রোজ সেটা পরিষ্কার করে মোছে।
ওই বাড়িটাতেও একটা ভাই আছে, বাবাইয়ের ভাইয়েরই বয়সি। বাবাই মনে মনে ওকে রাজপুত্তুর বলে ডাকে, বড়বাড়ির রাজপুত্তুর।
মাঝে মাঝে রাত্তিরে হঠাৎ যখন ঘুম ভেঙে যায় ওর, দেখে ভাইটা পাশে অঘোরে ঘুমাচ্ছে। ভাইয়ের ঘুমন্ত মুখের দিকে চেয়ে ভাবে একদিন সেও অমন বড় বাড়িতে ভাইকে রাখবে, রাজপুত্তুর যেমন বারান্দায় রাখা মস্ত দোলনায় চড়ে রোজ বিকালে, তেমন দোলনায় সে তার ভাইকেও চড়াবে…
নাহ, ও জানে ওর মতো সামান্য এক গ্যারেজ মেকানিকের জন্য এ স্বপ্ন দেখা নিতান্তই পাগলামো ছাড়া কিছু নয়। কারণ, যাদের ঘরে নুন আনতে পান্তা ফুরায়, তাদের ঘরে আর যাই হোক এমন স্বপ্ন দেখা মানায় না!
তবু স্বপ্ন দেখতে বাধা কই…
সেদিনটা ক্রিসমাসের দিন ছিল, ওর ভাইটা কোত্থেকে শুনে এসছে সেদিন নাকি কেক খেতে হয়। তাই সেও বায়না ধরেছে কেক চাই বলে। বাবাই কিছুতে ওকে বোঝাতে পারেনি কেক কেনার সামর্থ্য ওদের নেই।
তাই, কিছুটা নিরুপায় হয়েই সে ঠিক করল মালিকের থেকে ধার চেয়েই ভাইকে কেক খাওয়াবে সে।
এমনটা ঠিক করে সে রাস্তা পেরোচ্ছিল, হঠাৎ দেখতে পেলো সেই রাজপুত্তুর রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে একটা লাল বল কুড়াচ্ছে।
দূর থেকে ছুটে আসা ম্যাটাডোরটাকে দেখে চমকে উঠল বাবাই, মুহূর্তের জন্যে স্থাণু হয়ে পড়লেও সে এক নিমেষে ছুটে গেল বাচ্চাটার দিকে, দুজনেই ফুটপাতে গিয়ে পড়ল টাল সামলাতে না পেরে।
বাবাই তার রাজপুত্তুরের কোনো ক্ষতি হতে দেয়নি, আগলে রেখেছিল দুহাত দিয়ে, তবে তার নিজের বেশ ভালোই লেগেছিল, মাথার কোণ দিয়ে রক্ত গড়াচ্ছিল।
ততক্ষণে ভিড় জড় হয়ে গেছে… বাচ্চাটার বাবা এসে কোলে তুলে নিয়েছেন ওকে। তিনি বাবাইকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে চেয়ে দুহাজারের একটা নোট ধরিয়ে দিতে চাইলেন ওর হাতে কৃতজ্ঞতা স্বরূপ। এতক্ষণে কথা বলল বাবাই—
“কাকু টাকাটা আমি নিতে পারবো না, গরীব হতে পারি… অমানবিক নই! নিজের ভাইয়ের বয়সি একটা বাচ্চার প্রাণ বাঁচানোর দাম আমি নিতে পারবো না।”
এই বলে থেমে গেলো সে। তারপর মাথা নীচু করে অাস্তে আস্তে বলল, “পারলে একটা ছোট কেক দেবেন কাকু আমার ভাইটাকে? ও তো এতকিছু বোঝে না… ও ভালো থাকলেই আমি ভালো থাকি।”
এই বলে বাবাই রাস্তা পেরিয়ে রাস্তার ধারের কলটায় মাথার কোণটা ধুয়ে নিল, তারপর ফিরে গেল নিজের বেঞ্চিটায়।
আর, ওই ভদ্রলোক ওখানেই দাঁড়িয়ে রয়ে গেলেন ছেলে কোলে। আসলে তখন উনি ভাবছিলেন বাবাইদের মত মানুষদের কথা— যাদের মাথার ওপরটায় ছাদ বলতে কেবল খোলা আকাশ, যাদের স্বপ্নগুলো ঝাপসা কাঁচের মতই ভীষণ রকম বাস্তব, আর মনটা ওই আকাশটার মতই বড়।
আদতে, সব বাবাইরাই এমন হয়। ওদের চাহিদারাও ভীষণ অল্প হয়। ওরা দারিদ্রে বাঁচে, তবে মনুষ্যত্ব ভুলে নয়…