বাগানের গপ্পো

— কিরে ঋজু আজ টিফিনে কী এনেছিস?

— রুটি আর আলুর দম এনেছি রে রবি। তুই কী নিয়ে এসেছিস টিফিনে?

— আম এনেছি। আমাদের প্রতিবেশী রঞ্জা কাকিমার বাড়িতে দুটো আম গাছ আছে আর পাড়াতে শুধু আমার মা-এর সাথে ভালো খাতির আছে ওনার। কাউকে নিজের আম গাছের আশেপাশে আসতে দেননা উনি, কিন্তু আমার মা একবার চিলি চিকেন বানিয়ে দিয়ে ছিল ওনাকে আর উনি কন্টিনেন্টাল রেসিপি বানাতে পারেন না তাই জন্যই মা-এর সাথে খাতির ওনার। প্রত্যেক বছর ওনার গাছের আম দিয়ে যান। কাল সন্ধ্যেবেলা উনি এসে পাঁচ ছয়টা আম দিয়ে গেলেন। আর মা সেই আম থেকে আজকে টিফিনে দিয়েছে। আহা! কী মিষ্টি খেতে। তুই ও নে ঋজু।

— না আমার লাগবে না। আমার মামাবাড়ি থেকে ঝুড়ি ঝুড়ি আম আশে। আর প্রত্যেক বছর গরমের ছুটিতে আমি মামার বাড়িতে যাই। আমার দাদুর পাঁচ কাটা জমির বাগান আছে। সেখানে দশটা আম গাছ আছে, পাঁচটা পেয়ারা গাছ আছে, দুটি জাম গাছ আছে, আর তিনটে নারকেল গাছ, আর দুটো কাঁঠাল গাছ আছে। তোর রঞ্জা কাকিমার বাড়িতে তো মাত্র দুটি আম গাছ। আমাদের অনেক আম গাছ আছে আর আমি তো নিজেদের গাছের আম খেতে পাই। এই বছর তো গরমের ছুটি পড়লেই মামাবাড়ি যাবো আর শুধু আম খাবো। শুধু কী তাই বিশাল দিঘি আছে হরেক রকম মাছ পাওয়া যায়। আমি আর দাদু একসাথে মাছ ধরতে যাই। তুই আর কী করে বুঝবি, বুঝতে হলে আমাদের গ্রামে যেতে হবে।

ঋজুর কথাগুলো শুনে রবির মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল।

রবি কখনো গ্রাম দেখিনি। ঋজুর মতো ওর মামাবাড়ি গ্রামে নয়, শহর কলকাতা তেই। এতো দিন বছর তেরোর রবির ওর রঞ্জা কাকিমার দেওয়া গাছের আমে মন ভরে যেত। কিন্তু ঋজুর মামাবাড়ির বিশাল বাগানের কথা শুনে ওর আর এইটুকু তে মন ভরছে না।

সেদিন স্কুল থেকে রবি বাড়ি ফিরে মুখ শুকনো করে বসে আছে দেখে লতা চিন্তায় পড়ে যায়। নিজের ছেলেকে এতো শান্ত হয়ে বসে থাকতে কোনোদিন দেখেনি সে। সারাদিন দৌরাত্ব আর হুল্লোড় করে রবি। ছেলের মন খারাপের কারণ কিছু তেই বুঝতে পারছেন লতা। রবির পছন্দের নুডলস আর শেচুয়ান চিকেন বানিয়ে দেয় লতা, তাতেও রবির মুখের থেকে মেঘ সরে না। রাতে ঘুমতে যাওয়ার আগে লতার কাছে আবদার করে।

— মা, এবারের গরমের ছুটিতে একটি জায়গায় বেড়াতে যাবে?

— কোথায় বেড়াতে যাওয়ার কথা বলছিস রবি?

— নদিয়ার কৃষ্ণনগর ইটাবাড়িয়া ঋজুর মামাবাড়ি, বলো না মা যাবে?

ছেলে অনেক বড়ো মুখ করে আবদার করেছে। তাছাড়া ঋজু তো কখনো গ্রামাঞ্চলে বেড়াতে যায় নি– এই সব কিছু ভেবে সম্মতি দেয় লতা।

মা-এর থেকে অনুমতি পাওয়ার পর এক রাস হাসি ফুটে উঠলো রবির মুখে।

পরের দিন সকালে লতা ঋজুর মা কে ফোন করে বলে, “হ্যালো নন্দিনী, আসলে আমার ছেলের তোমাদের গ্রাম দেখার খুব ইচ্ছা হয়েছে। আর তাছাড়া কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজবাড়ি আর ঘূর্ণির হাতের তৈরি মাটির পুতুল এই সব দেখার আমার ও অনেক দিন থেকে শখ ছিল। তোমরা স্কুলে গরমের ছুটি পড়লেই তো গ্রামের বাড়ি যাও, তা এই বছর যদি তোমাদের সাথে যেতে…”

— লতা, এতো খুব ভালো কথা, আমাদের গ্রামের বাড়িতে থেকে সব ঘুরিয়ে দেখাবো তোমাদের।

দুদিন পর স্কুলের ছুটি পড়তেই দুই পরিবার একসাথে রওনা দিল কৃষ্ণনগরের উদ্দেশ্যে। ঋজুর মামাবাড়ি যেতে চাওয়ার আসল কারণ রবি জানায় নি কাউকে, তবে মনে মনে তার আনন্দের বাঁধ ভেঙেছে। ট্রেনে বসে লতা আর নন্দিনী গল্পে মত্ত। ট্রেন থামলো কৃষ্ণনগরে। নন্দিনী লতা আর রবি কে নিয়ে নিজেদের বাড়িতে উপস্থিত হয়, দোতলা বাড়ি, সামনে একটা উঠান আছে। ঋজুর দিদা অথিতি আপ্যায়নের কোনো ত্রুটি রাখেন নি। আসতেই লেবু চিনির সরবত আর গরমের রসালো ফলের থালা সাজিয়ে পরিবেশন করেন লতা আর রবি কে। ফলের মধ্যে আম, জাম, লিচু, কাঁঠাল সব ছিলো। লতা একটু ইতস্তত হয়ে বলে, “আহা, মাসিমা এতো ব্যস্ত হবেন না দয়া করে আর এতো সব আয়োজনের কী দরকার ছিল।”

আর ওদিকে ঋজু রবিকে কানে কানে বলে, “এই গুলো সব আমাদের বাগানের ফল, ভালো করে খায়ে নে।”

রবি বলে “আমাকে তোদের বাগান দেখাবি তো ঋজু।? ”

— দেখাবো তবে কাউকে বললে চলবে না।

রবি তাতেই রাজি হয়ে যায়। দুপুরে মধ্যাহ্ন ভোজনের পর সবাই যখন বিশ্রাম নিচ্ছে ঋজু রবিকে নিয়ে ওদের বাগান দেখাতে নিয়ে যায়। ওদের বাড়ি থেকে পাঁচ মিনিটের রাস্তা হেঁটে বাগানে পৌঁছায় দুজনে।

বাগানে ঢুকে রবি অবাক হয়ে যায়, গাছপাকা আম কাঁঠালের গন্ধে ভরে গেছে চারিপাশ। গাছের ছায়ায় সূর্যের প্রখর তাপ ম্লান হয়ে গেছে। রবি মুগ্ধ হয়ে ঘুরে ঘুরে আপন মনে বাগান দেখছে। প্রকৃতির এই রকম অপূর্ব সুন্দর রূপ রবি শহরে দেখেনি। পাকা ফলের ঘ্রাণের আস্বাদ নিচ্ছে রবি আবার কখনো ঢিল ছুড়ে ফল হাতে পাওয়ার চেষ্টা করছে। রবি যেনো এক অন্য জগতে বিচরণ করছে।

এক কর্কশ কন্ঠস্বর শুনে সম্বিত ফিরলো রবির। একজন ছিপছিপে চেহারার ভদ্রলোক, পড়নে ধুতি, কাঁধে গামছা আর হাতে একটা লাঠি; রাগান্বিত দৃষ্টিতে তেড়ে আসে রবির দিকে। রবি ভয়ে পেয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

— ও ছেলে এখানে কী করতে ঢুকেছিস? ফল চুরি করতে এসেছিস?

— না না চুড়ি করতে যাবো কেনো, এটা আমার বন্ধুর বাগান তাই ঘুরতে এসেছি।

— তোর বন্ধু আবার কে? এতো মল্লিক বাড়ির বাগান আর আমি বাগানের মালী। ছেলে, আর যদি তোকে বাগানের আশেপাশে দেখেছি লাঠি দিয়ে ঠ্যাং খোড়া করে দেবো। পালা এখন তাড়াতাড়ি।

মালীর কাছে বকা খেয়ে এক ছুটে বাগান থেকে বেড়িয়ে আসে রবি। বেড়িয়ে দেখে ঋজু দাঁড়িয়ে হাসছে।

— কী রে রবি মালী কাকার কাছে বকা খেয়ে কেমন লাগলো তোর।

— এই বাগান তোর দাদুর নয়। শেষে তুই আমায় ঢপ দিলি ঋজু? আমি স্কুলের সবাই কে বলে দেবো যে তুই ঢপ দিস। তোর সাথে আড়ি আমার, বলবো না কথা আর।

সমাপ্ত

Facebook Comments Box
Ditipriya Pal

A foodie, in love with pen and paper, above that loves being lethargic.

Recent Posts

SVF Music Unveils April Edition of “Banglar Gaan Indies”

Following the resounding success of the inaugural edition, SVF Musicproudly announces the arrival of the…

4 months ago

Mimi Chakraborty and Nabila to Star Alongside Shakib Khan in ‘Toofan’

Amidst ongoing speculations regarding the leading lady opposite Shakib Khan in the upcoming film 'Toofan',…

5 months ago

Why Does a Rich Chicago Law Firm Keep Suing Indian Tribes?

This article originally appeared in DC Journal: https://dcjournal.com/why-does-a-rich-chicago-law-firm-keep-suing-indian-tribes/ Why does a deep-pockets Chicago law firm keep…

9 months ago

Anupam Roy’s ‘Aami Sei Manushta Aar Nei’ is a Musical Masterpiece

In a spectacular celebration coinciding with the birthday of the iconic actor Prosenjit Chatterjee, the…

10 months ago

অনুষ্কা পাত্রর কণ্ঠে শোনা যাবে দে দে পাল তুলে দে

হিমেশ রেশামিয়ার পর সুরাশা মেলোডিজ থেকে অনুষ্কা পাত্রর নতুন গান পুজো আসছে মানেই বাঙালির নতুন…

10 months ago

Srijit Mukherji’s Dawshom Awbotaar is On a Roller Coaster!

The highly awaited trailer of grand Puja release, "Dawshom Awbotaar", produced by Jio Studios and…

10 months ago