বারো বছর ধরে প্রভূত অর্থ খরচ করে বারোশো কারিগর তৈরি করল যে সূর্য মন্দির, পুজো হল না সেই মন্দিরে! ত্রয়োদশ শতাব্দীতে গঙ্গা রাজবংশের রাজা নরসিংহদেব তৈরি করেন এই মন্দির। প্রধান কারিগর বিশু মহারাণার নেতৃত্বে বারোশো কারিগর এই মন্দির তৈরি করতে থাকে। বারো বছরের মধ্যে এই মন্দির তৈরি করতে না পারলে প্রাণ যাবে বারোশো কারিগরের। বিশু মহারাণা যখন মন্দির নির্মাণের জন্য বাড়ি ছেড়ে আসেন তখন তাঁর পত্নী ছিলেন গর্ভবতী। তিনি চলে আসার প্রায় একমাস পরে তাঁর একটি ছেলে হল। তাঁর নাম ধর্মপদ মহারাণা। এই ছেলের যখন বয়স হল বারো বছর, সে একদিন তার মায়ের কাছে বাবার সাথে দেখা করতে আসার ইচ্ছাপ্রকাশ করল।

ধর্মপদ তার বাবার সাথে দেখা করতে এসে জানতে পারল মন্দিরের দধিনৌতি অর্থাৎ মন্দিরের চূড়ার কলস কিছুতেই মন্দিরের মাথায় স্থাপন করা যাচ্ছে না। সেই কাজ সম্পন্ন না হলে মন্দির নির্মাণ অসম্পূর্ণই থেকে যাবে। অথচ, হাতে তখন আর সময় আছে মাত্র একদিন। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে না পারলে প্রাণ যাবে বারোশো কারিগরের।

ধর্মপদ, সেই বারো বছরের ছেলেটা বাড়িতে থাকাকালীন মন্দির নির্মাণ কৌশল অধ্যয়ন করে। বারোশো কারিগর যা পারল না, একটি বারো বছরের ছেলে তা করে দেখাল। সুদক্ষ কারিগরি নিপুণতায় স্থাপন করল মন্দিরের দধিনৌতি।

মন্দির তো তৈরি হল যথাসময়ে। কিন্তু, এদিকে যে কারিগরের সংখ্যা বারোশো থাকল না। বারোশোর জায়গায় হয়ে গেল বারোশো এক। মহারাজ যদি জানতে পারেন তাহলে প্রাণ যাবে বারোশো কারিগরের। তাই সেই বারো বছরের ছেলেটা মন্দিরের চূড়া থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করল সবাইকে বাঁচানোর জন্য। অকালে ঝরে গেল এক সম্ভাবনাময় শিল্পীর জীবন। অাত্মহত্যার কলঙ্কের দাগ লাগলো মন্দিরের গায়ে। তাই সেই মন্দিরে কোনোদিন পূজা হল না। এত খরচ করে, এত পরিশ্রমে, এত নিপুণতায় যে অপরূপ সুন্দর শিল্পসুষমা-মন্ডিত মন্দির তৈরি হল। সেই মন্দিরের দেবতা কোনোদিন পেলেন না পূজার অর্ঘ্য।
চন্দ্রভাগা নদী ও সমুদ্রের সঙ্গমস্থলে অবস্থিত এই মন্দিরের নাম কোণার্ক সূর্যমন্দির। কোণ+অর্ক=কোণার্ক, অর্ক মানে সূর্য।

পুরাণ অনুসারে নারদমুনির প্ররোচনায় কৃষ্ণপুত্র শাম্ব কৃষ্ণকে স্ত্রীদের সাথে আপত্তিজনক অবস্থায় দেখে ফেললে, কৃষ্ণ ক্রূদ্ধ হয়ে পুত্র শাম্বকে অভিশাপ দেন কুষ্ঠরোগগ্রস্ত হওয়ার। চন্দ্রভাগা ও সমুদ্রের সঙ্গমস্থলে সূর্যদেবের তপস্যা করে রোগমুক্তি ঘটে শাম্বর। জায়গাটি পবিত্র বলে পরিগণিত হয়। রোগমুক্তির পরে শাম্ব মিত্রবনে সূর্যমন্দির নির্মাণ করেন।

মুসলিম আক্রমণ, কালাপাহাড়ের আক্রমণ, প্রাকৃতিক কারণ, কালের অমোঘ গতি ইত্যাদি কারণে এই মন্দির ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। জায়গাটি জঙ্গলাকীর্ণ হয়ে পড়ে। দিনের বেলাতেও যাওয়া দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে।

পরবর্তীকালে ওই তীরের কাছাকাছি সমুদ্রের উপর দিয়ে কোনো জাহাজ গেলেই অদৃশ্য কোনো এক শক্তির টানে জাহাজ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তীরবর্তী অঞ্চলে আঘাত করে ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরে কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে হদিশ পাওয়া গেল অপূর্ব কারুকার্য খচিত একটি মন্দিরের। যার চূড়ায় বাহান্ন টনের একটি শক্তিশালী চুম্বক। জাহাজগুলির এই দশা হয় ওই চুম্বকের জন্য। পর্তুগীজরা ওই চুম্বক খুলে নেওয়ার জন্য ভারসাম্যহীন হয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় দেউল।

মন্দিরের ছিল তিনটি অংশ। দেউল, জগমোহন ও নাটমন্দির। দেউল ধ্বংস হয় পুরোপুরি। খাণ্ডোলাইট ও গ্রানাইট পাথরে তৈরি ছিল মন্দিরটি তাই নাবিকদের কাছে এর নাম ব্ল্যাকপ্যাগোডা। পুরীর মন্দির হোয়াইট প্যাগোডা। ইউনেস্কো ১৯৮৪ সালে ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’ হিসেবে ঘোষণা করে এই মন্দিরটিকে।

এটাও পড়ুন – দেওয়ালি পুতুলের ঐতিহ্য আর পশ্চিম মেদিনীপুর

পুরী থেকে ৩৫ কিমি উত্তর-পূর্বে উড়িষ্যা উপকূলে অবস্থিত এই মন্দিরের প্রবেশপথে বিশালকায় সিংহ, তলায় পিষ্ট রণহস্তী, হস্তীর নীচে মানুষ। সিংহ হিন্দু ধর্মের প্রতীক, হস্তী বৌদ্ধধর্মের। মন্দিরটি কলিঙ্গ আর্কিটেকচার স্টাইলে তৈরি। এটি একটি বিশাল রথ। সাতটি ঘোড়া সাত রং এর প্রতীক।
রথের ২৪টি চাকা এক-একটি সূর্যঘড়ি। মন্দিরের গায়ে কামসূত্রের বিভিন্ন ভঙ্গিমা, বিভিন্ন দৈবিক ও আধা-দৈবিক মূর্তি পরিস্ফুটিত। পাথরের ভাষা যেন সত্যিই মানুষের ভাষার চেয়ে অধিক বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে।

Facebook Comments Box

By Staff Writer

Editorial Team of LaughaLaughi

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *