LaughaLaughi

You Create, We Nurture

Historical Facts

‘শ্যাম তেরি বনশী পুকারে রাধা নাম, লোগ করে মীরা কো য়ুহি বদনাম’

মধ্যযুগের ভক্তি আন্দোলনের ইতিহাসে শিশোদীয় রাজপরিবারের বধূ মীরাবাঈ উল্লেখযোগ্য নাম। ভক্তিবাদ আন্দোলনের মূল কথা হল আত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলন। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ ভক্তিবাদের কথা বলেছেন। জ্ঞান, ভক্তি ও কর্ম, এই তিনটি পথের যে কোনো একটি দ্বারাই মুক্তিলাভ সম্ভব।

মীরা ভক্তি আন্দোলনের অন্য সন্তদের থেকে অনেক আলাদা। চিতোরেশ্বরী মীরা, রানা কুম্ভের পত্নী। অন্যান্য রাজপুত নারীদের মত সে মানেনি সমাজবিধান। সব ভুলে সে নেমে এসেছে পথে, রানী হওয়া সত্ত্বেও কৃষ্ণপ্রেমে বিভোর হয়ে যোগীনীর জীবন যাপন করেছে।

ষোড়শ শতাব্দীতে রাজস্থানের কুড়কিতে রতনসিংহের ঘরে মীরার জন্ম হয়। মীরার যখন মাত্র চার বছর বয়স, একদিন এক বরযাত্রীর দল যাচ্ছে তার সামনে দিয়ে। তাদের মধ্যে সেজেগুজে বসে আছে বর-বৌ। মীরা তার মাকে বলল, “মা, আমার বর কই?” মীরার মা ঘর থেকে সুন্দর করে সাজানো কৃষ্ণ ঠাকুর তার হাতে দিয়ে বললেন, “এই নে তোর বর”। শৈশবের সেই সামান্য কথা মীরা কিন্তু সামান্য ভাবে নেয়নি। সেই কথায় সারাজীবন তার জীবনের মূলমন্ত্র হয়েছিল।

রাজপুতানার ইতিহাস জানা যায় চারণকবিদের গানে, লোকমুখে প্রচলিত বিভিন্ন কাহিনির মাধ্যমে। লোকের মুখে ঘুরে বেড়ানো এইসব কাহিনি সংগ্রহ করে জেমস টড লিখলেন ‘অ্যানালস অ্যান্ড অ্যানটিকুইটিস অফ রাজস্থান’। যা থেকে জানা যায় রাজস্থানের ইতিহাস। তবে লোকমুখে প্রচলিত কাহিনির মধ্যে কতটা সত্যতা আছে তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।

রানা কুম্ভের সাথে বিবাহ হলেও মীরার মনপ্রাণ রণছোড়জির পায়ে সমর্পিত। তিনিই তার পতি। জাগতিক বিবাহ তাদের নাই বা ঘটল। রানী হয়েও মীরা পথে ঘাটে সাধারণ মানুষের মত নেচে-গেয়ে বেড়ান, ভক্তদের মধ্যে বসে গাইতে শুরু করেন, ‘মীরা কহে বিনা প্রেমসে না মিলে নন্দলালা’। এটা রানা মানতে পারলেন না। মীরার জন্য তিনি মন্দির ঘিরে দিলেন। সেই মন্দিরে নিষিদ্ধ হল সাধারণ মানুষের যাতায়াত। মীরা সেখানে সারাদিন বসে কৃষ্ণভজন গান, ভক্তরা বাইরে থেকে শোনে। এক পূর্ণিমার রাতে মন্দিরে মীরা স্বর্গের অপ্সরীর মত নাচছেন, গাইছেন। রানা বীণা বাজাচ্ছেন। ভক্তরা বিভোর হয়ে তা শুনছে। জোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে চারদিক। এমন সময় মন্দিরের বাইরের থেকে কে যেন বহুমূল্য হীরের হার ছুঁড়ে দিল! কেউ বলল বাদশা স্বয়ং! অনেকে বিশ্বাস করল না। সেই হার সোজা মীরার গলায় এসে পড়ল। মীরা সেই হার নিজের গলা থেকে খুলে রণছোড়জিকে পরিয়ে দিলেন। মীরা যে হারটা রানাকে না দিয়ে শ্রীকৃষ্ণকে অর্পণ করলেন, লোকজন খুব খুশি হল তাতে আর রানা গেলেন রেগে।

চিতোর দুর্গে মীরার কৃষ্ণ-মন্দির

এটাও পড়তে পারেন সাতগাছিয়ার রাজা(পর্ব-১)

মীরার মন্দিরে যাওয়া বন্ধ করে দিলেন রানা। আটকে রাখলেন অন্তঃপুরে। মীরা অন্দরে বসে কেবলই শুনতে পান নন্দলালার ডাক, আর কাঁদেন, আর বলেন, “রানা আমাকে আটকে রেখো না, আমাকে ছেড়ে দাও, আমি যে তার দাসী”। রানা রেগে তাকে বের করে দিলেন প্রাসাদ থেকে।

রানা কুম্ভের মৃত্যুর পর মীরা সহমরণে গেলেন না অন্য রাজপুতরানীদের মত। তিনি বললেন, “আমার পতি শ্রীকৃষ্ণ”। রানার মৃত্যুর পর তার আত্মীয়রা অত্যাচার শুরু করল মীরার উপর। কখনো বিষ খাইয়ে, কখনো ফুলের ঝাঁপিতে সাপ পাঠিয়ে তাঁকে মারার চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু, সাপ পরিণত হল ফুলে। বিষ খেয়েও কিছু হল না তাঁর।

শোনা যায়, তুলসী দাসের সঙ্গে তার পত্রমারফৎ যোগাযোগ ছিল। তুলসীদাসের অনুরোধে তিনি রামচন্দ্রকে নিয়ে ভজন লিখলেন “পায়োজি ম্যায়নে রামরতন ধন পায়ো”। মীরা শ্রীকৃষ্ণকে নিয়ে প্রচুর ভজন রচনা করেন। তবে এগুলোর মধ্যে কোনগুলি সত্যিই মীরাবাঈ রচিত, তা সঠিকভাবে জানা যায় না, সেগুলো নিয়ে মতভেদও আছে।

মীরার গুরু ছিলেন রবিদাস। যিনি তৎকালীন সমাজে অস্পৃশ্য চর্মকার বংশজাত। শোনা যায় মীরাবাঈ তুলসীদাসকে গুরু হিসেবে মর্যাদা দেন। জনশ্রুতি আছে স্বয়ং আকবর নাকি তানসেনকে নিয়ে ছদ্মবেশে মীরার গান শুনতে আসেন ও একটি বহুমূল্য রত্নহার উপহার দেন। মীরা তা গ্রহণ করেন। রাজপুতকূলের বধূ হয়ে চিরশত্রু বিধর্মী মুঘলের থেকে এই উপহার গ্রহণ ভালোভাবে মেনে নিতে পারেনি তাঁর শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়রা।

বিধবা হওয়ার পর মীরা বৃন্দাবনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। সেখানে তিনি এক জনৈক মহারাজের সঙ্গে দেখা করতে যান। মহারাজ নারীদের সাথে দেখা করেন না। তিনি না করে দিলেন। মীরা মুচকি হেসে বলেন, “আমি তো জানতাম বৃন্দাবনে একজনই পুরুষ”। কথাটা শুনতে পেয়ে মহারাজ নিজের ভুল বুঝতে পেরে ছুটে এসে ক্ষমা চেয়ে নিলেন তাঁর কাছে।

এরপর মীরা যান দ্বারকায়। এখানেই তাঁর জীবনাবসান হয়। মীরাবাঈ এর মৃত্যু কীভাবে হয় তা সঠিকভাবে জানা যায় না। এ নিয়ে বিভিন্ন জনশ্রুতি প্রচলিত আছে। শোনা যায় কৃষ্ণপ্রেমে ভাব-বিহ্বল অবস্থায় তিনি শ্রীকৃষ্ণে বিলীন হয়ে গেছেন।

যে যুগে রাজপুতরমণীরা পর্দানসীন ছিলেন। স্বামী মারা গেলে সহমৃতা হতেন। পালন করতেন জহরব্রত। সে যুগে জন্মে মীরাবাঈ নারীমুক্তি ও চেতনার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।

Facebook Comments Box

LEAVE A RESPONSE

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Editorial Team of LaughaLaughi