সময় যখন গোটা পৃথিবীকে বশ করেছে,
চারিদিকে যখন মহামারির থাবা ঘিরে ফেলেছে সমাজকে,
আমি তখন সপ্তাহের শেষ দিনে শহরের পুরোনো বাড়িতে বসে গভীর চিন্তায় আচ্ছন্ন।
বেসরকারী চাকুরী জীবনে আমার ভবিষ্যতের সঞ্চয়ের ভান্ডারটা যেন অনেকটাই কমিয়ে দিল এই মহামারি।
মস্ত ফ্ল্যাট কেনার ইচ্ছেটা একটু পিছিয়ে গেল।
ইতিমধ্যেই কাজের মাসিকে ছাড়িয়ে দিয়েছি,
বলেছি,
” তুমি বরং কয়েকমাস বন্ধ করো,
এবং দেখো আবার এই কয় মাসের মাইনে চেয়ে বসো না
অফিস বন্ধতে আমার এমনিতেই অনেক ক্ষতি। ”

এখন দিব্যি আছি বেশ। নিজেই রাঁধুনী হয়ে উঠেছি,
প্রতিদিন নতুন নতুন রান্না আর নিয়ম করে ফেসবুকে ছবি আপলোড।
তবে ইদানীং গরমটা বড্ড বেড়েছে,
অফিসটা বন্ধ না হলে এইবার বোধহয় ঠান্ডার মেশিন কিনেই ফেলতাম।
সন্ধ্যায় সদ্য কেনা টিভিটা চালিয়ে যেই বসেছি অমনি চোখে পড়ল ঝড়ের খবর।
মনটা আনন্দে নেচে উঠল
যাক! এই গরম থেকে অন্তত কয়দিন নিস্তার পাওয়া যাবে।
সবার দেখাদেখি সোশ্যাল মিডিয়ায় দিয়েই দিলাম সর্তকবার্তার কয়েকটা পোষ্ট।
পরদিন বিকেলে যখন ঘুম ভাঙল আকাশ জুড়ে তখন ঘন কালো মেঘ এবং তার সাথে জোরালো বৃষ্টি,

গরম কফি নিয়ে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালাম।       পাশের বস্তিতে সেই সময় সবার কি ছোটাছুটি। ঝড়ে ওদের ছাদ উড়িয়ে নিয়ে গেছে তাই সবাই আশ্রয়ের খোঁজে।
কারো কারো মুখে ভয়ের ছাপ, কারো আবার খিদে তো মুখ শুকনো পাতার মতো।
কিন্ত আমার মুখে তখনো পাশের ফ্ল্যাটের দম্পতির বিবাহবার্ষিকীর দুপুরের ভোজের স্বাদ স্পষ্ট লেগে রয়েছে। মূহুর্তেই মনে হল বস্তির লোকেরা যদি আবার এই সময় আমার কাছে আশ্রয় চাই তখন আর এক বিপদ,
খেতে দাও, ঘুমোতে দাও আরও কত কিছু।
এই তো গেল বন্যায় মাঝরাতে রতনের মা এসে হাজির,
তার নাকি আশ্রয় চায়, সে কি মহাঝামেলা!
ত্রাণ শিবিরে গেলে তো পারে।
তাই এইবার রুমে ঢুকে দরজাটা তাড়াতাড়ি লাগিয়ে দিলাম।
রাতের ঠান্ডা বাতাসে নতুন কেনা ফ্ল্যাটে প্রেমিকার সাথে সংসারের স্বপ্নে বিভোর হয়ে পাড়ি দিলাম ঘুমের দেশে।

রাত পেরিয়ে ভোর হয়েছে, ঝড় থেমেছে, লোডশেডিং, ফোনে চার্জ শেষ।সময় কাটছে না একদম। এখনো ফেসবুকে কতগুলো ভিডিও আপলোড করা বাকি। কাল ঝড়ের সময় ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সবগুলো রের্কড করেছি।
ধৈর্যহীন হয়ে বেরিয়ে পড়লাম ছাতা নিয়ে কারেন্ট অফিসের উদ্দেশ্যে। প্রচন্ড চিৎকার, চেঁচামেচিতে ওদের দায়িত্ব বুঝিয়ে এক গলা জল ঠেলে যখন ফিরছি ঠিক সেই সময় রতন এসে খবর দিল আমার বসবাসের পুরোনো বাড়িটা নাকি এইমাত্র ভেঙে জলের তলায় তলিয়ে গেছে।

মুহুর্তেই যেন আকাশ ভেঙে পড়ল মাথায়। বাড়ির সাথে তলিয়ে গেছে আমার স্বপ্ন, আমার ফ্ল্যাট কেনার কুড়ি লক্ষ টাকা, আমার ভবিষ্যতের সমস্ত সঞ্চয়।

তারপর বস্তির আর পাঁচজন মানুষের মতোই আমিও এখন ত্রাণশিবিরে।
রাতের ঠান্ডা বাতাসে জড়িয়ে ধরেছি রতনদের ছেঁড়া কম্বল।
চোখ বন্ধ করলেই ভেসে আসছে বস্তির মানুষদের মুখ। ওরা যেন জাগিয়ে তুলছে আমার মানবিকতা,
এবং চিনিয়ে দিচ্ছে অমানুষদের দলে আমার স্থানটা।

এই একটা দুর্যোগ যেন সাথে নিয়ে গেছে
আমার সমস্ত আভিজাত্য এবং সঞ্চয়,
জলেতে তলিয়ে গেছে আমার সমস্ত অহংকার।
তাই বস্তির আর পাঁচজন রতন, হাবলুদের মতোই আজ আমার বেঁচে থাকা,
প্রকৃতির সাথে লড়াই করে এবং নিজের সাথে লড়াই করে
সময়ের খেলাতে আমি কেবল খেলোয়াড় মাত্র।

Facebook Comments Box

By Staff Writer

Editorial Team of LaughaLaughi

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *