কোচবিহার মদনমোহন মন্দির ও রাসমেলা

উত্তরবঙ্গের একটা ছোট্ট জেলা হল কোচবিহার, আর এই জেলার প্রসঙ্গ উঠতেই যে নামগুলো সবার আগে মনে হয় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল মদনমোহন মন্দির। এমনিতেই ‘বারো মাসে তেরো পার্বন’ উদযাপন করার বদনাম বাঙালির চিরকালের সঙ্গী। তার ওপর যদি আনুসাঙ্গিক কোন মেলা বা আনন্দোৎসব হয়, তবে তো কোনও কথাই নেই। স্থান-কাল-পাত্র ভেদে বাঙালির উৎসবেরও রকমফের আছে! তেমনই এক বহু চর্চিত উৎসব হল কোচবিহারের মদনমোহন বাড়ির রাস উৎসব। এই রাস উৎসব কেবলমাত্র উত্তরবঙ্গেই নয়, বরঞ্চ সমগ্র দেশে এবং দেশের বাইরেও পরিচিত।

এই রাস উৎসব সম্পর্কে বলতে গেলে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে কয়েক শতক আগে। শোনা যায় যে কোচবিহারের দ্বিতীয় মহারাজা বিক্রমাদিত্য নর নারায়ণ অসমের বৈষ্ণব ধর্মগুরু শ্রীমন্ত শঙ্করদেবের নির্দেশানুসারে বংশীধারীর অষ্টধাতুর বিগ্রহ তৈরী করিয়েছিলেন। এরপর পন্ডিত অনন্ত কন্দলির সহায়তায় মাঘ মাসের উত্তরায়ণ সংক্রান্তির পূর্ণিমা তিথিতে মহারাজা সেই বিগ্রহের প্রতিষ্ঠা সম্পন্ন করেন। পরবর্তীকালে অবশ্য সেই বিগ্রহটি চুরি হয়ে যায়। এবং নতুন করে একটি অষ্টধাতুর বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করা হয়।

প্রাথমিক ভাবে এই বিগ্রহের বেশ কিছু নাম ছিল, যেমন ‘বংশীধারী’ বা ‘লক্ষ্মীনারায়ণ’ বা ‘শ্রী শ্রী মদনমোহন’। কিন্তু এই নাম নিয়েও তৎকালীন ভক্তমহলে দ্বিমত দেখা দেয়। শঙ্করদেবের মতাদর্শ অনুসরণকারী বৈষ্ণবদের মতে ‘শ্রীকৃষ্ণের সাথে রাধা রাণী পূজিতা হন না’, তাই একক ত্রিভঙ্গমুরারী রূপে পূজো করা শুরু হয়েছিল শ্রীকৃষ্ণের। কিন্তু ক্রমশ কালের প্রবাহে ধুয়ে যায় সমস্ত রকমের দ্বন্দ্ব, কোচবিহারের সমস্ত মানুষ শ্রী শ্রী মদনমোহন দেব নামেই পুজো করতে শুরু করেন ‘বংশীধারী’কে।

জানা যায় যে পরবর্তীতে মহারাজা হরেন্দ্রনারায়ণ ভূপের আমলে, রাজধানী কোচবিহারে বিভিন্ন ভৌতিক ঘটনা ঘটতে শুরু করে। এই সমস্ত ঘটনার জন্য মহারাজা নিজের রাজধানী স্থানান্তরিত করেন ভেটাগুড়িতে। সম্ভবত ১৮১২ খ্রিস্টাব্দের অগ্রহায়ণ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে মানসাই নদী পেরিয়ে নিজের নতুন রাজধানীতে গৃহপ্রবেশ করেন মহারাজা হরেন্দ্রনারায়ণ। এবং সেদিনই সেখানে গৃহদেবতা শ্রী শ্রী মদনমোহনের রাসমেলার সূচনা করেন। সম্ভবত তখন থেকেই এই স্থানান্তরের প্রথা শুরু হয়েছিল। এরপর থেকে যখনই কোচ রাজারা নিজেদের রাজধানী স্থানান্তরিত করতেন, তখনই তাদের গৃহদেবতা শ্রী শ্রী মদনমোহন ঠাকুরেরও স্থান পরিবর্তন হত।

যতদূর জানা যায় যে ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে হরেন্দ্রনারায়ণের প্রপৌত্র মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণের রাজত্বকালে, কোচবিহারের বৈরাগী দীঘির পাড়ে বর্তমান চারচালা আকৃতির মদনমোহন মন্দিরটি তৈরির কাজ সম্পন্ন হয়। ওই বছরেরই একুশে মার্চ নবনির্মিত মন্দিরে রাজপরিবারের কূলদেবতার বিগ্রহ সহ অন্যান্য দেবদেবীর বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। মন্দিরের মোট পাঁচটি কক্ষ রয়েছে। একেক কক্ষে একেক দেবীর বিগ্রহ। পূর্ব প্রান্তে জয়তারা। পশ্চিম প্রান্তে কালী বিগ্রহ। আরেক পাশে ভবানী বিগ্রহ। অন্য দিকে নাটমন্দির। নাটমন্দিরে দুর্গাপুজো হয়। মন্দির স্থাপিত হওয়ার পর থেকেই মন্দির সংলগ্ন এলাকায় রাস পূর্ণিমার দিন থেকে মেলার প্রচলন হয় যা কিনা আজ পর্যন্ত চলে আসছে। তবে মাঝের এই দীর্ঘ সময়ে এই মেলা সম্পর্কিত নানান রকম ঘটনার সাক্ষ্য বহন করতে হয়েছে কোচবিহার শহরকে।

সময়টা ১৯১২ খ্রিস্টাব্দ, কোচবিহারে সেসময় কলেরা রীতিমত মহামারী আকার ধারণ করে। তখন বৈরাগী দীঘির জলকে দূষণ মুক্ত রাখার জন্য রাজ আদেশে মেলাকে প্যারেড গ্রাউন্ডে সরিয়ে নেওয়া হয়। এছাড়াও একটা সময় ছিল যখন এই রাস মেলাতে এসে জুয়ার নেশায় পড়ে আশেপাশের গ্রামের মানুষগুলোকে রীতিমত সর্বশান্ত হয়ে ফিরতে হত। সম্ভবত ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন মহারাজা জিতেন্দ্র নারায়ণ ভূপবাহাদুরের নির্দেশে কড়া ব্যবস্থা নিয়ে এই সমস্ত জুয়ার আড্ডা বন্ধ করে দেওয়া হয়।

এরপর ধীরে ধীরে বৈদ্যুতিক আলোর প্রচলন হয়, মেলার জৌলুসও বাড়তে শুরু করে। রাজ পরিবারের শাসনকালে সাধারণত রাজারাই নিয়ম করে রাসচক্র ঘুরিয়ে, মদনমোহন ঠাকুর সহ সমস্ত বিগ্রহকে প্রণাম করে মেলার উদ্বোধন করতেন। প্রণামি দিতেন চোদ্দ টাকা। ১৯৬৯ সাল অর্থাৎ শেষ স্বাধীন মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণের সময় পর্যন্ত এই নিয়মেই চলছিল রাসমেলার উদ্বোধন। তবে পরবর্তী সময় কালের নিয়মে সমস্তটাই বদলে যায়। রাসমেলা উদ্বোধনের দায়িত্ব গিয়ে পড়ে কোচবিহারের জেলাশাসকের ওপর।

রাজ আমলে রাজারা যজ্ঞে বসতেন কিনা জানা যায়নি। কিন্তু পরবর্তী সময় থেকে দেবোত্তর ট্রাস্টের সভাপতি হওয়ার সূত্রে কোচবিহারের জেলাশাসকরাই প্রতি বছর পুজো, যজ্ঞ, ও উদ্বোধন করে আসছেন। রাসমেলা এখন শ্রী শ্রী মদনমোহন বাড়ি থেকে শুরু করে, জেনকিন্স স্কুল সংলগ্ন রাস্তা ও সামনের রাসমেলার মাঠ পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকা জুড়ে হয়। এই মেলার বিবরণ দেওয়ার আগে রাস উৎসব সম্পর্কে কিছু কথা জানিয়ে রাখা জরুরি। মদনমোহন ঠাকুর ছাড়াও কোচবিহারের এই রাস উৎসবের মূল আকর্ষণ হল রাসচক্র।

বৌদ্ধ ধর্মচক্রের আদলে বাঁশের তৈরি প্রায় ৩০ থেকে ৪০ ফুট উঁচু এবং ৮-১০ ফুট ব্যাস বিশিষ্ট চোঙাকৃতি কাঠামোর ওপর কাগজের সূক্ষ্ণ কারুকাজ করে এই রাসচক্র তৈরি করা হয়। এর বিশেষত্ব হল প্রতি বছর লক্ষ্মীপুজোর দিন থেকে নিয়ম করে, একমাস নিরামিষ খেয়ে কোচবিহারের বাসিন্দা আলতাফ মিঞা ও তাঁর পরিবারের সদস্যেরা বংশপরম্পরায় এই রাসচক্র তৈরি করে আসছেন। এই রাসচক্রে দক্ষ হাতের নানারকম নকশার সাথে সাথে বিভিন্ন দেবদেবীর রঙিন ছবিও থাকে। কোচবিহারের মানুষের আবেগের সাথে জড়িয়ে থাকা এই রাসচক্র একই সাথে হিন্দু, মুসলিম ও বৌদ্ধ ধর্মের সমন্বয়ের প্রতীক হিসেবে ঐতিহ্য বহন করে আসছে।

এবার আসি রাসমেলার প্রসঙ্গে। বর্তমানে এই মেলা আর শুধুমাত্র ধর্মীয় গন্ডীতে আবদ্ধ নেই, বরঞ্চ অনেকটাই অর্থনৈতিক অবস্থার পরিচায়কে পরিণত হয়েছে। এই মেলায় একদিকে যেমন নানারকমের মনোহারি দোকান আসে, তেমনই থাকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন। মন্দির চত্বরে নানারকম ভক্তিমূলক গান, পাঠ, কীর্তন প্রভৃতির ব্যবস্থা থাকে। আবার মন্দিরের বাইরে স্টেডিয়াম চত্বরে পুরসভার তরফ থেকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সেখানে গান, নাচ, আবৃত্তি, নাটক থেকে শুরু করে যাত্রাপালার ব্যবস্থাও থাকে অনেক সময়। এছাড়াও এবিএনশীল কলেজের সামনের রাস্তার অন্য পাশে মাঠে সার্কাসের তাঁবু বসে।

কাঁসা, পেতলের বাসন থেকে শুরু করে শুরু করে শীতের পোষাক, খাবার দোকান থেকে শুরু করে নাগরদোলা, নিজে সাজার জিনিসের থেকে শুরু করে ঘর সাজানোর জিনিস সবটাই থাকে এই মেলায়। বাংলাদেশের থেকে প্রতি বছর কিছু শাড়ির দোকান, গুড়ের দোকান প্রভৃতি আসে। এছাড়াও থাকে বেনারসের পানের দোকান। এই সবকিছু মিলিয়ে যেই ক’দিন মেলা চলে সেই ক’দিন যেন সারা শহর জুড়ে এক আলাদাই উন্মাদনা কাজ করে। বিভিন্ন জায়গার থেকে, এমনকি বিদেশ থেকেও মানুষ আসেন এই মেলা এবং মদনমোহন ঠাকুরের টানে। এই অঞ্চলের মানুষের বিশ্বাস, এই মন্দিরে মন থেকে কিছু প্রার্থনা করলে মদনমোহন ঠাকুর কাউকে খালি হাতে ফেরান না। তাই মদনমোহন ঠাকুরের কৃপাধন্য হতে হলে আসতেই হবে কোচবিহার জেলার এই জাগ্রত মদনমোহন মন্দিরে।

ছবি ও লেখায়: সুবর্ণা পঞ্চানন তক্ষক
তথ্য সংগ্রহ: শ্রী শ্রী মদনমোহন মন্দির দেবোত্তর ট্রাস্ট এবং গুগল

Facebook Comments Box
Subarna Panchanan

Recent Posts

SVF Music Unveils April Edition of “Banglar Gaan Indies”

Following the resounding success of the inaugural edition, SVF Musicproudly announces the arrival of the…

3 months ago

Mimi Chakraborty and Nabila to Star Alongside Shakib Khan in ‘Toofan’

Amidst ongoing speculations regarding the leading lady opposite Shakib Khan in the upcoming film 'Toofan',…

4 months ago

Why Does a Rich Chicago Law Firm Keep Suing Indian Tribes?

This article originally appeared in DC Journal: https://dcjournal.com/why-does-a-rich-chicago-law-firm-keep-suing-indian-tribes/ Why does a deep-pockets Chicago law firm keep…

8 months ago

Anupam Roy’s ‘Aami Sei Manushta Aar Nei’ is a Musical Masterpiece

In a spectacular celebration coinciding with the birthday of the iconic actor Prosenjit Chatterjee, the…

10 months ago

অনুষ্কা পাত্রর কণ্ঠে শোনা যাবে দে দে পাল তুলে দে

হিমেশ রেশামিয়ার পর সুরাশা মেলোডিজ থেকে অনুষ্কা পাত্রর নতুন গান পুজো আসছে মানেই বাঙালির নতুন…

10 months ago

Srijit Mukherji’s Dawshom Awbotaar is On a Roller Coaster!

The highly awaited trailer of grand Puja release, "Dawshom Awbotaar", produced by Jio Studios and…

10 months ago