বাবা-মা বড় সাধ করে নাম রেখেছিল বেণী, বেণী ভট্টাচার্য। অভাবের সংসারের চতুর্থ সন্তান, তাও আবার মেয়ে, তাই স্কুলের চৌকাঠে পা পড়েনি কোনোদিনও। যৌথ পরিবারে সবার সাথেই বড় হয়ে উঠছিলাম। কিন্তু সেদিনের সেই ছোট্ট আমি বুঝতে পারিনি সংসারের জটিলতা, বুঝিনি সম্পর্কের জটিলতা। আমার সামনে ঠিক কতটা প্রবল ঝড় আসতে চলেছে তার বিন্দুমাত্র আঁচও তখন পাইনি।
সংসারের জটিলতাগুলো সেদিন বুঝলাম, যেদিন দাদাঠাকুর মারা যাওয়ার পর জ্যেঠু বাবা-কে ভুলিয়ে সমস্ত সম্পত্তি নিজের নামে করে নিলেন। চাষের জমির পাশে দাদাঠাকুরের লাগানো একটা নিমগাছ ছিল, অনেক আবেগ, অনেক স্মৃতির সাক্ষী ওই গাছ। ওরা সেটাও কেটে ফেলতে চাইল। বাধা দিলাম, রুখে দাঁড়ালাম, প্রতিবাদ করলাম, তবে মেয়ে মানুষের প্রতিবাদ তো তাই গ্রাহ্য করলনা কেউ।
সংসারের অভাব, জটিলতা সবটা নিয়েই বড় হচ্ছিলাম, তবে আমার বাড়ন্ত বয়স যে পরিবারের শিরঃপীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়াবে জানতাম না। মাথার বোঝা হাল্কা করার জন্য দাদারা আমার বিয়ে ঠিক করল। আমি তখন ১১ আর “স্বামী” পুরুষটি ৩০। একপ্রকার জোর করেই বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ করা হল আমায়। পুতুল খেলার বয়সে হাতে উঠল খুন্তি, স্কুলে যাওয়ার বদলে পা রাখলাম হেঁশেলে। মনে হয়েছিল রান্নাবাটির সংসার সাজাচ্ছি, আমি পুতুলবউ আর “ও” আমার পুতুলবর।
কিন্তু সবটুকু শেষ করে দিল ওই একটা রাত। শারীরিক সম্পর্ক, ধর্ষণ কোনোটার মানেই বুঝতাম না সেদিন। নররূপী পশুটা সেদিন আমার হাত-পা বেঁধে নিজের শরীরের সমস্ত বল প্রয়োগ করে আমার মধ্যে প্রবেশ করেছিল, নিজেকে শেষ বীর্য বিন্দু পর্যন্ত নিঃশেষ করেছিল আমার ভিতর, কামড়ে-আঁচড়ে ছিঁড়ে খেয়েছিল আমার শরীর-টাকে। সেদিনের আমার আর্ত চিৎকার সবার কানে শীৎকার হয়ে বেজেছিল, জাহির হয়েছিল আমার স্বামীর পৌরুষ।
বৈবাহিক ধর্ষণে ধর্ষিতা আমার দিকে কেউ ফিরেও তাকায়নি, কারোর নজরে পড়েনি আমার শরীরের সেদিনের জমাট বাঁধা রক্তের কালশিটে দাগ। শৈশব, কৈশোর সব তো হারিয়েই ফেলেছিলাম, তবু রোজের ওই পাশবিক নির্যাতন সইতে না পেরে প্রতিবাদ করলাম একদিন। সব ছেড়ে ফিরে এলাম বাবার কাছে, কিন্তু লোকলাজের ভয়ে বাবা আবার ফিরিয়ে দিয়ে এল ওই নরকে— না ওই নারকীয় যন্ত্রণা আর সহ্য করতে পারিনি, ফিরেই এসেছিলাম অবশেষে। তবে আমার প্রত্যাবর্তনের নাম হল “চরিত্রহীনা”। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করছিলাম সবটা, কিন্তু আমার কপালে শান্তি কই? মিথ্যা চুরির দায়ে কারাবাসে পাঠালো আমার দুই দাদা। তখন আমি ১২, যৌবন সবে দরজায় কড়া নাড়ছে, তাই কারাগারের আইনরক্ষক নামক নরপিশাচ-টাও নিজের শরীরের ক্ষিদে মেটালো আমার শরীরে, আবারও ধর্ষিতা আমি। না, এবার আর পরিবারে ঠাঁই হলনা আমার, পরপুরুষের হাতে নষ্টা যে, তাই গ্রামও জায়গা দিলনা আমায়।
বছর ১২-এর কিশোরী, গ্রাম ছাড়া একাকিনী, কোথায় যাব, কী করব, সবই অজানা। তথাকথিত ভদ্র সমাজ আমায় ত্যাগ করেছিল, জানতাম না ভবিষ্যৎ পরিণতি কী হতে চলেছে। ঠিক সেই চরম পরিস্থিতিতে পাশে পেলাম হাসিম ইমরানকে, রাম ভাল্লার ডাকাত দলের সবচেয়ে ভয়ংকর ডাকাত, যার ভয়ে বাঘে-গরুতেও এক ঘাটে জল খায়। হাসিমের হাত ধরে যোগ দিলাম ভাল্লার ডাকাত দলে, নতুন নাম পেলাম “বেণী বেগম”। কিন্তু বুঝিনি আরও এক বিপদের মেঘ ঘনীভূত হচ্ছিল আমার জীবনের আকাশে। একদিকে হাসিমের প্রশিক্ষণে আমি নিজেকে দলের উপযুক্ত করে তুলছিলাম আর অন্যদিকে ঠিক সেই সময় রাম ভাল্লার কামুক নজর পড়ল আমার ওপর, ভোগ করতে চাইল আমার শরীরটা। তবে না, সে পারেনি। হাসিম আমার সম্মান রক্ষা করে, ভাল্লাকে হত্যা করে ডাকাত দলের নতুন দলনেতা পদ পায়, নিকাহ করে স্ত্রী-র সম্মান দেয় আমায়। হ্যাঁ, হিন্দু ব্রাহ্মণের মেয়ে হয়ে নিকাহ করলাম হাসিম-কে, তবে সে আমার ধর্মে হস্তক্ষেপ করেনি কোনোদিনই। হাসিম-কে জীবন সাথী পেয়ে আরও বলিয়ান হয়ে উঠেছিলাম আমি। প্রতিশোধের আগুন জ্বলছিল তখন আমার মধ্যে। বদলা নিলাম সেই নরপশু-টার ওপর যে আমার শৈশব শেষ করেছিল। তাতেও আমার প্রতিশোধ স্পৃহা কম হল না। একের পর এক লুঠ করেছিলাম অত্যাচারী জমিদার-দের, ভূস্বামীদের অপহরণ করে তাদের মাথার চড়া দাম হাঁকিয়েছিলাম, করেছিলাম রেলডাকাতিও। ছোট্ট মেয়ে বেণী তখন দেশের ত্রাস “বেণী বেগম”। সরকার আমার মাথার চড়া দাম ধার্য করেছিল, তবে আমি তখন নির্ভীক, পাশে হাসিমের মতো সাথী, দুঃসাহসী আমি নির্ভয়ে চালাতে থাকলাম আমার দুঃসাহসিক অভিযান।
কিন্তু ভুলে গেছিলাম যে আমার জীবনে সুখ বড়ই আপেক্ষিক। রাম ভাল্লার লোকেরা হাসিম-কে দলনেতা পদে ঠিক মেনে নিতে পারছিল না, তাই ভেঙেছিল দলটা। তবে তাতেও শান্তি হয়নি ওদের। নিরস্ত্র হাসিম-কে খুন করেছিল ওরা। ছোটবেলায় বাবার মুখে শুনেছিলাম রামায়ণের মেঘনাদ বধ-এর গল্প, কিন্তু সেদিন চাক্ষুষ দেখেছিলাম সে নৃশংসতা। আরও একবার ঢালবিহীন একাকিনী আমি। হাসিমের মৃত্যুতে আমার দুর্বল অবস্থার সুযোগ নিয়ে ওরা অপহরণ করেছিল আমায়।
আবারও মিথ্যা অভিযোগ এসেছিল আমার নামে, এবার স্বামী খুনের। সালিশি সভায় গ্রামের মোড়ল আমার সাজা ঘোষণা করল। শাস্তি স্বরূপ তিন সপ্তাহের বেশী সময় ধরে চলেছিল গণধর্ষণ। নারকীয় যৌন আর শারীরিক নির্যাতনের পর যখন আমি অর্ধমৃত, ওদেরও ভোজ্য আর কিছু বাকি নেই আমাতে, তখন মৃতপ্রায়, অর্ধনগ্না আমায় ফেলে রেখে এসেছিল গ্রামের শেষ প্রান্তে জঙ্গলের ধারে। ভেবেছিলাম বাকিটুকু শেষ হয়ে যাব হিংস্র জানোয়ারের হাতে, কিন্তু সেখান থেকে আমায় উদ্ধার করেছিল বিরজু সিং আর তার ডাকাত দল। তাদের দল আমায় সম্মান দিয়েছিল দলনেত্রীর, নাম দিয়েছিল “ডাকাত রানী”। আরও একবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল বেণী। পিশাচগুলো ঠিক যেভাবে আমার উপর অত্যাচার চালিয়েছিল, সেই প্রতিটা অত্যাচারের শোধ নিয়েছিলাম, গুনে গুনে শেষ করেছিলাম সবকটাকে।
শেষ পশুটার শিকার করে সেদিন ভবানী মন্দিরে মা ভবানীকে ওই পশুটার রক্তে স্নান করিয়ে পূজো দিয়ে ধন্যবাদ জানাতে গেছিলাম, জানিনা পুলিশেকে খবর দিয়েছিল তবে সশস্ত্র পুলিশ ঘিরে ফেলে আমায়, বাধ্য হয়ে সেদিন আত্মসমর্পণ করেছিলাম। কিন্তু সেখানেও অবিচার আমার সাথে, বিনা বিচারে ১১ বছরের কারাবাস হয়েছিল আমার, নষ্ট হল জীবনের আরও ১১-টা বছর।
অবশেষে বিচার হল, জামিনে ছাড়া পেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম নতুন ভাবে জীবন শুরু করব, কিন্তু সে আর হল কই! আততায়ীর পিস্তলের ৬-টা গুলি ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল আমার শরীর-টা, লুটিয়ে পড়েছিলাম মাটিতে। ভবানীর নাম নিয়ে শেষ বারের মত দু’চোখ ভরে পৃথিবী-কে দেখে নিয়ে চিরনিদ্রায় শায়িত হয়েছিলাম। অবসান হয়েছিল ইতিহাসের আর এক অধ্যায়ের।
তবে যেতে যেতে এটুকু বুঝেছিলাম যে- এক বেণী-কে শেষ করলেও এমন হাজার হাজার বেণী জন্ম নেবে, রচনা করবে নতুন ইতিহাস, জীবনের সমস্ত ঘাত-প্রতিঘাত সামলে রুখে দাঁড়াবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে। তাই “বেণী”-রা অমর থাকে প্রতি নারীর সত্তায়, প্রতিটা মানুষের মননে।
Following the resounding success of the inaugural edition, SVF Musicproudly announces the arrival of the…
Amidst ongoing speculations regarding the leading lady opposite Shakib Khan in the upcoming film 'Toofan',…
This article originally appeared in DC Journal: https://dcjournal.com/why-does-a-rich-chicago-law-firm-keep-suing-indian-tribes/ Why does a deep-pockets Chicago law firm keep…
In a spectacular celebration coinciding with the birthday of the iconic actor Prosenjit Chatterjee, the…
হিমেশ রেশামিয়ার পর সুরাশা মেলোডিজ থেকে অনুষ্কা পাত্রর নতুন গান পুজো আসছে মানেই বাঙালির নতুন…
The highly awaited trailer of grand Puja release, "Dawshom Awbotaar", produced by Jio Studios and…
This website uses cookies.