বাংলার রবিনহুড (ডাকাতদের ইতিকথা-১)

আজকাল আমাকে বাংলার রবিনহুড বলে ডাকা হয়। রবিনহুড কে চিনিনা, আমার “আমি” হয়ে ওঠার পরে, আমাকে বা আমার কীর্তিকলাপ তো সবাই জানে। কিন্তু আমি হয়ে ওঠার গল্পটা আজ এখানে বলবো…

আমার যখন জন্ম হয়েছিল, তখন বাংলার বুকে বুট ঠুকে রাজ করছে ব্রিটিশ রাজসিংহ। এদেশি জমিদাররা তাদের পা চাটা লম্পট ভৃত্য।

আমার জন্মের সময় থেকেই দেখে এসেছি আমার গ্রামের লোকেদের উপর অমানবিক অত্যাচার, গোটা গ্রামের সমস্ত মানুষের জীবিকা একটাই, চাষবাস। তার মধ্যে থেকে প্ৰতিটা গ্রামের প্ৰতিটা চাষীর যদি অর্ধেকের বেশি ফসল “কর” হিসাবে দিয়ে দিতে হয়, দু’ফসলী জমিতে যদি নীল গাছ চাষ করতে হয়, তাহলে গোটা তল্লাট জুড়ে যে সংকট দেখা দেওয়ার কথা সেটারই মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়েছিল আমাদের বাবাদের এবং আমাদেরও।

তবে অনটনের মধ্যেও আমি ছোটোবেলায় কিছুটা পড়াশোনা করার সুযোগ পেয়েছিলাম। তবে ছোটো বেলা থেকেই আমার লাঠি খেলতে ভালো লাগত, একজন গুরু ধরে তাই অনেক দূর শিখেওছিলাম। আমার সমবয়সী কেউ তো নয়ই, বয়সে অনেক বড়রাও অনেক সময় আমার সাথে লাঠি খেলায় পেরে উঠত না। দূর্দান্ত লাঠি খেলোয়াড় হিসাবে আমার নাম যখন তল্লাটে ছড়িয়ে পড়ছে ধীরে ধীরে, তখনই এল আমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ মোড়।

আমাদের পরিবারের চাষের জমিতে নীল চাষ করতেই হবে, এমন এক ডিক্রি নিয়ে একদিন হাজির হল দুই পাইক। তাদের পত্ৰপাঠ বিদায় দিয়ে দিলেন আমার বাবা, কিন্তু তাদের মাথার উপর হাত রেখেছেন স্বয়ং নীলকুঠীর সাদা সাহেব। তারা দমবার পাত্ৰ নয়। তারা রীতিমতো হুমকি দিয়ে গেল যে নীল চাষ করতে হবেই, বাবা ভাবল থানায় গিয়ে বললে যদি কোনো লাভ হয়! কিন্তু সেখানেও ইংরেজ সিংহ থাবা বসিয়েছে অনেক আগেই।

ফলে আমার জেদী বাবার কপালে যা ছিল তাই হল। একদিন সকালে উঠে দেখা গেল কারা যেন বাবাকে লাঠিপেটা করে মেরে ফেলে গেছে আমাদেরই মাঠে।

আমার নতুন যৌবনের রক্তে আগুন লেগে গেল। আমি বুঝেছিলাম যে আমার বাবার মত বহু গ্রামে বহু চাষী একই কারণে মারা গেছে। এরকম করে চলতে থাকলে আমাদের অবস্থা আরও সঙ্গীন হয়ে উঠবে। সব নীলকুঠীর সাহেব, তাদের ডান হাত জমিদার, আর থানার টিকটিকি গুলোকে মেরে আমার বাবার মৃত্যুর প্ৰতিশোধ নেবোই প্রতিজ্ঞা করলাম।

যেমন ভাবা, তেমনি কাজ। আশেপাশের গ্রাম থেকে আমার মতই কয়েক জনের সাথে কথা বলে জানালাম আমার ইচ্ছে, তারাও রাজী। তো এক অমাবস্যার রাতে সব জোগাড়-যন্ত্ৰ করে মা কালী কে পেন্নাম ঠুকে বেরোলাম অভিযানে। থানায় আগুন লাগিয়ে, নীল কুঠীতে গিয়ে সব নীল লুঠে, একধার থেকে সাহেব-চাকর সবকটাকে কুপিয়ে যে পাল্টা মারটা দিয়েছিলাম, সেটাই গোটা তল্লাটের মধ্যে একটা আত্মবিশ্বাস এনে দিয়েছিল। গ্রামের মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল যে আমরাও রুখে দাঁড়াতে পারি।

সেই শুরু। তারপর থেকে আশে পাশের যে গ্রামেই অত্যাচার হয়েছে সেখানে গেছি৷ গ্রামের ছেলেপুলে জোগাড় করে লাঠি ধরিয়ে দিয়ে শিখিয়েছি, “ওরা যদি মারে, তোরাও ছাড়বি না। যেখানে যা পাবি লুঠে নিবি, না পারলে পুড়িয়ে দিবি। ছেড়ে কথা বলবি না।”

লোঠা মাল গ্রামের সবার মধ্যে ভাগাভাগি করে নেবার কথাটা কিছুদিন পরে মাথায় এসেছিল। তৎক্ষণাৎ সেটা চালুও করেছিলাম। তাই বাকি জীবনের সবসময় গ্রামের মানুষ ইংরেজ পুলিশের কাছে আমাকে নিয়ে একটা প্ৰশ্নের উত্তরেও মুখ খোলোনি।

দিনের পর দিন জমিদার, পুলিশ, নীলকর পাইকরা যত অত্যাচার করেছে, আমার দল ক্রমাগত ততই বড় হয়ে গেছে। আমরা ঠগিদের মত যাকে তাকে রাস্তার মাঝখানে মেরে লুঠরাজ করতাম না। রাজার সাথে যুদ্ধ করেছি রাজার চালে। কোনো ইংরেজদের পা ধুয়ে খাওয়া জমিদারের বাড়িতে লুঠতে যাওয়ার এক সপ্তাহ আগে চিঠি লিখে জানিয়ে দিতাম। সেই জমিদার যদি ভয়ে পালিয়ে যায় তো ভাল, আর বেশি ক্ষমতা দেখিয়ে মুখোমুখি হলে তাকে সোজা যমের সাথে সাক্ষাৎ করিয়ে দিতাম।
সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়াটা আমার বিশেষ পছন্দ ছিল। তাই ডাকাতির সময় প্রথম লাঠির ঘা টা আমারই পড়ত। আমাদের ব্যবহার করা রণ পায়ের গল্প তো আজ সবাই জানে। আর থানার দারোগাকে চিঠি লিখে দেখা করে আসার মত বুকের পাটাও ছিল আমাদের।

এতক্ষণ পড়ে নিশ্চয় বুঝেছেন, যে পাতি বাংলায়, আমাকে ডাকাত বলা যায়। কিন্তু আমার একটা কথাই বলার যে আমরা ডাকাত হতে পারি কিন্তু আমরা ভুল কিছু করিনি। আমরা শুধু আমাদের দাবী টুকু বুঝে নিয়েছিলাম, আমাদের পরিবারের হয়ে, আমাদের গ্রামের হয়ে…
আমরা সাহেবদের খুন করেছি, পুলিশ খুন করেছি, জমিদার খুন করেছি, হাসতে হাসতেই করেছি; কিন্তু আমরা কোনো মেয়েমানুষের গায়ে হাত দিইনি, কোনো বাচ্চার গায়ে আঁচড়ও লাগতে দিইনি। সে যারই বাচ্চা হোক, আমরা জানতাম মাথার উপর ভগবান আছেন। তিনি সব দেখছেন। আমরা লুঠ করেছি কিন্তু লুঠের মাল কারোর একার জন্য খরচা হয়নি। গ্রামের কোনো মেয়ের বিয়ে ভেঙে দিয়ে চলে যাচ্ছে এমন বর যাত্ৰীর পকেটে লুঠের টাকা গুঁজে দিয়েও বিয়ে সম্পূৰ্ণ করেছি।

এখন আড়াইশো বছর পর আমার জীবনের অনেক ঘটনাই এখন লোকমুখে ছড়াতে ছড়াতে এমন আকার নিয়েছে যে কোনটা সত্যি, আর কোনটা বাড়িয়ে বলা, সেটা আমি নিজেই ঠাহর করতে পারি না। আমার মৃত্যুর কথাও আর মনে নেই। তবে নতুন যৌবনের সেই প্রতিহিংসার আগুন আজও আমার বুকে জ্বলে। তাই জীবনের প্রথম দিকের কথাগুলো এখনো মনে আছে। আর এই ছোটো মনে রাখাগুলোর মধ্যে দিয়েই আমি আজও বেঁচে আছি, থাকব আশা করা যায়। আপনারা আমায় যার সাথেই তুলনা করুন না কেন, আমি আমার গল্প গুলোতেই অন্য সবার থেকে আলাদা হয়ে থাকব।

Facebook Comments Box
Staff Writer

Editorial Team of LaughaLaughi

Recent Posts

SVF Music Unveils April Edition of “Banglar Gaan Indies”

Following the resounding success of the inaugural edition, SVF Musicproudly announces the arrival of the…

3 months ago

Mimi Chakraborty and Nabila to Star Alongside Shakib Khan in ‘Toofan’

Amidst ongoing speculations regarding the leading lady opposite Shakib Khan in the upcoming film 'Toofan',…

4 months ago

Why Does a Rich Chicago Law Firm Keep Suing Indian Tribes?

This article originally appeared in DC Journal: https://dcjournal.com/why-does-a-rich-chicago-law-firm-keep-suing-indian-tribes/ Why does a deep-pockets Chicago law firm keep…

8 months ago

Anupam Roy’s ‘Aami Sei Manushta Aar Nei’ is a Musical Masterpiece

In a spectacular celebration coinciding with the birthday of the iconic actor Prosenjit Chatterjee, the…

10 months ago

অনুষ্কা পাত্রর কণ্ঠে শোনা যাবে দে দে পাল তুলে দে

হিমেশ রেশামিয়ার পর সুরাশা মেলোডিজ থেকে অনুষ্কা পাত্রর নতুন গান পুজো আসছে মানেই বাঙালির নতুন…

10 months ago

Srijit Mukherji’s Dawshom Awbotaar is On a Roller Coaster!

The highly awaited trailer of grand Puja release, "Dawshom Awbotaar", produced by Jio Studios and…

10 months ago