একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনা বৈধ-অবৈধের সংজ্ঞাটাই বদলে দিল। জীবন কোনোকিছুর জন্য থেমে থাকে না, আর থাকেওনি। প্রাপ্তি এখন শিলিগুড়ির একটা আশ্রমে সপরিবারে বেশ আনন্দেই জীবন যাপন করছে। হ্যাঁ, প্রাপ্তি, সে এখন নয়নার জীবন ত্যাগ করে প্রাপ্তি হয়ে নিজেকে নতুন করে গড়ে তুলেছে। সে জ্ঞানপদ্ম আশ্রমের বাচ্চাদের পড়ায়। মীনা দেবী এখন আগের থেকে অনেক সুস্থ, তবে হাঁটতে পারেন না। সারাদিন হুইল চেয়ারে বসে বসে আশ্রমের বাচ্চাদের জন্য সোয়েটার বোনেন।

কখনো কখনো নিজের মনেই কী একটা গান গুনগুন করেন। আর খানিক বাদেই কেঁদে ফেলেন। এর কারণ কী তা প্রাপ্তি অনেকবার তার মায়ের কাছে জানতে চেয়েছে, কোনো বারই উত্তর পায়নি। দীনেশ বাবু আশ্রমে মালির কাজ নিয়েছেন। প্রতিদিন সকালে বাগান পরিস্কার করা থেকে শুরু করে ফুল তোলা, মালা গাঁথা, কৃষ্ণের মন্দির সাজানো সবই করেন। যদিও ওনার আরো দুজন সঙ্গী রয়েছে— হরি ও কেদার। অবিবাহিত দুই বাঙালি ভাই। যৌবনকালে মাথা গোঁজার ঠাঁই ছাড়া কিছুই ছিল না, তাই আর পাণিগ্রহণ করা হয়নি। বয়স ভালোই, তবে দীনেশ বাবুর থেকে কম। সময়ের চাকা যত গড়িয়েছে ততই নতুন জীবনে মানিয়ে নিয়েছে তারা।

সেই ঘটনার পর ওরা আর কলকাতায় ফেরেনি। মেঘালয় থেকে সোজা শিলিগুড়ি। প্রাপ্তি ও মীনা দেবীকে কিছুদিন আশ্রমের হেফাজতে রেখে দীনেশ বাবু একা কলকাতা এসেছিলেন। কলকাতার বিঘে খানেক জমি, পাঁচ মহলা বাড়ি বিক্রি করে সেই সমস্ত অর্থ আশ্রমকে দান করেছেন। টাকার অঙ্কটা খুব একটা কম নয়, প্রায় কোটি ছুঁই ছুঁই। বিনিময়ে যতদিন বাঁচবেন ততদিন আশ্রমের সদস্য হয়ে আশ্রমে থাকবেন এই শর্তে। দানের সঙ্গে বিনিময় শব্দটি ঠিক যায় না, শর্তও খাটে না, তাও এখানে বিনিময় ছাড়া আর কিছু বলা চলে না। নতুন জীবনে পুরনো স্মৃতি কাটা গায়ে নুনের ছিটে দিক এটা দীনেশ বাবু চাননি। তাই হাতে গোনা কটা মানুষ বাদে আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়েছেন সাত বছর আগেই।

সব বাচ্চাদের মধ্যে একটি বাচ্চা প্রাপ্তির সবচেয়ে প্রিয়। সব থেকে কাছের। মেয়েটিকে প্রাপ্তি সবসময় আগলে আগলে রাখে। মেয়েটির নাম কুঁড়ি। সত্যিই কুঁড়ি কি কখনো ফুল হয়ে পাপড়ি মেলবে না! বারো বছরের কুঁড়ি বয়সের তুলনায় অনেকটাই ছোটখাটো, আড়ষ্ট। অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে ছুটোছুটি করে মাঠে খেলে না, দৌড়-ঝাঁপ করে না, কথা তো কম বলেই এমন কি এক এক দিন ঘর থেকেও বেরোতে চায় না।

মুখ গোমড়া করে বসে থাকে। তখন প্রাপ্তি আদর করে, গান শুনিয়ে, কত রকম অঙ্গভঙ্গি করে ওকে হাসানোর চেষ্টা করে। সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে দাঁড়ায় তিনতলার ব্যালকনিতে। হঠাৎই মেয়েটার মন ভালো হয়ে যায়। প্রাপ্তির গলা জড়িয়ে মাম্মাম বলে ডাকে, গালে অনবরত চুমু দেয়। কি জানি কেন মেয়েটা প্রথম দিন থেকেই প্রাপ্তিকে মাম্মাম বলে ডাকে। আশ্রমের অন্যরা বারণ করলেও মেয়েটি শোনেনি, আর প্রাপ্তিও কোনো আপত্তি করেনি। বরং ওর ঐ ডাকটা ভালোই লাগে। কেমন যেন নিজের নিজের মনে হয়।

রবিবারের সকাল। বাচ্চারা রবিবারে অন্যদিনের থেকে একটু দেরিতে ঘুম থেকে ওঠে। তবে আজ মাসের চতুর্থ রবিবার, ওদের ঘুরতে যাওয়ার দিন। তাই আজ একটু সকাল সকাল ওঠে, একটু হইচই তো করেই, আর ওদের সামলানোর ভার গিয়ে পড়ে প্রাপ্তির কাঁধে। তন্দ্রা মিস, ললিতা মিস, এমনকি বাচ্চাদের প্রিয় এহানি মিসও ওদের সামলাতে পারেন না। তন্দ্রা মিস ও ললিতা মিস আশ্রমের সবথেকে পুরনো ও অভিজ্ঞ সদস্যা।

এহানি সম্পর্কে যে দু-চার কথা না বললেই নয়— এহানি নেপালি মেয়ে, ওর মতের বিরুদ্ধে ওর বাড়ির লোক ওর বিয়ে দিয়ে দিচ্ছিল। ওই দিনই ওদের গ্রামে অঞ্জন বাবুর দল একটি সোশ্যাল ওয়েল ফেয়ার ক্যাম্প করেছিল। ওরাই গিয়ে এহানির বিয়েটা আটকায়। বর পক্ষ চলে গেলে এহানির বাড়ির লোক ওকে মারধোর করে বাড়ি থেকে বার করে দেয়। অঞ্জন বাবু ওকে আশ্রমে নিয়ে আসেন। আশ্রয় দেন, চাকরি দেন।

এহানি প্রায় ন’বছর এই আশ্রমে আছে। তাই বাচ্চারা ওকেও খুব ভালোবাসে। প্রাপ্তি আসার পর সেই ভালোবাসায় ভাগ বসেছে বটে, কিন্তু এহানি তাতে হিংসা করেনি। বরং প্রাপ্তিকে সে’ই আশ্রমের সাথে মানিয়ে নিতে সাহায্য করেছিল। এখনো পর্যন্ত সে’ই প্রাপ্তির সবচেয়ে ভালো বন্ধু।

অন্য রবিবারগুলো বাচ্চাদের কাছাকাছি কোনো পার্কে বা মহানন্দার তীরে ঘুরিয়ে আনা হয়। কিন্তু আজকের দিনটা স্পেশাল। আজ কুঁড়ির জন্মদিন। ২৩শে জুলাই। এই দিনটা প্রতিবছরই খুব বড়ো করে পালন করেন অঞ্জন বাবু। একমাত্র কুঁড়ি ছাড়া এখানকার কোনো বাচ্চারই পিতৃ-মাতৃ পরিচয় নেই। কুঁড়ি অঞ্জন বর্মণের একমাত্র মেয়ে। কুঁড়ির জন্মদিন উপলক্ষে আজ মিরিক বেড়াতে যাওয়ার প্ল্যান হয়েছে।

আশ্রমে ফিরে সন্ধেবেলা খাওয়া-দাওয়ার অনুষ্ঠান। আশ্রমের বাস রেডি। বাচ্চারাও মহানন্দে বেলুন, চকলেট হাতে নিয়ে গাড়িতে ওঠার জন্যে প্রস্তুত। একমাত্র এখনো প্রস্তুত হয়নি কুঁড়ি। সকাল থেকে নিজের বিছানা ছেড়ে এখনো ওঠেনি। আজ প্রাপ্তিও ওকে তুলতে পারলো না। তবে কি মিরিক যাওয়া হবে না আজ?

ক্রমশ…

কলমে– অর্যমা

Facebook Comments Box

By Rikta Dhara

আমি বাংলা সাহিত্যের একজন গুণমুগ্ধ ছাত্রী। বর্তমানে লাফালাফির কন্টেন্ট রাইটার। লেখালিখির পাশাপাশি বিভিন্ন সৃজনশীল কাজ করতে ভালোবাসি। নিজের শৈল্পিক সত্তাটিকে সযত্নে লালন করি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *