রবীন্দ্রনাথ জানার জন্য ছিন্নপত্র পড়া অত্যাবশ্যক বলে বোধ হয়। সাহিত্যসৃষ্টির জন্যে কোনো কিছুর সাথে আপোস করেননি কখনও। সে সন্তানের মৃত্যুই হোক,পত্নীবিয়োগ বা নিজের অসুস্থতা। জীবনের শেষের দিনগুলোতেও লেখার জন্যে পাগল ছিলেন। একবার রামকিঙ্করকে বলেওছিলেন যে, আমি লিখি কারণ আমি লেখা পাগল,না লিখে পারিনা। অসুস্থতার জন্যে লিখতে পারতেন না শেষের দিকে। তিনি মুখে বলতেন,তাঁর লিপিকার সুধীরচন্দ্র কর লিখে নিতেন। ‘রবিবার’ গল্পটি প্রথম মুখে বলে লেখানো। তাঁর সময়কালে তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ। তা সত্ত্বেও লেখার ব্যাপারে,নামকরণ বিষয়ে অদ্ভুত রকমের খুঁতখুঁতে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রক্তকরবী নাটকের নামকরণই তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর চিঠিগুলোকেও সাহিত্যের পর্যায়ে রাখতেন। বাতের ব্যাথাকেও যে অত সুন্দর করে বর্ণনা করা যায়, তা ছিন্নপত্র না পড়লে অজানা থাকতো। একটা চিঠিতে লিখছেন, কোমরে বাত হলে চন্দনপঙ্ক লেপণ করলে দ্বিগুন বেড়ে ওঠে, চন্দ্রমাশালিনি পূর্ণযামিনী সান্তনার কারণ না হয়ে যন্ত্রণার কারণ হয়। আর স্নিগ্ধ সমীকরণকে বিভীষিকা জ্ঞান হয় – অথচ কালিদাস থেকে রাজকৃষ্ণ রায় পর্যন্ত কেউই বাতের উপর একছত্র লিখেননি, বোধহয় কারও বাত হয়নি। আবারও লিখছেন, হৃদয় ভেঙে গেলেও মানুষ মাথা তুলে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে কিন্তু কোমর ভেঙে গেলেই মানুষ একেবারে কাৎ, তার আর উত্থানশক্তি থাকেনা। বয়স, অসুখ এবং মৃত্যু এসমস্ত বিষয়কে আমলই দিতেন না রবীন্দ্রনাথ। বলেছেন, বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি সে আমার নয়।

রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে চন্দ্রিল ভট্টাচার্য প্রবন্ধে লিখেছেন, রবীন্দ্রনাথের মতো যারা দানবিক বিরাটত্ব নিয়ে জন্মান তারা অনেকে কম বয়স থেকেই নিজের ভেতরে ওই প্রদত্ত ক্ষমতার শনশন ঝাপটা অনুভব করতে পারেন।
(ছবি সংগৃহীত)

দানবিক বিরাটত্ব কথাটা চরম সত্য। তা নাহলে বিশাল সাহিত্যসম্ভার সৃষ্টি করতে পারতেন না। শুধু তাইই নয় লেখার অমরত্বের ব্যাপারেও সজাগ ছিলেন। নিজেই লিখেছেন, আজি হতে শতবর্ষ পরে কি তুমি বসিয়া পড়িতেছো আমার গ্রন্থখানি। প্রকৃতিকে অসম্ভব ভালোবাসতেন রবীন্দ্রনাথ। তাই বারেবারে মিশে যেতেন প্রকৃতির কোলে, নিংড়ে নিতেন সব রূপ-রস-গন্ধ। একটা চিঠিতে লিখছেন, আজকাল আমার সান্ধ্যভ্রমণের একমাত্র সঙ্গীটির অভাব হয়েছে। সেটি আর কেউ নয়, আমাদের শুক্লপক্ষের চাঁদ। কাল থেকে তার দেখা নেই। ভারি অসুবিধে হয়েছে, শীঘ্রই অন্ধকার হয়ে যায়, যথেষ্ট বেড়াবার পক্ষে একটু ব্যাঘাত জন্মায়।

এটাও পড়তে পারেন গোপীগীত

শিল্পের জন্য স্বার্থপর এবং সাহিত্যের পূজারী এই রবীন্দ্রনাথ আরও কয়েক শতবর্ষ প্রাণে থাকুক, মননে থাকুক।

Facebook Comments Box

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *