বৃদ্ধ বয়সটা পৃথিবীর সব থেকে বড় শিক্ষা দেয়। শিক্ষাটা এমন যে একা জন্ম নিয়েছো, তোমাকে একাই চলে যেতে হবে। এই দুটো বিষয়ের মাঝে যে মানুষগুলো, যে সম্পর্কগুলো সংযোজিত হতে থাকে সেসকল কিছুই ক্ষণিকের। প্রত্যেকটা সম্পর্কের একটা নির্দিষ্ট এক্সপায়ারি ডেট আছে। এই ব্যাপারটাকে যে যতো স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিতে পারবে সে ততটাই কম কষ্ট বুকে জমিয়ে রেখে মৃত্যুর স্বাদ নিবে।
আমার বয়স এখন প্রায় ষাট বছর। আমার এই ষাট বছরের অভিজ্ঞতা অনেক রঙিন। এখন এই বয়সে এসে সারাদিন পাই সেই রঙিন দিনের স্মৃতিচারণ করার জন্য। আমি একজন গৃহিণী। আমার বাবা মা আমাকে স্কুল,কলেজ পাশ করিয়ে তারপরেই বিয়ে দিয়েছিল। আমার স্বামীও চাইতেন যেন আমি বিয়ের পরেও পড়ালেখা করি। তবে আমার মনকে আমিই বোঝাতে পারি নি। তাই গৃহিণী পদের চাকরিটা আমি বেছে নেই। আমার দুটো ছেলে এবং একটি মেয়ে আছে। আমার প্রত্যেকটা সন্তান শিক্ষিত এবং বর্তমানের ভাষায় বলতে গেলে সেটেল্ড। বিয়ে, বউ, স্বামী, বাচ্চা, সংসার নিয়ে বেশ আছে। আমি আমার ছেলেদের সাথে, আমার স্বামীর বাড়িতেই থাকি। আমার স্বামী দু বছর আগেই পরলোক গমন করেছেন। যাবার কালে বলেছিলেন, ” আমি তোমার জন্য ওপরে অপেক্ষা করছি ” । এই কথাটার উত্তর আমার কাছে ছিল না। আজও নেই। কি উত্তর দিতাম? মৃত্যু যে আর আমার হাতে নেই। যদি থাকতো তাহলে, যে রাতে আমার বুড়ো আমাকে রেখে চলে গিয়েছিল, আমিও সে রাতেই তার কাছে চলে যেতাম।
যাক গে সে কথা। আমার রঙিন আলাপ করি। তোমাদের এই রঙিন বয়সে, বৃদ্ধ আলাপে তোমাদের মন নষ্ট করবো না। আমার শৈশব কাল, কৈশোর কাল কেটেছে বন্ধু বান্ধব আর ভাই বোনদের মাঝেই। ঐ বয়সে নিজেদের সীমা কতটুক আমরা জানতাম না। গাছে চড়ে পা ঝুলিয়ে বসা, গাছের কাঁচাপাকা ফল চিবিয়ে দাঁত রঙিন করা, পুকুরে একসঙ্গে সকলে ঝাঁপ দেয়া। কোনো কিছুই বাদ দেই নি। কলেজে এসে সেই বিশাল মহল ছুটে এক টুকরো দল হলো নিত্যদিনের সঙ্গী। সারাদিন গল্প করা, যেন গল্প শেষই হয় না। কলেজ শেষে পুকুর পাড়ে ঘণ্টার পর ঘন্টা বসে থাকা, রাস্তার হাবিজাবি খাওয়া, গরম গরম চা আর বৃষ্টি। আহা! কি দিন ছিল! এখন ভাবলে কেমন যেন একটা শান্তি বুকে ছড়িয়ে যায়, চোখের কোণে জল নামে, ঠোঁটে ফুটে মলিন হাসি। কলেজ পেরিয়েই আমার বাবা মা এক বুড়ো খুঁজে দিয়ে দিলেন বিয়ে। সেই বুড়োকে নিয়ে কি আর বলবো। সেই বুড়ো যেন আমার জগৎ, সংসার হয়ে গেলো। তোমাদের মত আই লাভ ইউ বলার প্রয়োজন আমাদের ছিল না। মন খারাপ করলে সে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই আমি কেমন যেন বরফ গোলে পানি হয়ে যেতাম। নেকামি কাকে বলে তা দেখার মত ছিল। কাঁদতে কাঁদতে তার পাঞ্জাবিটা ভিজে যেত। আমার কান্নাকাটির রোল শেষ হলে সে বলতো, ” আমি কি এই বৃষ্টি ভেজা পাঞ্জাবি পরে বেড়োবো? ”
আমার বিয়ের পরও আমার বেশ কিছু বন্ধু বান্ধব ছিল। তারা আমার বাসায় আসতো। এই বাসার বারান্দাতেই আমরা চা, সমুচা খেতাম। সময়ের রেষ আর তাদের ধরে রাখতে পারে নি। ধীরে ধীরে সেই কলিজার টুকরো বন্ধুগুলো নিজ নিজ সংসারে ব্যস্ত হতে থাকলো। আমিও মা হয়ে গেলাম। সংসার,পরিবার, সন্তানদের নিয়ে বেশ ভালই দিন কাটতে থাকলো। সময় কাটতে থাকলো আর মানুষ, একে একে দূরে, বহু দূরে চলে যেতে থাকলো। প্রথমে মা, বাবা চলে গেলেন। তারপর শ্বশুর,শাশুড়ি। একদিকে পুরনো সবকিছু হারাতে থাকলাম আর অন্যদিকে আমার সন্তানরা বড় হতে থাকলো, তাদের কারণেই অনেক মানুষ পরিচিতের তালিকাভুক্ত হতে থাকলো। একে একে করে সন্তানদের বিয়ে দেই। বয়স বাড়ে। অসুখ নামক ফুল ফুটতে শুরু করে।
শুনতে লাগলাম আমার স্কুলের সহপাঠীদের মৃত্যু সংবাদ। কেউ অল্প বয়সেই আবার কেউ পূর্ণ বয়সে, চলে যেতে থাকলো। তবুও সংসার থামে নি। আমার ছেলেরা তাদের বউরা বেশ ভালো। আমাকে আর আমার বুড়োকে বেশ আগলে রেখেছে। তাদের সন্তান হলো। পুরো বাড়ি গরম করে তুলতো বাচ্চাগুলো। আমাদের দিন তখন বেশ ভালই কাটতো। ধীরে ধীরে তারা বড় হতে থাকলো, আর আমরা বৃদ্ধ। তাদের স্কুল আর পড়াশুনা আমাদের ব্যস্ততা কমিয়ে আনলো। আমরা বুড়ো বুড়ি একা হতে থাকলাম। দুবেলা ছেলে বউমার সাথে দেখা হতো। আর একবেলা বাচ্চাগুলো এসে মুখ দেখিয়ে যেত। বলতো,” ঠাম্মি আজ পড়া আছে যাই।” তাদেরই তো সময়, এই ভেবে আমরাও তাদের ভবিষ্যতের মাঝে কাঁটা হতাম না। আমার বুড়ো দেখতে দেখতে তলিয়ে গেলো। আমি একা রয়ে গেলাম। না জীবিত আছি, না মৃত।
এক সময় আমার সারাদিন পলকের মধ্যে কেঁটে যেত সংসারের কাজ করতে করতে। তারপর ” মা মা” ডাক শুনতে শুনতে কেঁটে যেত সারাবেলা। আর এখন আমার দিনই কাটতে চায় না। রাত তবে বেশ কাটে। ডাক্তারবাবুর দেয়া জাদুর ওষুধ, একটা খেলেই মুহূর্তে ঘুমপাড়ানি পরীরা চোখে এসে গল্প শুনিয়ে যায়। আর আমি ঘুমিয়ে যাই।
তবে দিনটা কাটাতে বেশ কষ্ট হয়। এখন তো আর সংসার আমার নাই। সংসার হয়েছে ছেলেদের। মেয়েটা আসে মাঝে মধ্যে। সেও আমারই মত সংসারে মনোযোগী। আমি আমার ঘরের মধ্যেই থাকি। মাঝে মাঝে বারান্দায় বসি। গাছপালা দেখি। দুটো চড়ুই পাখি আমার বারান্দায় রোজ আসে। তাদের বন্ধুত্ব দেখি। আর আমার রঙিন স্মৃতিগুলো আমার চোখে ভাসে।
বৃদ্ধ বয়সটা বড়ই অবহেলার। সামনের মানুষটা বুঝতেই পারে না কতটা অবহেলিত হয়ে পড়েছি আমরা। তারা আমাদের ভালো চায়। ভালো করে। সেবা করে। মাঝে মাঝে সঙ্গ দেয়। তবে বৃদ্ধ বয়সটা বড়ই লোভী। খালি সঙ্গ খুঁজে। গল্প করতে চায়। কেউ শুনুক আর নাই বা শুনুক, গল্প বলতে চায়। প্রাণ খুলে কথা বলতে চায়। এক জীবনের এতো অভিজ্ঞতা বলে শেষ করা যায় না তাই হয়তো বলতে চায়।
এই বৃদ্ধ বয়সটা বড়ই অসহায়ত্বের। চাইলেই লাফ দিয়ে গাছের ডালে উঠাতো, দূরের কথা সিঁড়ি বেয়ে নামাও যায় না। চাইলেই দুচোখ দিয়ে ঐ দূরের আকাশে সাদা মেঘ কি কালো দেখাই যায় না।
এখন আমার দেহে আর জোর নেই। ছেলে আর ছেলের বউরাই আমাকে টেনে উঠিয়ে বসায়। খাওয়ায়, বাথরুমে নিয়ে যায়। গল্প করার মতো তাদের কাছে সময় হয় না, আমি বুঝি। তবে আমার বৃদ্ধ মন শুধু তাদের চায়। এই ঝাপসা চোখ দুটো শুধু চায় যেন তারা সারাক্ষণ আমার সামনে বসে থাকে। আর আমি মন ভরে তাদের দেখি। একদিন হুট করেই তো একাই চলে যাবো। সময় বড্ড কম। কে জানে কোনদিন সময় নামক কাবুলিওয়ালা এসে বলবে ” চল “। আর আমি থাকবো চোখ বুজি, যাওয়ার আগে একটু সঙ্গ খালি খুঁজি।
” কাবুলিওয়ালা পারলে একটু সঙ্গ দিয়ে যাবি! ”
Following the resounding success of the inaugural edition, SVF Musicproudly announces the arrival of the…
Amidst ongoing speculations regarding the leading lady opposite Shakib Khan in the upcoming film 'Toofan',…
This article originally appeared in DC Journal: https://dcjournal.com/why-does-a-rich-chicago-law-firm-keep-suing-indian-tribes/ Why does a deep-pockets Chicago law firm keep…
In a spectacular celebration coinciding with the birthday of the iconic actor Prosenjit Chatterjee, the…
হিমেশ রেশামিয়ার পর সুরাশা মেলোডিজ থেকে অনুষ্কা পাত্রর নতুন গান পুজো আসছে মানেই বাঙালির নতুন…
The highly awaited trailer of grand Puja release, "Dawshom Awbotaar", produced by Jio Studios and…
This website uses cookies.