একটা সময়ে আমার বাবা এই গানটি আমায় শিখিয়েছিলেন,
“হারে রে রে রে রে আমায় ছেড়ে দে রে দে রে “। আর বলেছিলেন, ” মা, এই পৃথিবীটাকে নিজের বিচরণ ক্ষেত্র ভাবিস, দু পাখনা মেলে উড়িস”।

ছোটবেলায় আমি যেভাবে বড় হয়েছি তাতে নিজেকে ভাগ্যবান মনে হয় কারণ আমার সময়ে আমার বাবা মা অতটাও নজর দিতে পারেননি। ” অনাদর একটা মস্ত স্বাধীনতা” কথাটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হৃদয়ের কোণ থেকে লিখেছিলেন।

আজকের যুগে শৈশব বলে বস্তুটাই হারিয়ে গেছে। জন্ম নেবার সাথে সাথে বাবা মায়েরা ছেলেপুলেদের জীবন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করতে শুরু করে। আসলে সবাই আজ ভয়ানক মনোযোগী তাদের ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যত নিয়ে।
ছোট থেকেই আমি বরাবরের একটু ঘুমকাতুরে। একালে জন্মালে হয়ত আমি মরেই যেতাম কারণ বিশ্বাস করুন ওই সকাল সকাল স্কুল যাবার কোনো ইচ্ছা আমার আজও নেই।

আজকালকার সব বাচ্চারা দেখি সকাল সকাল মস্ত পোঁটলা নিয়ে মহা গম্ভীর মুখ করে স্কুলে চলেছে সঙ্গে তাদের মা’রা তো আছেই। একালের বাচ্চারা এত সব চাকরির সুলুক সন্ধান জানে যেটা শুনে আমিও অবাক হয়ে যাই।
বাবা খিচুড়ি স্কুলে ভর্তি করেছিলেন আমায় ছোটোবেলায়। খিচুড়ি স্কুল হচ্ছে নার্সারি স্কুল, যেখানে পড়ার থেকে বেশি খিচুড়ির দিকে লোভ থাকত আমার।

এখন তো শুনি বাচ্চারা সব দু বছর থেকেই পড়া শুরু করে, ধন্যি বটে!
গরমের ছুটিতে সেই রোদে রোদে খেলা আর ঘাম আজও মনে আছে। এখন তো বাবা মা’রা পড়ার গুঁতোতে বাচ্চাগুলোকে খাঁচায় বন্দি করে রাখে।
এখন শুনি অভিভাবকেরা ভালো ইংরাজী মিডিয়াম স্কুলে পড়ানোর জন্য মোটা টাকার ডোনেশান দিতেও পিছপা হন না। আমি তো গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়া মেয়ে।

আজকাল বাবা মা’রা ছেলেমেয়েদের নিয়ে বিরাট বড় স্বপ্ন দেখেন হয়ত নিজেদের অপূর্ণ ইচ্ছাগুলোও চাপিয়ে দেন। আর সেগুলোতে সাফল্য পেলে অভিভাবকের বুক চওড়া হয় আর হোয়াটস্ অ্যাপে টেক্সট যায় ” উফ্ আমার ছেলেটা যা ইন্টেলিজেন্ট ওদের স্কুলের ম্যাম বলেছেন ওকে আর কয়েক বছর পর আর এখানে রাখা যাবে না… আই মিন ফরেনে পাঠাতে হবে ইউ নো হাহাহা”।

আর যদি বাচ্চাটা ব্যর্থ হয়? তবে তো কথাই নেই। অন্যদের সঙ্গে তুলনা করতে করতে ওরা এটা ভুলে যান যে সবার প্রতিভা সবক্ষেত্রে থাকে না। আপনারা অভিভাবক, আপনারাই তো ওদের প্রতিভা খুঁজে বার করবেন।
আরও একটা ব্যাপার হল লাভজনক পড়ার বিষয়। আমরা ছোটবেলায় জানতাম যে যেটা ভালোলাগে সেটা নিয়েই পড়া উচিত। এখন তো কেউ প্রতিভার ধার ধারেন না, যেটা পড়লে চাকরি পাওয়া যাবে এরকম পড়ানোতেই তারা বেশি ইন্টারেস্টেড।

ভগবান সবার মধ্যেই কিছুনা কিছু প্রতিভা দিয়েছেন, বাবা মা’রা সেটাকে খুঁজে বার করুন। সেটার প্রতি এনকারেজ করুন আপনার বাচ্চাটাকে দেখবেন সেও উন্নতি করছে।

মাঝে মাঝে মনে হয় আমি ভীষণ লাকি। এসময় জন্মালে পাক্কা ভুগতাম আমি। বাবা মাকে বরাবর আমি বুঝিয়েছি যে আমি পারব। সব জায়গাতেই একলা যাওয়ার অভ্যাস আমার বরাবরের, নিজের উপর ভরসা আছে।
রাস্তা বহুবার হারিয়ে ফেলি, হয়তো ভুল করি, তবে যা শিখি সে আমার একান্ত অভিজ্ঞতা।

আবারও বলব, বাবা মা আপনারা, ওদের কাছে আপনাদের থেকে বেশি আপন কেউ নেই। তাই ওদের বুঝুন। ইংরাজী মিডিয়ামে ভর্তি করিয়ে বা রাশি রাশি মেডেল পেলেই বা খেলতে না দিলেই আপনার ছেলেমেয়ে উন্নতি করবে না।
দরকার সঠিক সময়ের আর আপনাদের ভালোবাসার কারণ অনেক সময়েই এই চাপের ফলেই ওরা আত্মহত্যা করে।
তাই বাবা মা’রা, একটু সচেতন হন। নাইবা ওদের চাপ দিলেন শৈশবে, চাপ নেবার বয়স সামনে পড়ে আছে অনেক।

Facebook Comments Box

By Staff Writer

Editorial Team of LaughaLaughi

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *