তিতলি তখন ক্লাস সিক্স। অংকের নম্বর হঠাৎ করে নব্বই থেকে সত্তুর। মায়ের মাথায় বজ্রাঘাত। এখন থেকে অংকে পাকা না হলে ভবিষ্যতে সাইন্স নিতে পারবে কী করে?আর সাইন্স নিতে না পারলে তো ভবিষ্যৎ অন্ধকার।
এত ভেবে মা সিদ্ধান্ত নিল একটা ভালো সায়েন্স প্রাইভেট টিউটর রাখতে হবে। এবং তড়িঘড়ি তা যোগাড়ও হয়ে গেলো। পরিবর্তন হলো তৃপ্তির পড়ার জায়গাও। তিন তালার ছাদের পাশের ঘরটা পরিষ্কার করা হলো শুধুমাত্র তিতলির নিরিবিলিতে পড়তে পারে তার জন্য। ঠিক বিকেল ছ’টা থেকে শুরু।

মা পরিচয় করিয়ে নিজে চলে যাওয়ার পর থেকেই নতুন প্রাইভেট টিউটর তিতলির অ্যাপিয়ারেন্স নিয়ে নানারকম কমেন্ট করতে শুরু করল। তোমার চুলটা খুব সুন্দর, ঠোঁট দুটো খুব সুন্দর ইত্যাদি ইত্যাদি। সবাই প্রশংসা করলে, তিতলিকে দেখতে সুন্দর বললে তিতলির ভালোই লাগে। কিন্তু এনার প্রশংসা করল কেনো যেনো ভালো লাগছিল না। যত দিন যেতে শুরু করল প্রশংসার বহর বাড়তেই থাকল। তিতলির পড়াশোনায় মন থাকলেও নতুন প্রাইভেট টিউটরের পড়ানো ছিল না।তারপর ধীরে ধীরে খাপ খুলতে শুরু করল নতুন সে।

পা দিয়ে তিতলির পায়ের ওপর হালকা হালকা করে টাচ করতে শুরু করলো। মাত্র এগারো পেরোনো তিতলী প্রথমটায় কিছুই বুঝতে পারছিল না। শুধু উনি পায়ে পা লাগালে কিংবা হাতটা অকারণ ধরলে গা টা গুলিয়ে উঠতো তিতলির। একদিন স্কুলের সহপাঠী অঞ্জন পুকুরপাড়ে ডেকে তার হাতটা ধরে তিতলিকে বলেছিল যে, সে নাকি তিতলিকে খুব ভালোবাসে। সে সময় তো তোর এমনটা লাগেনি যেমন লাগে নতুন প্রাইভেট টিউটর হাতে হাত রাখলে কিংবা কোন তাকে ছুঁলে। বান্ধবী তৃনাকে সব কথা খুলে বলাতে তৃনা এসবে বেশী পাত্তা দিতে বা ভাবতে বারণ করল।

এদিকে দিন প্রতিদিন বেড়েই চলছে তার কর্মকাণ্ড। সহ্য করতে না পেরে মাকে সবকিছু খুলে বলার সিদ্ধান্ত নিল তিতলি। বাবা ও দাদু যখন নিমন্ত্রণ খেতে এক সন্ধ্যায় বাইরে গেল মাকে একা পেয়ে সব বলে দেওয়ার কথা ভাবল সে। কিন্তু কেন জানি তার ভয় ভয় করছে।সে কোন ভুল করেনি, কোন দোষ করেনি তবে এমন ভয় লাগছে কেন? কিছুতেই বুঝতে পারছেনা সে।মা যদি তাকে ভুল বুঝে। কম বয়সে বেশি পেকে গেছে এ কথা ভাবে। শিক্ষকদের সম্মান করতে জানে না এটাও ভাবতে পারে। এসব সাত-পাঁচ ভেবে তিতলি আর কিছুতেই সবকিছু খুলে বলতে পারল না মাকে।

এদিকে এরকম জিনিস প্রতিদিন সহ্য করতে করতে সবকিছু থেকে মন উঠতে শুরু করল তার।না পড়তে ভালো লাগতো,না আঁকাআঁকি করতে। এমন কি নাচ করতেও আর মন চাইত না। স্কুলের শিক্ষকদের প্রিয়, ক্লাসের সবচেয়ে একটিভ তিতলি এখন থাকতো না সারাদিন জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে। সারাদিন ভাবতো কি করে এ সমস্যার সমাধান পাওয়া যায়। এদিকে স্যারের হাতের সাহস দিন দিন বেড়ে যাচ্ছিল। প্রথমে পা, তারপর হাত, তারপর পিঠ, তারপর যেখানে সেখানে।
এক বৃষ্টি ভেজা দিনে তিতলি জানলা দিয়ে বাইরে আনমনে পৃথিবীটাকে দেখছিল, তখন কর্মশিক্ষার দিদিমণি ক্লাসে এসে বলল আজ একটা নতুন জিনিস শেখাবে। নতুন জিনিসটা শিখতে শিখতে তিতলির মাথায় বিদ্যুৎ স্ফুলিঙ্গ সমস্যার সমাধান বেরিয়ে এলো।

কর্মশিক্ষা দিদিমনির কাছ থেকে ভাল করে শিখে তিতলি তৈরি করে ফেলল বৈদ্যুতিক সকেট। তার সাথে জুড়ে দিল একটা হালকা খালি চোখে প্রায় অদৃশ্য তার। আর সেটাকে সেট করে দিল তার পড়ার টেবিলের ঠিক নীচে। প্রাইভেট স্যারের কামাতুর পা যখনই তার দিকে এগিয়ে যেত, বিদ্যুতের হালকা তরঙ্গ ছড়িয়ে গেলো স্যারের লোমকূপের গোড়ায় গোড়ায়।

প্রাইভেট টিউটর এক ঝটকায়  পা সরিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে কড়া ভাষায় জিজ্ঞেস করলে, এসব কি? এসব করলে কিন্তু তিনি আর তাকে পড়াবেন না। এবং তার মাকে গিয়ে বলে দেবেন কতটা পেঁকে গেছে  তিতলি। তার সাথে কি অভদ্র আচরণ করছে সে।অন্য সময় হলে হয়তো এসব পরিবেশে ভয় পেয়ে থিতু হয়ে স্যারের কাছ থেকে ক্ষমা চেনে তো তিতলি। কিন্তু এবার আর তা হয়নি। কোথা থেকে যেন একটা অদম্য সাহস পেয়ে গেল। কেউ যেন পেছন থেকে বলছে, ভয় পাবি না। এগিয়ে যা। প্রতিবাদ কর। অশুর বিরুদ্ধে শুভর জয় হবেই।

তিতলি তার বড় চোখ দুটো গোল গোল পাকিয়ে স্যারকে বললে, “সত্যিটা আমি জানি ও বুঝি। একবার যদি সোশ্যাল মিডিয়ায় #মিটু লিখে তোমার নামটা দিয়ে দেই, তাহলে তুমি কোথায় মুখ দেখাবে একটু ভেবে স্যার। তাই চুপচাপ বাড়ি যাও। আর আমার সাথে উল্টোপাল্টা কিছু করার সাহস করো না।”

কলমে মৌমিতা ভাওয়াল দাস

ছবি: গুগোল

Facebook Comments Box

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *