পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে বাংলা সিনেমার জগতে এক নতুন ধারার সৃষ্টি হয়, যা ছিল neo-realism বা নব্য-বাস্তববাদ | যার পুরোধা ছিলেন সত্যজিত রায়, যিনি independent filmmaking এ বিশ্বাস করতেন এবং তার সিনেমার মাধ্যমে এর সম্বন্ধে সাধারণ মানুষকে ও অবগত করেছিলেন | প্রথমে বালিগঞ্জ গভর্মেন্ট তারপর প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে শিক্ষালাভ করেন | তারপর একটি বিজ্ঞাপন সংস্থায় নিযুক্ত হন, এছাড়াও বিখ্যাত ফরাসি পরিচালক Jean Renoir এর সাথেও কাজ করেছেন তার একটা ছবিতে | এরপর লন্ডন পাড়ি দেন এবং সেখানে “The Bicycle Thieves” দেখে মুগ্ধ হয়ে পড়েন ও পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন | তার দীর্ঘ কর্মজীবনে তিনি বহু সিনেমা পরিচালনা করেছেন তাদের মধ্যে নিম্নলিখিত পাঁচটি সিনেমা যা মানুষের হৃদয়ে চিরকালের মতো জায়গা করে নিয়েছে, সেগুলি হল-
১) পথের পাঁচালি
Chunibala Devi and Uma Das Gupta in পথের পাঁচালি
১৯৫৫ সালের আগস্ট মাসে পথের পাঁচালির মাধ্যমে বাঙালির ঘরের ছেলে “অপু” ও মেয়ে “দূর্গা” কে খুজে পাই আমরা | অপু-দূর্গা যেন আমাদের সবার পরিবারের একটা অংশ হয়ে ওঠে | তাদের দুজনের সরলতা, শৈশবের হাতছানির মুহূর্তগুলো খুব স্পষ্টভাবেই ধরা দেয় ছেড়া চাদরের মধ্যে দিয়ে এক চোখ বার করে অপুর তাকানো দৃশ্যতে বা ট্রেনের সেই বিখ্যাত দৃশ্যটা যেখানে কাশবনের মধ্যে দিয়ে অপু ছুটে চলেছে | ইন্দির ঠাকরুন কেও আমরা আমাদের পরিবারের সদস্য হিসেবে খুজে পাই, তিনি আপামর বাঙালির কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্র হয়ে ওঠেন | নব্য-বাস্তববাদের এক প্রবল উদাহরণ পাই আমরা এই সিনেমায় |
২) নায়ক
Sharmila Tagore and Uttam Kumar in নায়ক
মহানায়কের সাথে এটাই প্রথম কাজ ছিল তার | কি অসাধারণ ভাবে চিত্রতারকা অরিন্দমের (উত্তম কুমার) চরিত্রের মাধ্যমে নিজের অতুলনীয় ব্যক্তিত্বকে ফুটিয়ে তুলেছিলেন তা আজও আমাদের মনে আছে | আর তার অসাধারণ অভিনয় দক্ষতার কথা বলাই বাহুল্য, তিনি বহু চরিত্রে অভিনয় করেছেন নিজের কর্মজীবনে তবে নিঃসন্দেহে এটি তার জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্র ছিল | সাংবাদিকের ভূমিকায় শর্মিলা ঠাকুর ও অসাধারণ অভিনয় করেছেন | দুই অত্যন্ত দক্ষ, বুদ্ধিদীপ্ত, প্রভাবশালী, চিন্তাশীল মানুষের যুগলবন্দীতে এই ছবি এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছবি হিসেবে জায়গা করে নেয় সিনেমার জগতে ও মানুষের হৃদয়ে ও |
৩) মহানগর
A still from মহানগর
৬০’র দশকের কলকাতায় আরতি (মাধবী মুখোপাধ্যায়) বিক্রয়কর্মীর চাকরি নিয়ে জিনিসপত্র বিক্রির উদ্দেশ্যে শহরের উচ্চবিত্ত এলাকাগুলির ঘরে ঘরে যায় | এদিকে সুব্রত (অনিল চ্যাটার্জি) আর তার পরিবার আরতির এই কাজ করার ব্যাপারে অসন্তুষ্ট হন খানিকটা, কারণ তারা একটু পুরনো চিন্তাধারার মানুষ | এই চাকরিসুত্রে, আরতি বহু মানুষের সান্নিধ্যে আসে, আগের থেকে অনেক বেশি ব্যক্তিত্বশালী হয়ে ওঠে সে, তার মধ্যে দৃঢ়তার উদ্বেগ হয় প্রবলভাবে | এভাবে সে তার সংস্থার সবচেয়ে ভালো বিক্রয়কর্মী হয়ে ওঠেন | এর কয়েকদিনের মধ্যেই সুব্রতর চাকরি চলে যায়, তখন আরতিই পরিবারের দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নেন | এই সিনেমাটিতে আরতির চরিত্রের মধ্যে দিয়ে নারীজাতির দৃঢ়তার যে দৃষ্টান্ত দিয়েছে পরিচালক, তা এককথায় অতুলনীয় |
৪) সোনার কেল্লা
A scene from সোনার কেল্লা
গোয়েন্দা কাহিনী নিয়ে সিনেমা আগেও হয়েছে বিশ্বে, তবে বাংলা সিনেমার জগতে বাঙালির প্রথম গোয়েন্দা ফেলুদার আবির্ভাব সত্যজিত রায়ের হাত ধরেই | এই সিনেমার মূল আকর্ষণ বলতে ৭০’র দশকের মাঝামাঝি রাজস্থানের অত্যন্ত সুন্দর পরিবেশ, বাংলা সিনেমায় প্রথম মনোবিজ্ঞানের প্রয়োগ, ছোট্ট মুকুলের (কুশল চক্রবর্তী) প্রানবন্ত অভিনয়, যা দেখে সত্যিই চিরকাল মনে রাখার মত….এছাড়াও ডাঃ হাজরা, ফেলুদা ও তার
খুরতোতো ভাই তোপসে | আর আছেন সেই ব্যক্তি যার চরিত্রটি এই সিনেমার থেকে জড়িয়ে পরে ফেলু-তোপসের সাথে, সেটা হলো লালমোহন গাঙ্গুলী যিনি “জটায়ু” নামেই সর্বত্র পরিচিত | এই সিনেমায় সকলের অভিনয় দক্ষতা নিয়েই কিছু বলার নেই, সবাই নিজের নিজের চরিত্রে অনবদ্য | সত্যাজিতবাবুর পরিচালনার ক্ষমতা কতটা প্রখর ও প্রবল এবং তিনি কতটা বড় মাপের শিল্পী ছিলেন তা এই সিনেমার মাধ্যমে বোঝা যায়ে আর একবার | তার অসংখ্য সৃষ্টির মধ্যে এটি সর্বকালের সেরা একটি সৃষ্টি |
৫) সদগতি
সদগতি
মুন্সী প্রেমচাঁদের লেখা “সদগতি” নামক ছোটগল্পের উপর নির্ভর করে স্বল্পদৈর্ঘের এই তথ্যচিত্রটি তৈরী করেছিলেন সত্যজিত রায়, যেখানে হিন্দু ধর্মের মানুষদের ধর্মীয় গোড়ামির কথা খুব স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে | ভারতবর্ষের কোনো একটি গ্রামের বাসিন্দা কৃষক দুখিয়া (ওম পুরি) ও তার স্ত্রী ঝুরিয়া (স্মিতা পাটিল) | তাদের মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে গ্রামের ব্রাহ্মণের (মোহন আঘাসে) সাথে কথা বলতে যায় সে, ব্রাহ্মন পন্ডিত দুখিয়ার নিচুজাত হওয়ার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাকে পন্ডিতের বাড়ির যাবতীয় কাজ করার নির্দেশ দেয় | অভুক্ত অবস্থায় সকাল গড়িয়ে দুপুর হলেও দুখিয়া তার কাজ করা থেকে ক্ষান্ত হয়না, এর খানিক পর সে অবেশেষে মাটিতে লুটিয়ে পরে ও তৎক্ষনাত তার মৃত্যু হয় | এই অবক্ষয়ের সমাজে জাত-পাতের সমস্যা বহু প্রাচীন | সত্যজিত রায় তার খানিক নিদর্শন ও ভয়াবহতার পরিচয় দিয়েছেন ৪৫ মিনিটের এই তথ্যচিত্রটির মাধ্যমে |
সত্যজিত রায় সম্বন্ধে বা তার কাজের ব্যাপারে এত সংক্ষেপে বলা সম্ভব হয়না কারণ তিনি কত বড় মাপের শিল্পী ছিলেন সেটা তার সিনেমা, সাহিত্যচর্চা, ছবি আঁকা প্রভৃতির মাধ্যমে জানি আমরা | তিনি তার দীর্ঘ কর্মজীবনে প্রচুর স্বনামধন্য, গুণী, সুদক্ষ মানুষের সাথে কাজ করেছেন | তার সিনেমার মূল বিষয়গুলো যত কঠিন বা যত জটিল হোক, দর্শকের সামনে এত সহজ-সরলভাবে সেগুলো উপস্থাপন করতেন তিনি তা অকল্পনীয় | এখানেই সত্যজিত রায়ের মহত্ব | সৃষ্টিকর্তা হিসেবে সত্যিই মানিকবাবুর জুড়ি মেলা ভার |
Leave a Reply