কথায় আছে বিষে বিষে বিষক্ষয়, কিন্তু এই বিশে বিশে যেন মৃত‍্যুর বিষ ছড়িয়ে পড়েছে আর একে একে হারিয়ে যাচ্ছেন ভালো মানুষেরা। ইরফান খান ও ঋষি কাপুরের প্রয়াণে বলিউডের নক্ষত্রখচিত আকাশ থেকে খসে পড়েছে দুটি উজ্জ্বল নক্ষত্র! মূল‍্যবান তারা খসে পড়ায় ঔজ্জ্বল্য তো কমেছেই বলিউডের! তাঁরা মৃত‍্যুর মতো নিষ্ঠুর অতচ ধ্রুব সত‍্যের পথে পাড়ি দেওয়ায়, ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতের অনেকটা অংশ ফাঁকা পড়ে গেছে, যা পূরণের অন‍্য কোনো বিকল্প খুঁজে পাওয়া একপ্রকার অসম্ভব।

বহুদিন থেকেই ক‍্যানসার নামক দুরারোগ্য ব‍্যধিতে ভুগছিলেন ইরফান খান ও ঋষি কাপুর। দুজনের বয়সের ফারাক প্রায় দেড় দশক। ২০১৮ তে বিদেশে চিকিৎসা করিয়ে ফিরে এসেছিলেন দুজনেই। তাঁদের মধ‍্যে এই রোগ বাসা বেঁধে থাকলেও বোঝার উপায় ছিলনা। তবে এত তাড়াতাড়ি চলে যাবার কথা কি ছিল তাঁঁদের! প্রশ্নটার উত্তর মৃত‍্যু দিয়ে গেলেও মেনে নিতে পারছে না তাঁদের কোটি কোটি ভক্ত।

বলিউডের আকাশ থেকে এই দুটি তারা খসে পড়ায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে।  বন্দিদশার মধ‍্যেই এভাবেই অগণিত ভক্তদের কাঁদিয়ে চলে গেলেন এই দুই তারকা আর সঙ্গে দিয়ে গেলেন অনেকটা অংশের অপূরণীয় ক্ষতি, যার বিকল্প খোঁজা একেবারে অসম্ভব!

ইরফান খানের মৃত‍্যুটা সত‍্যিই অবিশ্বাস্য।  তিনি ছিলেন একজন সত‍্যিকারের অভিনেতা। বলিউডে একের পর এক ভালো ছবি দিয়ে গেছেন তিনি। ‘সালাম বোম্বে’ দিয়ে বলিউডে প্রবেশ করেন তিনি। ‘পান সিং তোমার’ এর জন‍্য পান জাতীয় পুরস্কার। তাঁর ঝুলিতে রয়েছে ‘লাইফ ইন অ্য মেট্রো’, ‘মকবুল’, ‘মাদারি’, ‘হায়দার’, ‘তলয়ার’ ‘জাজবা’, ‘হিন্দি মিডিয়াম’, ‘পিকু’, ‘দি লাঞ্চবক্স’ ইত‍্যাদি বিখ‍্যাত সিনেমা। তাঁর শেষ ছবি ছিল ‘আংরেজি মিডিয়াম’। এই ছবিতেও তিনি বরাবরের মতো তাঁর অভিনয় দক্ষতা দিয়ে মন জয় করেছেন দর্শকদের।

শুধু বলিউড নয় তাঁর প্রতিভাকে ছেঁকে নিয়েছিল আপামর সিনেমা জগৎ। তিনি হলিউডেও একাধিক ছবি করেছেন। তার মধ‍্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘জুরাসিক ওয়ার্ল্ড’,  ‘লাইফ অফ পাই’, ‘দ‍্য নেমসেক’, ‘স্লামডগ মিলিওনার’। এছাড়া ‘দি অ্যমেজিং স্পাইডারম্যান’ , ‘ইনফেরনো’ র মতো ছবিতেও কাজ করেছেন ইরফান।

বাংলা চলচ্চিত্র জগতেও তিনি তাঁর কাজের একটা বড় ছাপ রেখে গেছেন। ভারত বাংলাদেশের যৌথ প্রযোজনায় ‘ডুব’ সিনেমাতে অভিনয় করেছেন তিনি। তাঁর মৃত‍্যুর প্রাক্কালে এই সিনেমার একটা সংলাপ মনে পড়ে যায়
“মানুষ মারা যায় তখনি যখন প্রিয়জনের সাথে তার যোগাযোগহীনতা তৈরি হয়” ।

মৃত‍্যুর কয়েকদিন আগেই ইরফান হারিয়েছিলেন তাঁর মা কে। তবে কি মায়ের কোলেই এত তাড়াতাড়ি চিরঘুমে চলে যাওয়া! না, জীবনযুদ্ধে হেরে গেলেন তিনি, তবে জিতে গেলেন কোটি কোটি মানুষের হৃদয়।

সত্তর এর দশকে যখন অমিতাভ বচ্চন, রাজেশ খান্না বলিউড দাপিয়ে বেড়িয়েছেন তখন ঋষি কাপুরের রোম‍্যান্টিক হিরো হিসেবে  আত্মপ্রকাশ। বচ্চন কিংবা রাজেশ খান্নার যুগেও তিনি হয়ে উঠেছিলেন বলিউডের এক বিখ‍্যাত স্টার। নিজের প্রতি তাঁর আত্মবিশ্বাস ছিল প্রচুর। তিনি অভিনয় জগতে পা রাখেন ‘মেরা নাম জোকার’ সিনেমায় শিশু শিল্পী হিসেবে। এরপর ‘ববি’ সিনেমার মধ‍্য দিয়ে তিনি রোম‍্যান্টিক হিরো হয়েই জায়গা করে নিয়েছিলেন অগুন্তি ভক্তদের কাছে।

‘দি কপিল শর্মা শো’ তে তিনি একবার বলেছিলেন ‘মেরা নাম জোকার’ মুভির রোল পাওয়া মাত্র তিনি নিজের ঘরে গিয়ে অটোগ্রাফ দেওয়া প্র‍্যাকটিস করেছিলেন। তখন কেই বা জানত যে ওই কিশোর ছেলেটিই একদিন বলিউডের একটা যুগ জূড়ে ছেয়ে থাকবেন! কিন্তু তাঁর আত্মবিশ্বাস ই তাঁকে সফলতা এনে দিয়েছিল। তাঁর জীবনাবসানে সত‍্যি বলতে বলিউডের একটা যুগ শেষ হল!

অমিতাভ বচ্চনের সাথে তিনি একাধিক ছবিতে অভিনয় করেছেন। তার মধ‍্যে সবচেয়ে বিখ‍্যাত সিনেমা হল ‘অমর আকবর অ্যন্টনি’। এই ছবিতে ঋষি কাপুর আকবরের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। অমিভাভের ভালো বন্ধু ছিলেন ঋষি। তাঁর মৃত্যু সংবাদ টুইট করে অমিতাভ লিখেছিলেন যে এই মৃত‍্যুতে তিনি বিধ্বস্ত। অমিতাভ ও ঋষিকে শেষ একসাথে দেখা গিয়েছিল ‘১০২ নট আউট’ ছবিতে।

ঋষি কাপুর তাঁর অভিনয় জীবনে অভিনেতা হিসেবে নজর কেড়েছেন হয়তো কমই তবে তিনি একজন সুপারস্টার তো অবশ‍্যই। অভিনয় জীবনের শেষ কিছু চরিত্রে চমক দেখিয়েছেন তিনি। তার মধ‍্যে ‘অগ্নিপথ’ এর রৌফ লালা, ‘মুলক্’ এর মুরাদ আলি কিংবা ‘১০২ ধট আউট’ এর বাবুলাল চরিত্রে তাঁর অভিনয় ছিল চমকে দেওয়ার মতো।

ইরফান খানের সাথে ‘ডি-ডে’ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন ঋষি কাপুর।

করোনা কবলিত দেশের এই দুর্দশাতে ইরফান খান ও ঋষি কাপুরের মৃত‍্যু সংবাদ যেন মনখারাপের কালবৈশাখীর মতো। তবে যে যায়, সে আর ফিরে আসেনা। থেকে যায় অগুন্তি স্মৃতি। আর সর্বোপরি শিল্পীর মৃত্যু হয় না। শিল্পী বেঁচে থাকেন শিল্পের জগতে।

Facebook Comments Box

By Staff Writer

Editorial Team of LaughaLaughi

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *