LaughaLaughi

You Create, We Nurture

Special Story

আমি তিতির – শেষ পুজোয়

আমি তিতির । আমার বয়স ১৮ । আমি ছোট থেকে social anxiety disorder এর শিকার । আমি ভাবতে ভালোবাসি । আর এটা আমার গল্প

(আকাশে খুব মেঘ করেছে । যেন কেউ খুব করে বকে দিয়েছে,তাই আকাশের মুখ ভার । কাল দশমী ছিল,আবার একটা পূজো দেখতে দেখতে কেটে গেল,তাই বোধহয় সমগ্র প্রকৃতি আজ একজোট হয়েছে,যেন বলতে চাইছে—“আর একটুক্ষণ থেকে যাও মা”। ঐ বৃষ্টি শুরু হল । এবার সত্যিই বোধহয় বিদায়পর্ব শুরু হলো । আর আমরা,এই মুখ গোমড়া করে থাকা আকাশ,অসহায় ভাবে ভিজতে থাকা ফুটপাত কেমন যেন নিষ্পলক চোখে দাঁড়িয়ে সবটা দেখছি কিন্তু—)
—‘তিতির,অ্যাই তিতির ছাদে একা একা কি করছিস?কতবার বারণ করেছি একা একা—’
(উফফফ্,মায়ের hobby ই বোধহয় আমি যখনই কিছু লিখবো,তখন প্যানপ্যান করা । )
—‘যাচ্ছি মা,এমনি বসে হাওয়া খাচ্ছিলাম আর ভাবছিলাম তুমি কখন এসে আমায় disturb করবে ।’
(খানিকটা জোর গলায় বললাম)
—‘সেই তো,মা হয়ে মেয়ের খোঁজ নিচ্ছি,তাতেই এরকম করছিস । জানা আছে বয়স হলে আর আমায় চোখে দেখবি না । যা আর তোকে কিচ্ছু বলবো না—’
(নাও,ঐ শুরু হলো এবার emotional কথাবার্তা । মা টা কে নিয়ে যে কি করি?)
—‘আমি শুধু মনে করিয়ে দিতে এসেছিলাম । আজ তোর ডাঃ রায়ের কাছে counselling আছে । রেডি থাকিস । যত চিন্তা তো আমারই—’
(এই বকবক এখন থামবে না । একবার বাইরে থেকে ঘুরে আসি । মাথাটা গরম করে দিল । উফফফ্—)
—‘মা আমি একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসছি ।’
—‘আমাকে বলে কি হবে ? আমি কে ?আমার কথা কেউ শোনে এ ঘরে ?কতবার বলেছি একা একা—’
(এই রেডিওর মতো বকবকানি চলতে থাকবে ।)
বাইরে বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি ধরলাম ।
(ট্যাক্সির জানলায় মাথা ঠেকিয়ে দ্রুত সরে যাওয়া শহরটাকে ঠিক রাতের ঘুমের ঘোরে দেখা স্বপ্নের মতো লাগে । মানে ঠিক স্বপ্নের মতো কোনো দৃশ্যটা স্পষ্ট আবার কোনোটা আবছা । রাস্তা দিয়ে এখনো কিছু ঠাকুর যাচ্ছে বিসর্জনের জন্য । আকাশটা মেঘলা বড্ড । সবাইকে ভিজিয়ে দেবেই । চারিদিকে যেন কেমন সবাই মনমরা,চুপচাপ । হওয়ারই কথা,ঐ ফুটপাতটায় কাল পর্যন্ত যে ছেলেটা বেলুন বিক্রি করছিল মানে পাতি ভাষায় হাওয়া বেচে পেট চালানো আবার ঐ মেয়েটা যে চুড়ির দোকান দিয়েছিল,তাদের মরশুম যে শেষ।এবার আবার একটা বছরের অপেক্ষা । রাস্তার পাশে একটা প্যান্ডেলে, কিছু মেয়ে সিঁদুর খেলছে,সত্যি এইসব সিঁদুর খেলা,অষ্টমীর সকালে সাদা শাড়ি লাল পাড় পড়ার জন্য মেয়েদের উৎসাহী মুখ আবার পাঞ্জাবী পড়া ছেলেদের ঝাড়ি মারা । এসবই তো বাঙালীর কিছুদিনের সেরা মুহূর্তগুলো,যেটার জন্য সব বাঙালী একবছর অপেক্ষা করে । বছরের এই মরশুমটাই তো সবধরনের মানুষকে একটা রাস্তার উপর নিয়ে আসে,আর—)
—‘ম্যাম,এসে গেছি । ’
(সবকটা এক । সবাই কিছু না কিছু করে,আমার ভাবনাগুলোয় তালা মারবেই ।)
পার্কের এক কোণে বসলাম । জায়গাটা কিছুটা অন্ধকার,স্যাঁৎসেতে,বেশ একা একা । একটু দূরে দেখলাম একজন বয়স্ক ভদ্রলোক এবং একজন ভদ্রমহিলা পার্কের বেঞ্চে বসে,একে অপরের কাঁধে মাথা দিয়ে বসে আছে । কিছুক্ষণ পর তার পাশ দিয়ে একদল ছেলেমেয়ে সেই দৃশ্য দেখে হাসাহাসি করতে করতে যাচ্ছে আর কানে ফিসফিস করে কিছু বলাবলিও করছে । কিন্তু ঐ দাদু দিদার সেগুলোর উপর কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই ।
(আচ্ছা ঐ ছেলেমেয়ে গুলো ওরকম করলো কেন?ওরা প্রেম করতে পারলে,এই দুজন দাদু দিদা পারবেন না কেন?প্রেমের কি কোনো বয়স থাকে নাকি? খালি whatsapp and facebook করলেই কি মানুষ আধুনিক হয়ে যায় । এনারা হয়তো কোনো এককালে দুজন দুজনকে খুব ভালোবেসেছিলেন,কিন্তু শরৎকালের ক্ষণিকের বৃষ্টির মতো সবকিছু সময়ের মৃতপ্রায় কুন্ডে ভস্মরাশি হয়ে জমে ছিল । আজ বহুদিন পর তারা হয়তো আবার একসাথে নতুন করে কিছু ভাবতে চায় আর এটাই বোধহয় সেই রূপকথার phoenix পাখির মতো করে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখা । আসলে না আমাদের জীবনের উপর অদ্ভূত ওড়না সবসময় কিছু না কিছু আড়াল করে চলে,আর আমরা সেটা আবছা ভাবে হয়তো দেখতে পাই আবার কখনো পাই না । ভাবি যে একদিন সব পাবো,অপেক্ষা করে থাকি,কিন্তু যেটা ঢাকা থাকে সেটা ঢাকাই থাকে,ধীরে ধীরে হারিয়ে যায়,আমরা বুঝতে পারি কিন্তু আমাদের পিছনেও হয়তো থাকে যে ধরতে দেয়না । অনেক দেরি হয়ে যায়,তারপর যখন খুঁজে পাই তখন দমদেওয়া ঘড়ির যেমন দম ফুরিয়ে আসে আমাদের ও তেমনি চোখ বুজে আসে । আসতে আসতে ঐ মাথার ওপরের ওড়না আমাদের উপর চাপা—)
আমার ফোনটা বেজে উঠলো । মা ফোন করেছে ।
(এই মহিলাটি না আমার পিছন ছাড়বে না । ফোনটা তখনও বেজে—)
—‘হ্যালো । ’
—‘হ্যাঁ,বলছি আর কতক্ষণ?কিছু বলিনা বলে যা খুশি তাই করবি?শোন তিতির, আমি —’
—‘হ্যাঁ ঠিক আছে,আমি শুনেছি এক্ষুনি ফিরছি,রাখো তো । ’
(অনেকটা সময় কেটে গেছে । শরৎটাও শেষের মুখে ,হাওয়াতে ধীরে ধীরে ঠান্ডা ভাবটা মিশছে । গাছপালা গুলো বোধহয় এবার ঘুমোবে । সাময়িক ওড়না ঢাকা পড়বে । এক মিনিট এসব কেন ভাবছি ?)
এবার আমায় উঠতে হবে । একবার ঐ দাদু দিদার দিকে তাকালাম । ওরা এখন দুজন দুজনকে যাপটে ধরে চোখ বুজে কিছুক্ষণ হাসলো তারপর এ কি! ও রা দুজন দু দিকে আলাদা হয়ে চলে গেল কেন?
দুরে এখনো কোনো পাড়ার প্যান্ডেলে গান বাজছে—

“সখী,ভাবনা কাহারে বলে ।
সখী,যাতনা কাহারে বলে ।
তোমরা যে বলো দিবস-রজনী‘ভালোবাসা’ ‘ভালোবাসা’—”

(না তিতির আর বেঁচে নেই । এটা তিতিরের বেঁচে থাকা অবস্থায় গুরুত্বহীন একটা—)

Facebook Comments Box

LEAVE A RESPONSE

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Editorial Team of LaughaLaughi