(আমার নাম বোধহয় তিতির । আমার বয়স ১৯ । আমি ছোটো থেকে social anxiety disorder এর শিকার । আমি ভাবতে ভালোবাসি । আর এটা ছিল আমার গল্প । )

( আচ্ছা , এই অনুভূতি জিনিসটা ঠিক কি ? মানে অনুভূতি টা কে কি দেখা যায় ? আমার তো মনে হয় দেখা যায় যেমন খুব আনন্দ হলে হাসি , আবার নাও হাসতে পারি , আবার দুঃখ পেলে কাঁদি | তো আমাদের ভাব ভঙ্গি গুলোই আমাদের অনুভূতি গুলো দেখায় । যদি ঠিকমতো লক্ষ্য করে থাকেন তাহলে দেখবেন কারোর ভালো থাকা মানে , সকালে উঠে মাটির ভাঁড়ে চা খাওয়া আবার কারোর সবার সাথে মিলেমিশে থাকাতে । এবার এই অনুভূতি গুলো তো খুব ক্ষণস্থায়ী , এই যেমন এখন হাসছি কিছুক্ষণ পরে হয়তো কাঁদবো । তো আমার কথা হচ্ছে এই যে এতগুলো মানুষ রাস্তা দিয়ে একসাথে পাশাপাশি হাঁটছে , এদের সবার অনুভূতি কি একই ? হতেই পারে আবার—)
—‘ম্যাডাম দাঁড়িয়ে কেন ? ভেতরে আসুন । গরীবের ঘরে পায়ের ধুলো—’
(এই প্রথমবার একটা বাজে কথা বললো । বাড়ী আবার গরিবের কি ধনীর কি ? বাড়ীর মধ্যে থাকা মানুষগুলোর মধ্যে যদি একে অপরের প্রতি ভালোবাসাটা থাকে , তাহলে সেটা কোনো বহুতল বাড়ীর থেকে ছোট নয় । আসল ব্যাপার টা হলো সম্পর্ক , এই সম্পর্ক যদি আমরা বেশি জটিল না করি , বাড়ির ভিত জানি না তবে আমাদের জীবনের ভিতটা মজবুত—)
—‘হ্যাঁ , ম্যাডাম বলুন কি খাবেন চা , কফি , কোল্ড-ড্রিংকস্—’
—‘না ধন্যবাদ , এক গ্লাস জল দিলেই হবে । আর আমার জিনিসটা একটু তাড়াতাড়ি দিলে ভালো হয় । এমনিতে দেরি হয়ে গেছে এরপর বেশি দেরি হলে ঘরে ঝামেলা হবে । ’
—‘আচ্ছা আপনি বসুন , আমি জল নিয়ে আসছি, তারপর আপনাকে আপনার ডায়েরিটা দিয়ে দেব । ’
—‘এই নিন ম্যাডাম জল । দাঁড়ান আপনার ডায়েরি টা নিয়ে আসি ততক্ষণ আপনি জল খান । ’
—‘আচ্ছা এই বাড়ীতে আপনি একাই থাকেন ? মানে আপনার বাবা , মা ?’
—‘আসলে আমার বাবা মারা যান যখন আমি কলেজে উঠবো উঠবো করছি । আর মা মারা গেছেন , এই দুবছর হলো । তারপর থেকে একাই সংসারের হাল ধরে বেঁচে আছি । আর বস্তির গরিব ছেলে গুলোকে পড়াশুনা সাহায্য করি যাতে কিছুটা হলেও ওরা স্বপ্ন দেখা শিখতে পারে । স্বপ্ন দেখা না শিখলে—’
(স্বপ্ন , খুব বড়ো আর প্রয়োজনীয় শব্দ । আচ্ছা এই যে গাছের পাতাগুলো , এরাও কি স্বপ্ন দেখে ? না মানে এরা কি জানে খুব অল্প সময়ের মধ্যে এরা ঝরে পড়ে মাটিতে মিশে যাবে ? বা আমরা তো সংবিধান সংরক্ষণে বিশ্বাসী তবুও ভারত ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হয়ে যায় তো যারা জেনারেল কাস্ট তারাও জানে যে— ছাড়ুন আর নাইবা বললাম । আর একদিকে আমি যে কিনা স্বপ্ন দেখে যে একদিন তার বাবা তাকে ভালোবাসবেই ওটা বরং স্বপ্ন না হয়ে আমার ইচ্ছে—)
—‘—একি ম্যাডাম জল খাচ্ছেন না কেন ? এই দেখেছেন , কথায় কথায় ভুলেই গেছি আপনার ডায়েরিটা নিয়ে আসতে হবে দাঁড়ান ১ মিনিটে আসছি । ’
—‘এই নিন ম্যাডাম , আপনার ডায়েরি—’
হঠাৎ দরজায় দুবার ঠকঠক করে কড়া নাড়ার শব্দ হল ।
—‘দাঁড়ান ম্যাডাম কে এসেছে একটু দেখে আসি—’

একটু উঁকি মেরে দেখলাম , দরজায় দুজন হিজড়া দাঁড়িয়ে আছে । ঠোঁটে লিপস্টিক , চোখে কাজল , কপালে টিপ , নাকে নোলক পুরো টিপিক্যাল বঙ্গনারী । কোনো সাজগোজ করা মেয়ে ও বোধহয় হার মানবে । শুনতে পেলাম শীর্ষেন্দু দা কে বলছে—
—‘এই আমরা বেরোচ্ছি , তুই আসবি কি ? আর কতদিন লুকিয়ে রাখবি নিজেকে ?’
—‘তোরা যা এখন । আমার সময় হলে ঠিক চলে যাব । বাড়িতে একজন অতিথি এসেছে । ’

ওরা একটু উঁকি মেরে আমায় দেখলো । তারপর মুচকি হেসে চলে গেল ।
(এই প্রথমবার জীবনে খুব কৌতূহল অনুভব করলাম । খুব জানার ইচ্ছে হচ্ছে লোকটা আসলে কে । না একবার জিজ্ঞেস করেই ফেলি ।)
—‘আচ্ছা একটা প্রশ্ন করতে পারি ? যদি কিছু মনে না করেন —’
—‘জানি কি জিজ্ঞেস করতে চান । তার আগে আপনাকে আমি কিছু বলতে চাই । দেখুন আমি এমনিতে তেমন বেশি কারুর সাথে মিশি না । কেন জানি না আপনার সাথে কথা বলে খুব ভালো লাগছে । বিশ্বাস করুন , মনে হচ্ছে আপনিই পারেন একমাত্র কথাগুলো বুঝতে । ’
একটু দম নিয়ে আবার শুরু করলেন—
—‘জানি না আপনাকে বলা ঠিক হবে কিনা , তবুও আপনার উপর বিশ্বাস রেখে কথাটা বলবো আর হয়তো কথাগুলো শোনার পর আপনি আমার সাথে একমুহূর্তও থাকতে চাইবেন না । শুধু আপনি নয় সমাজের বেশির ভাগ সভ্য মানুষ তাই ই করে । আমাদের দেখে টোন—টিটিকারি মারে , নাক সিটকোয় , দুরে পালায় বলতে গেলে সমাজের আসল অচ্ছুত আমরাই । ভদ্রসমাজ আমাদের হিজড়া নামে ডাকে । আর এই ভদ্রসমাজের ভয়ে এখনো আমি নিজেকে লুকিয়ে রেখেছি । আমায় প্যান্ট-শার্ট পড়া হিজড়াও বলতে পারেন । বাসে , ট্রেনে আমাদের দেখলে বিরক্ত হয় অথচ যখন আমরা ভিড়বাসে পিঠখোলা ব্লাউজ পড়ে উঠি তখন চোখ বড়ো বড়ো করে দেখতেও কেউ ছাড়ে না । জানেন এই যে যারা ফেমিনিজম নিয়ে এতো তবড়ায় , কই আমাদের কথা একবারো ভেবেছে ? খালি এই দাও আর ঐ দাও আর রাস্তায় নেমে চেচাও এরাই ঘরে ফিরে নিজের মেয়েকে বলবে ‘বাবু চুড়িদার পড়ে যাস , জিন্সটা পড়িস না ’। কই এরা তো খোঁজ রাখে না , কোনো এক জায়গায় যখন ৪০ বছর বয়সি মহিলা ১০ বছরের বাচ্চা ছেলেকে বিছানায় জোর করে শোয়াচ্ছে । আবার কোথাও কোনো এক কলেজের হস্টেলে , একজন সমকামী মেয়েকে আর চার পাঁচটা মেয়েরা মিলে অত্যাচার করছে । হ্যাঁ , আমি ধর্ষণ কে ঘৃণ্যতম অপরাধ মনে করি ঠিক যতটা ঘৃণ্যতম কাজ মনে করি psedofeminism কে । আরে পুরানেও তো দেখা গেছে রাধার স্বামী ছিল নপুংশক আর বাকি ঘটনা তো আমরা জানি । এইটা শুনে ওরা বলবে এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা । কটা এইরকম ঘটনা মিডিয়ায় প্রকাশ পায় । আরে এখন তো এরকম অবস্থা হয়ে গেছে যে , ভিড় বাসে যদি আমার গায়ের ঘাম একফোঁটা কোনো মেয়ের গায়ে পড়ে , তাহলে আমি চরিত্রহীন আর আমায় চড়-থাপ্পড় মেরে মেয়েটা একজন আইকনিক লডি হয়ে যেত । আর আমরা বা কোনো ছেলে করলে ? ছাড়ুন আর নাই বা বললাম । চলুন আপনার দেরি হয়ে যাচ্ছে আপনাকে এগিয়ে দিই । ’

বস্তির গলি পেরিয়ে মেন রোডে উঠলাম । শীর্ষেন্দু দা একটা ট্যাক্সি ধরে দিলেন ।
—‘সময় পেলে আবার আসবেন ম্যাডাম । ভালো থাকবেন , চলি । ’
ধীরে ধীরে আবার ঐ সরু গলির মধ্যে মিলিয়ে গেলেন । ট্যাক্সি চলতে আরম্ভ করলো ।

(শহরে মেঘ করেছে , খুব গুমোট , কালো মেঘগুলো একজায়গায় বোধহয় অনশনে বসেছে । আচ্ছা মানুষের কাছে লিঙ্গ নির্ধারণ টাই আসল কাজ ? তার মন , তার কাজ কি কিছুই প্রভাব ফেলে না ? আরে সমকামিতা টা তো কোনো নতুন জিনিস নয় , পুরানে একাধিক বার এইসব প্রসঙ্গ এসেছে তবুও কেন যে আমরা বুঝতে চাই না । সমকামীতা শব্দটা শুধু একটা বিতর্কিত শব্দ হিসাবে থেকে গেল খুব কমজনই ভালোবাসা দিয়ে ব্যাপারটাকে বুঝেছে । )
বাড়ী পোঁছলাম । গেট টা খুলেই দেখি মা লালমুখ করে দাঁড়িয়ে । এইরে এইবার শুরু হবে কি জানি আজ ভাগ্যে কি আছে ?
—‘অ্যাই তিতির কোথায় ছিলিস এতক্ষণ ? সেই কখন বেরিয়েছিলি । কি করছিলিস এতক্ষণ ?’
—‘মা , আমি তো তোমায় বলেই গিয়েছিলাম—’
—‘অ্যাই একদম মিথ্যে কথা বলবি না , আমি তোর মা । সত্যি করে বল কোথায় ছিলি এতক্ষণ ? নাহলে —’
(এইরে মনে হয় ধরা পড়ে গেছি । না সত্যিটা বলেই দিই । )
—‘আসলে মা কাল তোমার সাথে যে ট্যাক্সিতে আসছিলাম ওটায় আমি আমার ডায়েরিটা ছেড়ে এসেছিলাম । তুমিও বোধহয় মনে করে আনোনি , তো কাল রাতে ঐ ট্যাক্সি ড্রাইভারটা ফোন করেছিল আর বললো সময় করে মিয়ে যেতে তাই—’
—‘দাঁড়া , দাঁড়া কি আবোলতাবোল বকছিস তুই ? মাথা ঠিক আছে তো তোর ? ঐ ডায়েরিটা তুই ফেলে এসেছিলি ঠিকই কিন্তু আমি মনে করেই নিয়ে এসে তোর পড়ার টেবিলের ড্রয়ারে ঢুকিয়ে রেখেছিলামষ। আজ সকালেও তুই বেরিয়ে যাওয়ার পর আমি ঘর গোছাতে গিয়ে দেখিছিলাম ওটা ওখানেই ছিল—’
—‘কি বলছো তুমি এইতো আমার ডায়েরিটা—’
(একি কোথায় গেল ডায়েরিটা ? ব্যাগের মধ্যেই তো ছিল । মাথাটা ঝিমঝিম করতে আরম্ভ করলো । একদৌড়ে ঘরের ভিতর গিয়ে ড্রয়ারটা খুললাম , দেখলাম সত্যিই ডায়েরিটা ড্রয়ারে রাখা আছে । তাহলে কাল রাতে কে ফোন করেছিল ? মোবাইলের কললিস্ট চেক্ করে দেখলাম , কাল রাতে আমায় কেউ ফোন করেইনি । একি কি করে সম্ভব ! এটা কি করে হলো ? ঐ বস্তি , শীর্ষেন্দু দা সবাই—সবাই কি ? আমার কান্না পাচ্ছে , আাস্তে চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসছে । না , আমায় আবার ঐ বস্তি টায় যেতে হবে , সব প্রশ্নের উত্তর ওখানেই আছে । একদৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আমি রাস্তায় এলাম । আজ আমি প্রমাণ করেই ছাড়বো আমি পাগল না । পেছনে মা চেঁচাতে চেঁচাতে ছুটে আসছে ‘ তিতির কোথায় যাচ্ছিস ? ফিরে আয়—’ । আমায় থামলে চলবে না । ঐতো একটা ট্যাক্সি রাস্তার ওপারে , ওটাকে ধরতে । ছুটে রাস্তা পার করতে হবে নইলে ওটা পালিয়ে যাবে । দৌড় শুরু করলাম , সবে রাস্তার মাঝখানে হঠাৎ শুনতে পেলাম , অনেকগুলো গলা একসাথে চেঁচিয়ে উঠলো -‘দেখে,দেখে গাড়ি, সরে যাও ওখান—’ । সবাই আজ আমায় থামানোর তালে কিন্তু আজ তিতির থামবে না । ছুটতে ছুটতে একবার ডানদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম , লাল ম্যাটাডোর গাড়ি তীব্রবেগে আমার দিকে ধেয়ে আসছে । কি করবো ? থমকে দাঁড়ালাম , খুব হাসি পাচ্ছে , একবার আকাশের দিকে তাকালাম , গুমোট ভাব কেটে বৃষ্টি শুরু হয়েছে । দু-এক ফোঁটা বৃষ্টি মুখে মাখলাম । গাড়িটা আরো আমার কাছে চলে এসেছে , মা ভালো থেকো , বাবা পরের বার অন্তত আমায় একটু আদর করো , খুব ভালোবাসি তোমাদের । শুধু কতগুলো প্রশ্নের উত্তর পেলাম না । আর কিছু রয়ে গেল ভাবা ? না মোটামুটি সবই ভেবে নিয়েছি বৃষ্টির বেগটা আরো বাড়লো তাহলে একটু সিনেমার স্টাইলে কাউন্ট করি সময় ১০ , ৯ , ৮ , ৭ , ৬ , ৫ , ৪ , ৩ , ২ , ১ ……

বৃষ্টির জল গুলোতে যেন কেউ আজ আলতা মিশিয়ে দিয়েছে । শহরে বৃষ্টি নেমেছে অনেকক্ষণ হলো । স্ট্রীটলাইটগুলো অকারণে জলছে আবার নিভছে । ফুটপাতগুলো অনেকক্ষণ ধরে সঙ্গীহীন । শুধু পার্কের ফাঁকা বেঞ্চটা—

Facebook Comments Box

By Staff Writer

Editorial Team of LaughaLaughi

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *