আজ সকাল থেকেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। আকাশেতে জমে আছে ঘন কালো মেঘ। এখনও ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা আছে।
সাজি দোকানে একলা ঠাঁই বসে আছে। সকাল থেকে একটাও কেউ আসেনি ফুল কিনতে। এই বৃষ্টির সকালে কেই বা আসবে ফুল কিনতে!
সাজি হলো গিয়ে এ পাড়ার মিত্তিরদের বাড়ির মেয়ে। বয়স ২৫ কি ২৬ হবে। তার বাবা ফুল ব্যাবসায়ী। দোকানটি তাদের নিজস্ব।
এখন পড়াশোনা প্রায় বন্ধ “করোনা প্রবাহের” জন্য, তাই একটু দোকান টাই দেখাশোনা করে সে, তাছাড়াও কয়েকদিন যাবত বাবার শরীর টাও খুব একটা ভালো নেই।
মন্দ লাগে না সাজির, দোকান দেখভাল করাটা, বরং একটু বেশিই যেন ভালো লাগে তার। এক-ঘর ভর্তি নানাবিধ ফুলের মাঝে বসে থাকতে থাকতে নিজেকে মনে হয় যেন একটা আস্ত ফুলপরী।
ফিক করে হাসলো সাজি।
তাছাড়া, আরও একটি কারন আছে, দোকান থেকে ও-পাড়ার ঋষি দা কে মাঝে – মধ্যেই দেখতে পায় যে। তাই আর কি, এই সুযোগ টা সে কোনোমতেই হাতছাড়া করতে চায় না।
কিন্তু, আজ সেই যে সকাল থেকে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হলো, থামার যেন নামই নেই।
এই বৃষ্টি মাথায় নিয়ে কি আর ঋষি দা বাড়ির থেকে বেরোবে! তাই সাজির মুখটাও গোমড়া হয়ে গেল।
এইসব ভাবছে আর কি, এমন সময় কে যেন তাকে নাম ধরে ডাকলো। তড়িঘড়ি কল্পনার রেশ কেটে দোকানের জমিতে ফিরে এলো সাজি।
সামনে চোখ তুলে তাকাতেই, চোখ একেবারে ছানাবড়া, এ কাকে দেখছে সে, এ যে স্বয়ং তার স্বপ্নের রাজপুত্তুর… ঋষি দা! সাজি যেন স্বপ্ন দেখছে। – একটা নীল-আকাশি রঙের টি-শার্ট, সাথে গ্রে কালারের ট্রাউজার। হাতে সেই মোহান্বিত করা গোল্ড রিস্টওয়াচ। উফফ! এত্তো সুন্দর লাগছে, যে কি আর বলবে.. যেন, নীল-রাজ্যের রাজপুত্তুর।
নিজের চোখ কেই যেন ঠিকমত বিশ্বাস করতে পারছে না সে। ক্যাবলার মতো হাঁ করে তাকিয়েই আছে সাজি সেই নীল-রাজ্যের রাজপুত্তুর এর দিকে। ইচ্ছে জাগছে একটু স্পর্শ করতে।
মনের ইচ্ছা মনেই রাখতে হয় হয়তো অনেক সময়।
বাইরে তখনও অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরেই চলেছে একটানা।
ছাতাটা বন্ধ করতে করতেই বললো ঋষি, –হ্যালো… ম্যাডাম!…
সম্বিত ফিরল সাজির। ভালো করে একটু তাকিয়ে দেখলো ঋষি দা বোধহয় টের পেয়েছে তার এই অবাকদর্শিতাই। খানিক লজ্জা পেল সাজি। মুখে হাসির রেখা টেনে বললো –বলো, ঋষি দা, এদিকে হঠাৎ?
সহাস্যে ঋষি দা বললো – হঠাৎ কি রে, ফুল কিনব কিছু।
শেষের কথা গুলো এতো নিচু স্বরে বললো যেন একটা রাখঢাক ব্যাপার আছে।
– বলো, কোন ফুল তোমার পছন্দ? লজ্জা মাখা সুরে বললো সাজি।
সাজিদের এই ফুলের দোকানটি আয়তনে খুব ছোটো হলেও, এ তল্লাটে বেশ প্রসিদ্ধ।
সবধরনের ফুল পাওয়া যায় বললে হয়তো ভুল হবে, বলা উচিত কোনধরনের ফুল পাওয়া যায় না।
গোলাপের তো জুড়ি মেলা ভার, সবধরনের গোলাপ পাওয়া যায়। বেলি – জুঁই – টগর – রজনীগন্ধা – সূর্যমুখী – ডালিয়া – চন্দ্রমল্লিকা – মল্লিকা – কেতকী আরও কতো কি। এমন কি বিদেশি ফুলও পাওয়া যায় মাঝে সাঝে। যেমন এখন এই সিজেনে অর্কিড আছে।
আর ফুল গুলো এতো সুন্দর ভাবে সাজানো থাকে যে, পথচারীরা পার হওয়ার সময় এই দোকানের দিকে দু-দন্ড মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে থাকে।
–আমাকে ওই লাল-গোলাপটা একগুচ্ছ দাও তো, আর হ্যাঁ সাথে কয়েকটা অর্কিডও দিও।
কি যেন একটা ভেবে নিয়ে বললো ঋষি দা। আড়চোখে তাকিয়েও বেশ টের পেলো সাজি।
মনের মধ্যে না-জানি কেন, কেমন একটা কাঁটার মতো খচখচ করতে শুরু করে দিলো সাজির।
ভ্রু-কুঞ্চিত ভাবে একবার ভালো করে তাকালো ঋষি দার দিকে। কিছু একটা আন্দাজ করার চেষ্টা করল সে, কিন্তু কিছু বুঝে উঠতে পারল না।
শুধু এটুকু বুঝলো যে, তার স্বপ্নের নীল-রাজ্যের রাজপুত্তুর যেন একটা চাপা উত্তেজনার মধ্যে আছে।
বারবার তার চোখ দুটি ইতিউতি কি যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে।
আনন্দের রেশটা এতোক্ষনে কেটে গেছে সাজির। ফুল গুলো কাগজে প্যাকিং করতে করতে সাজি বললো, –তুমি কি এখন কোথাও যাচ্ছো?? ঋষিদা!
–হু… হ্যাঁ… আরে না না। তোমাকে ফুল গুলো প্যাকিং করতে হবে না, ও তুমি এমনিই দাও।
কিছুটা আনমনেই বললো ঋষি।
খুব দ্রুত সাজির হাত থেকে ফুল গুলি নিয়ে টাকাটা দিয়ে, বৃষ্টির মধ্যে ভিজতে ভিজতে হনহন করে বৃষ্টির মধ্যে মিলিয়ে গেলো। সাজি লক্ষ্য করলো ঋষি দা মেঘনা দের বাড়ির ওপাশে, যে- দিকে বকুলদিঘি আছে সেদিকে মিলিয়ে গেলো ক্রমশ।
এমা! যা! ঋষি দা তো ছাতাটা দোকানেই ভুলে গেলো। এই আকাশ – ভাঙা বৃষ্টিতে ভিজে তো একেবারে কাক হয়ে যাবে।
ভাবতেই সাজির মনটা বড্ড উচাটন হয়ে উঠলো। বৃষ্টিতে ভিজে শেষমেশ যদি অসুখ বাঁধায়?
চিন্তায় কপাল কুচকালো। চিন্তা হবে নাই-ই বা কেন? মনে মনে যে ভালোবাসে সে তাকে।
সেই ক্লাস সেভেনে পড়াকালীন, একবার টিউশন থেকে বাড়ি ফেরার পথে, এমনি এক বৃষ্টি ভেজা দিনে, একই ছাতার তলেই ঘেঁষাঘেঁষি হয়ে হেঁটেছিল যে তারা। ভুলবশত সেদিন ঋষি দার আঙুল তাকে ছুঁয়ে দিয়েছিল অজান্তেই। সেই-ই দিনেই তো তড়িৎ পিষ্ট হয়েছিল সাজি। মনে পড়তেই শরীরে যেন বিদ্যুৎ প্রবাহ বয়ে গেল।
ভাবনার রেশ কাটিয়ে উঠে, পাশের মুদির দোকানের ছটু কে দোকানের দেখভালের দায়িত্ব দিয়ে বেরিয়ে পড়ল সে, তার নীল-রাজ্যের রাজপুত্তুর এর খোঁজে।
এতোক্ষণে বৃষ্টির রেশ টা দ্বিগুণ বেড়েছে।
মাথা – ভাঙা বৃষ্টি মাথায় নিয়ে এগিয়ে চললো সে ঋষি দা যেদিকে গেছে সেইদিকে অর্থাৎ বকুলদিঘির দিকে।
বকুলদিঘি আসা পর্যন্ত সব ঠিক ছিল।
সবকিছু তছনছ হয়ে গেলো, যখন তার আঁখি জোড়া তার নীল-রাজ্যের রাজপুত্তুর কে খুঁজতে খুঁজতে দিঘির পাশের বিরাট বকুল গাছটার কাছে গিয়ে থমকে গেলো।
মাথার সব-কটা তার যেন একসাথে ছিড়ে যেতে লাগলো। নিজের চোখকে কিছুতেই যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না সাজি।
তার চির-কল্পিত পুরুষ, যাকে সে এতদিন যাবত একমাত্র ও অদ্বিতীয় প্রেমিক ভেবে এসেছে, জ্ঞান হওয়া অব্দি থেকেই,সেই নীল-রাজ্যের রাজপুত্তুর এক অন্য রাজকন্যার ঠোঁটে চুমু এঁকে দিচ্ছে।
হ্যাঁ.. এ… তো পাশের বাড়ির মেঘনা দি!
কী আশ্চর্য!! তাহলে কি তার নীল-রাজ্যের রাজপুত্তুর এতোদিন ধরে মেঘনা দি কেই ভালোবেসে এসেছে… তাকে নয়??!! উফফ! জাস্ট আর ভাবতে পারছে না সাজি। নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হচ্ছে তার, সবকিছু ভেঙে গুড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করছে।
বৃষ্টির রেশ টা আরও জোরালো হচ্ছে। সাজির কান্না গুলো ধুয়ে মুছে সাফ করে দিচ্ছে।
আর সাজি এই অঝোর বারিধারার আবছা আলোয় দেখতে পাচ্ছে – দূরে, বকুল গাছের নীচে দুজন প্রেমিক যুগলের আত্মমিলন।
নীল-রাজ্যের রাজপুত্তুরের হাতের সেই একগুচ্ছ ফুলের তোড়া একে একে ঢলে পড়ছে। আর মেঘনা দি কে লাগছে যেন জলপরী।
সেই জলপরীর নীল সাদা ফেনা যুক্ত ওড়না টা ভিজে চুপসে গিয়ে আঁটকে গেছে নীল-রাজ্যের রাজপুত্তুরের হাতের রিস্টওয়াচে।
ওরা একে – অপরের ঠোঁটে ডুবে যাচ্ছে ক্রমশ।
শরীর টা ক্রমশ অবশ হয়ে আসছে সাজির।
চোখের সামনে দেখছে নিজের তিল তিল করে গড়ে তোলা স্বপ্নেরা এক নিমেষেই কেমন ভেঙে গুড়ে ধূলায় মিশে যাচ্ছে।
ওদের আর ডাকলো না সাজি, ওরা দুটিতে মনের সুখে প্রেম করুক এই বৃষ্টি ভেজা মরশুমে। ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসে সবকিছু।
বৃষ্টির রেশ আরও একগুন বাড়লো যেন… বাড়তেই থাকলো আর বাড়তেই থাকলো….।।