দুই পৃথিবী মানে দুটো আলাদা পৃথিবী নয়, একই পৃথিবীর মধ্যে অবস্থিত দুটো জগৎ মাত্র।এই সহজ কথাটা দিলীপ বুঝতে পেরেছিল প্রথমবার দিঘার সমুদ্র সৈকতে গিয়ে।

দিলীপ মিস্ত্রি, ডায়মন্ড হারবারের ছোট্ট একটা মফঃস্বলের বাসিন্দা দিলীপ পেশায় রাজমিস্ত্রি। সেই কোন ছোটবেলায় পেটের দায়ে বাবা সঙ্গে নিয়ে গেছিল ইমারত তৈরির কাজে তারপরে আর সেই থেকে বেরোনো হয়নি দিলীপের।যখন তার বয়সী ছেলেমেয়েরা বইয়ের বস্তা কাঁধে নিয়ে স্কুলে যেতো,দিলীপ তখন বালি সিমেন্টের বস্তায় ধুলো কাদা মেখে কাজে ব্যস্ত। যাই হোক, সেই ছোটবেলা কেটে আজকে যৌবনে পড়েছে দিলীপ।মা মাসীরা জোর করে একটা বিয়েও দিয়েছে তার।

টুসি, লাল টুকটুকে শাড়ি পড়ে বউ সাজে যখন দেখেছিল টুসিকে তখনই বুকের মাঝে কেমন যেন ধুকপুক করেছিল দিলীপের।যদিও লজ্জায় আজও সেই কথা কাউকে বলতে পারেনি সে। গরিব পরিবারের সাত বোনের মেজো বোন টুসি, সাত মেয়ের বোঝা যে তার বাবার কাছে হিমালয় পর্বতের ভারের তুলনায় কম কিছু নয় সেটা টুসি বুঝেছিল ছোট থাকতেই।

ফুলশয্যার রাতে লাজুক মুখে যখন দিলীপ জিজ্ঞেস করেছিল, “কোথায় ঘুরতে যেতে ইচ্ছে করে তোমার?” টুসি মিষ্টি হাসি হেসে লজ্জাভরা দৃষ্টি হেনে বলেছিল, “ছোট্ট থেকেই সমুদ্র দেখার খুব সাধ আমার জানো। ওই যে টিভিতে দেখায় না অনেক জলের মাঝে সবাই স্নান করছে, আমারও বড্ড সাধ জানো।তুমি নিয়ে যাবে আমায়?”

সেইদিন টার পরে কেটে গেছে তিনটে বছর।টুসির স্বপ্ন পূরণ করতে দিলীপ কতদিন যে খালি পেট কেবল জল দিয়ে ভরেছে, কতদিন বাসের বদলে সাইকেলের প্যাডেলে পা চালিয়েছে তার হিসেব না দেওয়াই ভালো।পুরুষ মানুষের ত্যাগ আর বিসর্জনের কাহিনী কেই বা কবে শুনেছে।

“এই জলের ফেনা গুলো দেখো, ঠিক যেন বুদবুদের মতো।আমার পায়ের তলার নিচে বালি গুলো কেমন গর্ত করে দিচ্ছে দেখো।হিহিহি, কি মজা…!” টুসির চঞ্চল গলার একরাশ আনন্দের বহিঃপ্রকাশ শুনেই সম্বিৎ ফেরে দিলীপের।টুসির এই এক ঝাঁক আনন্দের জন্য নিজের হাজারটা কষ্ট সহ্য করতে রাজি দিলীপ।সমুদ্রের অফুরন্ত জলরাশির কলকাকলির মাঝেই একটা চিৎকার দিলীপের কানে আসে।

” দিঘা নিয়ে এসে আবার বলছো কেমন লাগছে? সিরিয়াসলি!” সাধারণ গলার স্বরের থেকে বেশ কিছুটা উঁচু স্বরেই কথাটা বললো দিলীপের অনতি দূরেই দাঁড়ানো স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে স্ত্রীটি। তার স্বামী তখন এদিক ওদিক তাকিয়ে বেশ খানিকটা লজ্জায় পড়ে অবুঝ স্ত্রীকে বোঝানোর চেষ্টা করছে। “না না তুমি কি বলেছিলে উইকেন্ডে আমরা টাইম স্পেন্ড করতে যাবো আর নিয়ে এলে দিঘায়! এবার আমি ফ্রেন্ডদের কি বলবো!” হাত পা নাড়িয়ে যেন একরাশ অভিযোগের তীর ছুঁড়ে দিলো স্ত্রী তার স্বামীর দিকে।

“তুমি তো জানো এই মাসে একটু ফিনান্সিয়াল ক্রাইসিস আছে। আর আমাদের একসাথে টাইম স্পেন্ড করাটা আসল জায়গাটা নয়।” বোঝানোর যথাসম্ভব চেষ্টা করে বেচারা স্বামীটি। “জাস্ট শাট আপ নিল। আমি উইকেন্ডে হাজবেন্ডের সাথে দিঘা গেছি এটা বললে আমার প্রেস্টিজটা কি হবে সেটা বোঝার ক্ষমতা তোমার নেই।ধুর!গো টু হেল।” রাগ আর বিতৃষ্ণার পর্বত সমান বোঝা স্বামীর গায়ে ছুড়ে স্ত্রী সমুদ্র সৈকত ছেড়ে গটগট করে চলে যেতেই অসহায় স্বামীর মুখটা দেখে দিলীপের মনটা খারাপ হয়ে গেল যেন।

অজানা এক ঠান্ডা মন খারাপ করা স্রোতের মাঝেই যেন উষ্ণ স্রোত এসে ধাক্কা দিলো দিলীপের ঘাড়ে। “আরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছো কেন।চলো স্নান করবো। উফঃ কি সুন্দর এই সমুদ্র গো, আর তার চেয়েও সুন্দর এই পরিবেশ।আমার এত আনন্দ হচ্ছে এত আনন্দ হচ্ছে যে কি বলবো।তুমি খুব খুব খুব ভালো,আমায় এখানে নিয়ে এলে।”

এক লহমায় দিলীপের মনটা উচ্ছল আনন্দে ভরে ওঠে।টুসির অফুরন্ত খুশির মুখটা দেখেই দিলীপের মনে বদ্ধমূল ধারণাটা হয়ে যায়।কেউ যৎসামান্য জিনিসেই পৃথিবীর সব খুশি খুঁজে নেয় আর কেউ সবকিছু পেয়েও সেটা অনুভব করতেই পারেনা। সত্যি দুই পৃথিবী মানে দুটো পৃথিবী নয়, একই পৃথিবীর মাঝে দুটো জগৎ মাত্র।

© সম্পূর্ণা মজুমদার

Facebook Comments Box

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *