যমুনা এবাড়ির নতুন বউ, সবে বিয়ে হয়েছে। এইতো অষ্টমঙ্গলা পের করে কাল ই এলো মেয়েটা। শাশুড়ি তাকে সংসারে সব শিখিয়ে পড়িয়ে দিয়েছেন। বাড়ির কাজ কর্ম সবকিছুই। যমুনা ভারি মিষ্টি মেয়ে। সে একা হাতে সবকাজ কি সুন্দর করে গুছিয়ে নেয় তাড়াতাড়ি।
শাশুড়ির বয়স ভালোই, তাই যমুনা-ই প্রায় সব কাজ করে ফেলে।তবে মাঝে মাঝে শাশুড়িও পাশে থেকে সাহায্য করে দেন। সকাল সকাল যমুনা স্নান সেরে পূজো করে। এবং শ্বশুর, শাশুড়ি, স্বামী কে চা দিয়ে তবেই সে নিজে চা খায়। কিন্তু সেদিন সকাল সাতটা বেজে গেল, যমুনা নিজের ঘর থেকে বেড়োয়নি। স্বামী অনন্ত ও সেই দিন বাড়ি ছিলেন না।
(ছবি:-সংগৃহীত)
অফিসের কাজে আগের দিন-ই বাইরে চলে গেছিলেন। তাই যমুনা রাতে একাই ছিল তার ঘরে।শাশুড়ি ওদিকে হাঁক-ডাক শুরু করে দিয়েছেন,
“যমুনা, মা যমুনা..কি হলোরে? আজ চা টা কিছু দিলিনা, আমার তো চা ছাড়া মাথা ব্যাথা শুরু হয়ে যাবে।”না কোনো সারা নেই। ওদিকে যমুনা বিছানায় শুয়ে শুয়ে পেটে ব্যাথার যন্ত্রনায় ছটপট করছে। এবং মুখে কথাও বন্ধ হয়ে গেছে।
স্বামীও কাছে ছিলনা। তাই কিছু বলতে ও পারছিলনা। আর ওইভাবে তার উঠে দাঁড়ানোর ও ক্ষমতা ছিলোনা। যমুনা ভয় ও পেয়েছিলো। এসব কথা তার শাশুড়িকে বলতে ও লজ্জা পাচ্ছিল। তাই উঠে আসতেও পারছিলো না। বললে আবার কি ভাববেন। ততক্ষনে পরনের কাপড় এবং বিছানা সমস্ত লাল বর্ণে ভিজে গেছে। তাই যদি চিৎকার করেন শাশুড়ী! এই ভেবে সে আরও কুঁকড়ে গেছিলো।
(ছবি:-সংগৃহীত)
কিন্তু না, তার সব ভ্রান্ত ধারণা তার শাশুড়ি সেদিন ভাঙিয়ে দিলেন। না না, সেদিন যা ঘটেছিলো তা যমুনা কোনোদিন কল্পনা ও করেনি।
শাশুড়ি ও তো মা, তাই হাজার ডাকাতে যখন সারা পায়নি তখন তিনি কিছুটা হয়তো আন্দাজ করতে পেরেছিলেন। যে কিছু নিশ্চয় সমস্যা হয়েছে। কারন যমুনা তো অবাধ্য কোনোদিন ই হয়নি।
তাই তিনি ই উপরে উঠে এসে রুমে গিয়ে দেখেন যমুনা শুয়ে কাতরাচ্ছে এবং কাঁদছে। বিছানা এবং তার পোশাক লাল দাগে ভরে গেছে। কিন্তু এতে তেনার এতটুকুও খারাপ লাগেনি। তিনি যমুনা কে এ ব্যাপারে কিছু না বলে বরং তারপর তাড়াতাড়ি নীচে এসে রান্নাঘর থেকে দুধ গরম করে যমুনার কাছে গেলেন।
(ছবি:-সংগৃহীত)
দেখে অবাক যমুনা, ওই অবস্থাতে ই উঠে বসার চেষ্টা করতেই তার শাশুড়ি তাড়াতাড়ি গিয়ে তাকে ধরলেন এবং গরম দুধটা আর ওষুধ টা খাইয়ে দিলেন।তারপর তিনি তার কোলে শুইয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। তিনি বললেন “কেন যমুনা? কেন এত কষ্টেও ডাকোনি? আমাকে কি এসব বলা যায়না? কিছু যদি একটা হয়েই যেত…কতক্ষন থেকে এভাবে শুয়ে কাতরাচ্ছো। আমাকে একবার বলতে পারতে।”
তার লজ্জার কথা সে বললো। তারপর তার শ্বাশুড়ি ধমক দিয়ে বললেন,”ধুর ক্ষেপি, এটা লজ্জার ব্যাপার নয়, আমি তো তোর মা ই। তাহলে মাকে বলতে আবার লজ্জা কি? সারা পৃথিবীর মানুষ এটাকে সম্মান করে কারন এটাতেই জগতের সৃষ্টি। এটার ফলেই তো এতো এতো মানুষের সৃষ্টি হয় মা।আজ থেকে আর এ কথা বলবিনা।”
তারপর আস্তে আস্তে বেলা গড়াতেই কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠলো। সেদিন আর তাকে কোনো কাজ করতে হয়নি। বরং তার শ্বাশুড়ী ই তাকে চুল বেঁধে দিয়েছেন।নিজের হাতে খাইয়ে দিয়েছেন। শ্বাশুড়ি চুল বাঁধতে বাঁধতে বললেন,”সারা বাড়ির কাজ, আমাদের খেয়াল রাখা সব তুমি করো। আর তোমার অসুবিধা হলে তোমার খেয়াল রাখা, তোমার পাশে থাকা সেটাও তো আমাদের কর্তব্য। তাই নয় কি? “সেদিনের এই কথা শুনে যমুনা পরম শান্তি পেল। এরকম শ্বাশুড়ি পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। যমুনা সত্যি ই ভাগ্যবতি।
সেদিন যমুনার তিনদিন। পূজোতে তো কিছু এবার আর সে ছুঁতে পাবেনা। তাই সকাল থেকে মনটা খারাপ যমুনার। বিয়ের পর শ্বশুর বাড়িতে এটাই প্রথম লক্ষ্মী পূজো। আর ওর শ্বশুরবাড়ির লক্ষ্মী ওইতো। খুব সখ ছিল প্রথম পূজোয় পাঁচালি টা ও-ই পড়বে। কিন্তু তা আর হবে না এবার। নিজেই মনমরা হয়ে নিজের রুমে বসে ছিল।
ওদিকে শ্বাশুড়ি ও তার একমাত্র বৌমা কে পূজো করাবে বলে মনে মনে ভেবে রেখেছেন। কিন্তু তেনার এসবে কিছু যায় আসে না, ঠিক তেমনটাও নয়।আসলে তিনি জানতেন যমুনার মন খারাপ হবে। তাই ওর কথা ভেবেই রাজি হয়েছিলেন। তাই তিনি যমুনার রুমে গেলেন এবং বললেন “যমুনা…ও যমুনা…নে নে মা এবার চল দেখি,অনেক কাজ বাকি? পূজোর জোগাড়টা করবি চল দেখি।কি হয়েছে? এভাবে এই সময়ে একা মুখ গোমরা করে বসে আছিস? শরীর ঠিকাছে তো?”
এসব শুনে যমুনা হকচকিয়ে উঠে বসে বলে উঠলো “মা,আমি… মানে… পূজো…,এই অবস্থায়…!!! “শাশুড়ি বললেন “হ্যাঁ, আমি তো এবার লক্ষ্মী পূজোটা তোকে দিয়েই করাবো, তুই আমার ঘরের লক্ষ্মী এখন থেকে। তুই করবিনা তো কে করবে?এবারে পাঁচালী টা তুই পড়বি। কে বলেছে এ অবস্থায় পূজো করা যায়না? শোন মন পবিত্র হলেই সব ঠিক।ওগুলো সব ভুল ধারনা। মা লক্ষ্মী ও তো মেয়ে। তিনি সব বুঝবেন। আর তাছাড়া আমি হাঁটু ব্যাথা নিয়ে বসতে পারবোনা।”
(ছবি:-সংগৃহীত)
তাও যমুনা বলতে লাগলো মা এই ভাবে…..
তার শ্বাশুড়ি থামিয়ে দিয়ে একটা লাল পাড় শাড়ি এনে দিয়ে বললেন “এবারের লক্ষ্মী পূজো আমার বাড়ির লক্ষ্মী ই করবে। আমি আর কিছু শুনবো না।ওরে পাগলি, এটা খারাপ কিছু নয়রে। এটা থেকেই তো আমার ঘরে আবার একটা নতুন লক্ষ্মীর আবির্ভাব হবে।”
সে আর কান্না ধরে রাখতে পারলোনা।সে ছুটে গিয়ে তার শাশুড়িকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো।
সত্যি সে ভাগ্যবতী। যমুনা কল্পনা তেও ভাবেনি এভাবেও সে পূজো করতে পারবে। তার শ্বাশুড়ীর জন্য তার মনের ইচ্ছা ও আজ পূরন হতে চলেছে।
সত্যি ই তো কজন পারে এমন? কজনের কপালে জোটে এত সুন্দর ভাগ্য? আর মন পবিত্র হলেই চলে।এসব কিছুই যায় আসে না।
(ছবি:-সংগৃহীত)
অবশেষে যমুনা ই লক্ষ্মীর পাঁচালি পড়লো সব মনের কুসংস্কার ভুলে। শ্বাশুড়ির দেওয়া লাল পাড় শাড়ি, কপালে সিঁদুর এবং পায়ে আলতা পড়ে পূজোর ঘরে এল যমুনা। সত্যি,পুরো যেন লক্ষ্মী প্রতিমা। দূর থেকে শোনা যেতে লাগলো যমুনার সেই পাঁচালীর আওয়াজ আর শঙ্খধ্বনি…
“দোল পূর্ণিমার নিশি নির্মল আকাশ ।
ধীরে ধীরে বইতেছে মলয় বাতাস ।।
বৈকুন্ঠেতে একাসনে লক্ষ্মী নারায়ন ।
করিতেছে কত কথা সুখে আলাপন ।।”