আমি তিন্নি | তিন্নি, নামটা বড্ড আদুরে তাই না? সত্যিই বাবাই আর মাম্মামের আদরের রাজকন্যে ছিলাম আমি। মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হয়েও বাবাই কোনোদিন অভাব কী জিনিস বুঝতেই দেয়নি। নিজের জীবনটা নিজের মতন করে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াতেও বাধা ছিল না কোনো, তা সে ছেলে বন্ধু হোক কিংবা আধুনিক পোশাক-আশাক। সবাই তো বলত আমি নাকি দেখতে সুন্দর, মাম্মাম বলত আমি নাকি বাড়ির “জ্যান্ত লক্ষী”।
ছাত্রী হিসাবেও খুব খারাপ ছিলাম না। মাধ্যমিক আর উচ্চ মাধ্যমিক দুইয়েই স্টার মার্কস আর স্কুলের মধ্যে ফার্স্ট। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে সবে তখন পা রেখেছি কলেজের দরজায়, রসায়ন বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। সবার জীবনে ঠিক যেমন প্রেম আসে ওই সময়ে, আমার জীবনেও এসেছিল, তবে প্রেম নয় অভিশাপ।
পাড়ার রমেন জ্যেঠার ছেলে চন্দন দা। বয়সে প্রায় বছর দশেকের বড়। একদিন তার নজর, বলা ভালো কুনজর পড়ল আমার দিকে। পাড়ার মোড়ের চায়ের দোকানের আড্ডাটাও যে আমার কলেজ বা টিউশনে যাতায়াতের সময়েই মূলত বসছিল, সেটাও বেশ টের পাচ্ছিলাম।
যাই হোক, একদিন সে আমায় প্রেম প্রস্তাব দিল। পছন্দ করতাম না কোনোদিনই, তাই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলাম, আর সেটাই হল কাল।
ঘটনার সপ্তাহখানেক পর সেদিন টিউশন থেকে পড়ে ফেরার সময় একটুখানির জন্য ট্রেনটা miss করলাম, তাই অগত্যা শেষ ট্রেনই ভরসা, ওতেই ফিরলাম। অন্যান্য দিন বাবা এসেই নিয়ে যায় স্টেশন থেকে, কিন্তু সেও আজ অফিসের কাজে পাটনা, তাই অবশেষে “একলা চলো রে…”
বুঝিনি রাস্তার ধারেরই কোনো এক অন্ধকারে পশুটা লুকিয়ে ছিল তার দলবল নিয়ে, নাহ্, সে রাতে আর বাড়ি ফেরা হয়নি আমার, পশুগুলো আমায় তুলে নিয়ে গেল ওদের মদের ঠেকে, তারপর পাঁচ-পাঁচটা পশু মিলে মদ আর মাংসের সাথে আমাকেও ছিঁড়ে খেল।
সে রাতে ওই পশুগুলোর সাথে একা লড়ে পারিনি নিজের কুমারীত্ব রক্ষা করতে। ওই মাঝরাতে আমার আর্তনাদও কারোর কানে পৌঁছালো না, সারা রাত ভোগ করেও যখন ওদের ক্ষিদে মিটলো না, তখন ভাঙা লাঠি, গাছের মোটা ডালের টুকরো, কাঁচের মদের বোতল কিছুই আর বাদ পড়ল না। শেষে যখন আমি নিস্তেজ, যোনি চুঁইয়ে রক্তের ধারা নামছে, ঠোঁটের কোল বেয়ে কষ গড়িয়ে পড়ছে তখন কে একজন যেন বলল্, “ছেড়ে দে এবার, মালটার শরীরের গরম ছুটে গেছে এতক্ষণে।”
সাময়িক রেহাই পেলাম আমি, পাছে আমি মুখ খুলি, তাই রুমাল পেঁচিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে মুখটাও চিরতরে বন্ধ করে দিল, তারপর কী করল? তারপর যতক্ষণ শরীরে তাপ ছিল, ততক্ষণ পর্যন্ত ওদের শরীরের ক্ষিদে মিটিয়ে লাশটাকে ঠেকের পাশের ডোবাটায় ফেলে দিল। জানিনা সে রাতে আমার বাড়ি না ফেরায় খোঁজ কতজন করেছিল, মা হয়ত একা একা খুব চিন্তা করেছিল, খুব কেঁদেছিল, তবে পরেরদিন আমার ওই বিবস্ত্র ছিন্নভিন্ন শরীরটা দেখতে বেশ ভীড় জমেছিল ডোবার পাশটায়।
পুলিশ এল তার স্বভাববশত সব শেষে। লাশ সনাক্ত হল, পাঠানো হল লাশকাটা ঘরে, ময়নাতদন্ত করার জন্য।
ধর্ষিতার লাশ তো তাই লাশ কাটা ঘরের ডাক্তার বাবুটাও রেহাই দিল না আমার লাশটাকে, অবশেষে সাদা ব্যান্ডেজে মোড়া আমার কাঁটা- ছেঁড়া দেহটা পুলিশ তুলে দিল আমার পরিবারের হাতে।
বাড়ির “জ্যান্ত লক্ষী” সেদিন সাদা কাপড়ে জড়ানো কফিনবন্দী লাশ হয়ে বাড়ি ফিরেছিল। বাবাই আর মাম্মামের ওই অসহায় কান্না আমার ঠাণ্ডা প্রাণহীন নিথর লাশটার কানেও পৌঁছেছিল সেদিন। পুলিশ উপদেশ দিয়েছিল বাবাইকে, যেন এরপর আর কিছু করার চেষ্টা না করে, নয়ত একটা লাশ পড়েছে যেমন, তেমনই আরও দুটো লাশ পড়বে।
কিন্তু পাড়ার লোকগুলোর নজরে দোষটা কিন্তু আমারই ছিল। কারণ আমি ছোটো পোশাক পড়তাম, ছেলেদের সাথে মিশতাম, রাত করে বাড়ি ফিরতাম, চরিত্রেও নাকি দোষ ছিল আমার, তাই আমার উস্কানিতেই এমনটা একদিন হওয়ারই ছিল। হাসি পায় এখন, করুণাও হয় সমাজটাকে।
এ সমাজ ধর্ষককে ধারণ করতে পারে, আর আমার মতো কত শত ধর্ষিতা এভাবেই প্রতিদিন মিলিয়ে যায় রাতের অন্ধকারে। আমি হয়ত নিজের প্রাণের বিনিময়ে এই কলুষিত সমাজের থেকে মুখ লুকিয়েছিলাম, কিন্তু আমার মত কত শত তিন্নি পালাতে চাইছে নিজের অতীত থেকে… সমাজ, পরিবার, আত্মীয়স্বজন সবার কাছ থেকে। কিন্তু কোথায় যাবে সে? সে ঠিকানা যে তারও অজানা। শুধু এটুকু জানে তাকে পালাতে হবে। এই নোংরা সমাজের সাথে প্রতিনিয়ত লুকোচুরি খেলতে অক্ষম সে, ক্লান্তি তাকে গ্রাস করেছে। তাই তাকে হারিয়ে যেতে হবে। হারিয়ে যেতে হবে ওই সুদূরে..

Facebook Comments Box

By Staff Writer

Editorial Team of LaughaLaughi

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *