বৈধতার বেড়া ভেঙে কিছু সম্পর্ক অবৈধ অবলম্বন ধরেই লতানে গাছের মতো বেড়ে ওঠে। কিছুটা এক তরফা। এমনই একটি নাম বিহীন সম্পর্ক গড়ে উঠেছে এহানি, অঞ্জন ও প্রাপ্তির মধ্যে। তবে একে টিপিক্যাল ত্রিকোণ প্রেমের আখ্যা দেওয়া যায় না। অঞ্জনের প্রতি এহানির প্রথম থেকেই কৃতজ্ঞতা পূর্ণ একটা দুর্বলতা ছিল। অঞ্জনের ধীর-স্থির স্বভাব, সকলকে আগলে রাখার মনোভাব এহানির মনে কেমন যেন এক অন্য রকম ভালোলাগার অনুভূতি জাগিয়েছে। এই ন’বছরে এমন দিন খুব কম গেছে যেদিন অঞ্জন আশ্রমে থেকেছে অথচ এহানির খোঁজ নেয়নি। এই বিষয়টি যেন এহানির কাছে অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। মনে মনে অঞ্জনকে ভালোবেসে ফেলেছে সে।

এটি তো একটি ধারার কাহিনী, অন্য ধারায় বইছে অঞ্জন-প্রাপ্তির মিষ্টি মধুর বন্ধুত্বের সম্পর্ক। হয়তো বা সে সম্পর্ক বন্ধুত্বের থেকে খানিক বেশি কিছুই। অঞ্জনের নিজের বলতে সাত কুলে আর কেউ নেই, কেবল ওই মেয়ে— কুঁড়ি। কুঁড়ি প্রাপ্তিকে মাম্মাম বলে ডাকে। এই ডাকটাই যেন অঞ্জনকে স্বপ্ন দেখায়। প্রাপ্তি যেভাবে কুঁড়ির খেয়াল রাখে, ভালোবাসে হয়তো কুঁড়ির নিজের মা থাকলেও এভাবে পারতো না। প্রাপ্তি কি কোনদিন কুঁড়ির সত্যি সত্যি মাম্মাম হয়ে উঠতে পারে না? মনের মাঝে এক কল্পনার রাজ্য তৈরি করে অঞ্জন একটা সংসার বাঁধে। যেখানে প্রাপ্তি শুধু কুঁড়ির মাম্মাম নয়, অঞ্জনের স্ত্রী। আবার পরক্ষনেই স্বপ্ন ভেঙে ছারখার করে দেয় অতীতের কতকগুলো তিক্ত স্মৃতি। স্ত্রী! স্ত্রী শব্দটিকে অঞ্জন আর বিশ্বাস করে না। সম্পর্ক যতদিন বন্ধনের বাইরে থাকে ততদিন সেটা শ্বাস নিতে পারে, বেঁচে থাকে; আর যখনই কোনো একটা নামের প্যাঁচে বাঁধা পড়ে তখন থেকেই কেমন যেন হাঁপিয়ে ওঠে, মুক্তি চায়।

এহানি, প্রাপ্তি কেউই যখন কুঁড়িকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বেড থেকে তুলতে পারলো না, তখন মেয়ের বাবা এসে মেয়েকে আদর করে মান ভাঙিয়ে রাজি করালো। এহানি সাজিয়ে গুছিয়ে রেডি করে দিল। হোয়াইট ডান্সিং ফ্রকে পরীর মতো লাগছে কুঁড়িকে। দীনেশ বাবু সুন্দর সুন্দর অর্কিড দিয়ে মালা গেঁথে এনেছেন কুড়ির জন্য। প্রাপ্তি বার্থডে গার্লের একটি পনি টেইল বেঁধে তাতে অর্কিডের মালাটি লাগিয়ে দিল। তাতেই এক মুখ হাসির জোয়ার।

বাস চলল মিরিকের পথে। সারি সারি চা বাগান পিছনে ফেলে এক সময় পৌঁছে গেল মিরিকে। হালকা ঠান্ডার আমেজ, কুয়াশা কেটে রোদের আভা ফুটছে সেই মাত্র। যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। চারিদিকটা ছবির মত সুন্দর। ৮০ ফুট দৈর্ঘ্যের আর্চ ইন্দ্রেনি পুলের ওপর থেকে সুমেন্দু হ্রদ বা মিরিক লেকের সৌন্দর্য দেখে সবাই আনন্দে-মজায় মেতে উঠলো। জলের মধ্যে খেলা করছে ঝাঁক ঝাঁক রঙিন মাছ। খাবার জিনিস ফেললেই তাদের কলা কুশলী লাফ-ঝাঁপ। কি যে দুর্দান্ত লাগছে! বাচ্চারা তো পুল থেকে সরতেই চাইছে না। কুঁড়িও খুব আনন্দ পেল। ওর মুখের এই নির্মল হাসি অঞ্জনের মনে প্রাপ্তির প্রতি আরেকটু দুর্বলতা তৈরি করে দিল। কারণ মিরিক আসার প্ল্যানটা প্রাপ্তির।

পাশেই সাবেত্রী পুষ্প উদ্যান। সেখানে ঘোড়ায় চড়ার ব্যবস্থাও আছে। সবুজ মাঠে সাদা সাদা লোমশ ঘোড়া, চারিদিক পাহাড়ে ঘেরা। চোখে শান্তির প্রলেপ। দূরে কাঞ্চনজঙ্ঘা উঁকি দিচ্ছে। নানা গল্প কথায় ললিতা মিস সবাইকে চমকে দেওয়ার মতো একটি খবর দিলেন— অঞ্জন ঘোড়া ছোটানোয় ওস্তাদ। সবাই তো সিনেমার হিরো দেখার মতো করে অঞ্জনের দিকে তাকালো।সবার দাবি অঞ্জনকে ঘোড়ায় চড়তে হবে। প্রথমে রাজি না হলেও শেষ মেশ রাজি হল। কারণ প্রাপ্তি অনুরোধ করেছে। যদিও অঞ্জনও একটি শর্ত রেখেছে— প্রাপ্তিকে সন্ধ্যার অনুষ্ঠানে একটি গান করতে হবে। প্রাপ্তি রাজি। হঠাৎ বায়না জুড়ে বসলো কুঁড়ি। মাম্মামকেও পাপার সঙ্গে ঘোড়ায় চাপতে হবে। কুঁড়ির এই আবদারটা এহানি ঠিক মানতে পারলো না। মনে মনে একটু রাগ হল। তবে ওর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল অঞ্জন এই কথা লজ্জায় এড়িয়ে যাবে। কিন্তু না, হল ঠিক তার বিপরীত। বরং অঞ্জন দ্বিগুণ উৎসাহে বলল, “হ্যাঁ প্রাপ্তি, আপনিও আসুন। আপনার ঘোড়ায় চাপাও হবে, আর কুঁড়িও আনন্দ পাবে।” এহানি যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। যে শান্ত-শিষ্ট, লাজুক অঞ্জনকে সে চেনে সেই কি কথাগুলো বলল! এহানি আরো অবাক হল, যখন বিনা আপত্তিতে প্রাপ্তি রাজি হয়ে গেল। এগিয়ে গিয়ে ডান হাতটা বাড়িয়ে দিল অঞ্জনের দিকে। ঘোড়ার খুরে যে খটখট শব্দ উঠছে তা যেন এহানির হৃদয় ভাঙ্গার শব্দ। মনে মনে সে কোথাও একটা দুমড়ে মুচড়ে উঠলো। মনের কোণে বিন্দু বিন্দু করে হিংসার রক্তক্ষরণ শুরু বুঝি এখান থেকেই।

ক্রমশ…

– অর্যমা

Facebook Comments Box

By Rikta Dhara

আমি বাংলা সাহিত্যের একজন গুণমুগ্ধ ছাত্রী। বর্তমানে লাফালাফির কন্টেন্ট রাইটার। লেখালিখির পাশাপাশি বিভিন্ন সৃজনশীল কাজ করতে ভালোবাসি। নিজের শৈল্পিক সত্তাটিকে সযত্নে লালন করি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *