source:-google images

দীপাবলি, আলোর উৎসব; চারিদিকে সারি সারি আলো জ্বলে রয়েছে, অমাবস্যার সব অন্ধকার ঘুচে গেছে সেই আলোয়। মা লাল পেড়ে সাদা-লালে ডোরাকাটা শাড়ি পড়ে তুলসীতলায় প্রদীপ জ্বালছে। দুপুরে রোদে দিয়ে রাখা বাজিগুলো বাবা বের করে এনেছে, এবার দুজনে মিলে খুব বাজি পোড়াবো আর তারপর নতুন জামা পরে যাব ঠাকুর দেখতে। কত্ত বড় বড় উঁচু উঁচু কালী ঠাকুর…

– “ওই মুখপুড়ি মাগী, ভরদুপুরে পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছিস যে, বলি গতর খাটিয়ে খেতে হবে তো নাকি? তোর মাসিক শেষ হল? ওদিকে বাবুরা যে উপবাসী হয়ে বসে আছেন।”
(ধড়ফড়িয়ে উঠে পড়লাম। নাহ্, ওগুলো তবে স্বপ্ন ছিল!)
– “মাসি, আমার মাসিক শেষ হয়েছে গো। এবার দুটো খদ্দের আমার ঘরেও পাঠিয়ো গো, নয়তো মা-মেয়েতে না খেয়ে মরবো যে। তার ওপর আবার সামনে কালী পূজো আসছে, মেয়েটা বড় বায়না ধরেছে বাজি কিনবে। খদ্দের না এলে তাকে বাজি কিনে দিই কী করে?”
– “হ্যাঁ, ঘরে যা, খদ্দের এলে পাঠিয়ে দেবো। আর মুখ-চোখ পরিষ্কার কর, সাজগোজ করে ঠোঁটে রঙ লাগা, আর গতরটাও মেজে নিস, নয়ত খদ্দের কী দেখে পয়সা দেবে তোকে? যা ভাগ এখন, বাবুদের আসার সময় হয়েছে।”
– “হ্যাঁ, যাচ্ছি। শালা এই চারদিনের আপদ যে কবে পিছু ছাড়বে! চারদিন কারবার বন্ধ রাখলে কি আর পেট চালানো যায়!”

হ্যাঁ, আমি পতিতালয়ে থাকা এক চরিত্রহীনা, নষ্টা মেয়ে, আপনারা যাকে বলেন ছোটোলোক বেশ্যা, আমি তাই। নিজের শরীর বেচে পেট চালাই। আমার শরীর বেচা টাকায় আমার মেয়ে ইস্কুলে যায়, আমরা মা মেয়েতে খেয়ে-পড়ে বাঁচি। তবে জানেন তো এই বেশ্যা পাড়ায় আমরা যারা থাকি, আমরা কিন্তু বেশিরভাগই আপনাদের সমাজের তথাকথিত ভদ্রলোকেদের প্রতারণার স্বীকার হয়ে এখানে এসে পড়েছি।

আমার তখন ১৫, সবে মাধ্যমিক পাশ দিয়েছি, বেনেপাড়ার রমেন দা-র বন্ধু রঞ্জন একদিন বলেছিল সে নাকি আমাকে ভালোবাসে। উঠতি বয়স তখন, তাই আগুপিছু না ভেবেই আগুনে ঝাঁপ দিয়েছিলাম। বাড়ির লোকজন সম্পর্কটা মেনে নিল না, ওর হাত ধরে পালিয়ে গেলাম বাড়ি ছেড়ে, আর তারপর ঠাঁই এই বেশ্যা পাড়ায়। তারপর দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেছে ৮-টা বছর। তারপর এক ভীনদেশীর ঔরসে আমার সোনাই পেটে এল। তারপর সেই ৮-৯ মাস কারবার বন্ধ, সে এক দিন গেছে বটে। তবে না, সোনাই আজও জানেনা কে ওর বাপ! আমিও সে মানুষটার মুখ ভুলে গেছি।
দেখেছেন এত কথা বললাম কিন্তু নিজের নামই বলতে ভুলে গেছি আপনাদের। আমি স্পন্দিতা দত্ত, বাবা-মা এই নামই দিয়েছিলেন কিন্তু দেখুন আজ সেটাই ভুলতে বসেছি। এই বেশ্যা পাড়ায় আমি সোনাইয়ের মা আর খদ্দেরদের কাছে চামেলি মণ্ডল।
যাই হোক, সামনেই তো আবার কালী পূজো আসছে, সাথে আবার দীপাবলি, শহরের রাস্তাঘাট কি সুন্দর রংবেরঙের আলোয় সেজে ওঠে, ঘরে ঘরে প্রদীপ জ্বলে, চারিদিকে কত আতসবাজি… জানেন আমার মা-ও দীপাবলিতে প্রদীপ জ্বালাতেন, আমরা আতসবাজি পোড়াতাম, কত আনন্দই না করতাম একসময়। আর আজ! হ্যাঁ, এ পাড়াতেও আলো জ্বলে, তবে ঘরে ঘরে প্রদীপ জ্বালে না কেউ এখানে। যাদের নিজেদের জীবন আঁধারে ঢাকা তাদের আবার দীপাবলি! তবে এই সময় ব্যবসা বেশ ভালোই হয়। উৎসবের সময় বড় বড় বাবুরা বেশী আসে, আর তাদের আবার চামেলিকে খুব পছন্দ। সবার চাই চামেলি, তাই সব সময় তৈরি থাকতে হয় আমায়, বড় ব্যস্ততা এই সময় আমার, আর সাথে আসে কাড়ি কাড়ি টাকা। তবে আমিও তো মানুষ, দিনের শেষে এই শরীর কেনাবেচার খেলায় আমিও ক্লান্ত হয়ে যাই, ঘরের কোণে কুঁকড়ে পড়ে থাকি। যখন বাইরে আতসবাজির সাথে সবাই উল্লাস করে তখন চামেলিরা হয়ত বা কারোর শয্যাসঙ্গিনী হয়ে তার অভুক্ত শরীরের ক্ষিদে মেটাতে ব্যস্ত, আবার কেউ বা ঘরের কোণে গুমরে মরে, চোখের জলে আশার প্রদীপ নেভায়। চামেলিরা নষ্ট, তাই ওদের পাড়ায় দীপাবলি আসে না, ওদের দীপাবলি হয় না।

– “এই চামেলি, কি রে তৈরী হলি? বাবু এয়েছেন, তোকে খুঁজছেন। আয় এদিকে, বাবুকে ঘরে নিয়ে যা। আরেক বাবু অপেক্ষা করছেন বাইরে। শোন, এ সময় কাউকে বেশীক্ষণ দিবিনা, জলদি ঘর ফাঁকা করবি।”
– “আহ্ মাসি, আমার কি আজ নতুন? প্রতিবার এক কথা বলো কেন? যাও বাবুকে চা-পানি দাও আমি আসছি তৈরি হয়ে।”

আমি যাই এখন, বাবু এসেছেন, ডাক পড়েছে, আর খদ্দের হল গিয়ে লক্ষী। এক বাবু বেরোলে আরেকজন ঢুকবে, আমার এখন আর কথা বলার সময় নেই।
তাহলে দেখলেন তো আমাদের দীপাবলি ঠিক কেমন হয়? এখন আসি, নয়তো মাসি আবার গাল পাড়তে শুরু করবে।

এভাবেই নিষিদ্ধপল্লীতে কেটে যায় কত চামেলির মতো মেয়েদের দীপাবলি। তাদের দীপাবলিতে থাকে না প্রদীপের আলো, থাকে না আতসবাজির আলোর রোশনাই। থাকে শুধু শারীরিক লেনদেন, হতাশা, কান্না আর কিছু চাপা দীর্ঘশ্বাস…

Facebook Comments Box

By Staff Writer

Editorial Team of LaughaLaughi

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *