LaughaLaughi

You Create, We Nurture

I got a story to tell

এমনটাও হয়

পেপারের একটা কাট আউট ফেসবুকে দেখে অগ্নি ভাবলো এমনটাও হয়! তারপর পঞ্চাশটা বন্ধুকে টেগ করে শেয়ার করে দিলো ফেসবুকে। ক্যাপশন দিল #towardsbrightfuture । আবার হোয়াটসঅ্যাপেও বন্ধুদের গ্রুপে শেয়ার করে সবাইকে রিকুয়েস্ট করল, ফেসবুকে পোস্টটা শেয়ার করার জন্য।সে রাতে হোয়াটস্যাপে প্রায় দুটো অব্দি অগ্নির তার বন্ধুদের সাথে আলোচনা করল,এরাজ্যে এমন নিয়ম চালু হওয়া উচিত কি উচিত নয়,সে নিয়ে। পরদিন রবিবার, অফিস যাওয়ার তাড়া নেই ।তাই গল্পটা বেশ জমিয়ে দিয়েছিল অগ্নি তর্ক-তরজায়। কিন্তু সকাল সাতটা বাজতেই না বাজতেই দরজায় ধাক্কা।

” দাদাবাবু, উঠুন, মাসিমা আপনাকে ডাকতে বলল।”
হাউজ হেল্পের বেসুরো গলা সকাল-সকাল শুনে বিরক্ত হয়ে উঠলো অগ্নি,খেঁকিয়ে বললো,
” আজ তো রবিবার,যা এখান থেকে। দরজা পেটাবে না বলছি, একদম।”

হাউস হেল্প মিনু বকবক করতে করতে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। কিছুক্ষণ বাদে মিনুর মাসিমা অর্থাৎ অগ্নি মা এসে একবার দরজার কড়া নেড়ে বলল,
” অগ্নি উঠে পরো।তোমার বাবা তোমাকে সপ্তাহ খানেক আগেই বলে রেখেছিলেন আজকের কথা। অনেক দূর যেতে হবে। আর আমরা আমাদের সব অ্যাপোয়েন্টমেন্ট ক্যানসেল করে দিয়েছি। দিনটা নষ্ট করে চলবে না। তাড়াতাড়ি উঠে পরো।”

মায়ের কথাগুলো কানে যেতেই, বিছানা ছেড়ে ধড়মড়িয়ে উঠে বসল অগ্নি।
“হ্যাঁ,বাবা তো আজকের কথাটা বলেছিলো গত সপ্তাহেই। না আর দেরী করা চলবেনা।বারাসাত তো এখানকার পথ নয়। অনেকটা যেতে হবে।” সকাল আটটার মধ্যে তৈরি হয়ে অগ্নি, ব্রেকফাস্ট টেবিলে।মা-বাবা দুজনেই তৈরি। অগ্নিদের বাড়িতে ডাইনিং টেবিলে খেতে খেতে কথা বলার রেওয়াজ নেই। তাই খাবার শেষ করে ওঠার সময় অগ্নির বাবা সীতেশ বাবু, অগ্নি ও অগ্নি মায়ের উদ্দেশ্য বললেন,
” বেরোনোর আগে লিভিং রুমে এসো সবাই।কথা আছে।”

আজ্ঞা অনুযায়ী লিভিং সভায় উপস্থিত হলে, সীতেশ বাবু অগ্নি ও তার স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বললেন, “সেখানে গিয়ে কোনো দেনা-পাওনার কথা হবেনা। মেয়েকে এক কাপড়ে নিয়ে আসব। এই কথাই যেন হয়।”
কথাটা শুনে, উচ্ছ্বসিত অগ্নি বলে উঠলো ,”আমারও তো তাই মত বাবা। কালকেই একটা পোস্ট শেয়ার করেছি ফেসবুকে। এসব থেকে বেরিয়ে আসা উচিত আমাদের এখন।”
অগ্নির উচ্ছ্বাসে এক মগ জল ঢেলে অগ্নির বাবা তাকে বললেন,
” তুমি ওখানে গিয়ে বেশি কথা বলবে না।যা বলার আমি আর তোমার মা ই বলবো। এমন কিছু করবে না যাতে তোমার বাবার ইমেজ খারাপ হয়। জানো তো আমাকে ইমেজ বেঁচে খেতে হয়। কথাটা যেন মনে থাকে।”
ডাক্তার মা ও প্রভাবশালী পলিটিশিয়ান বাবার সামনে বেশি কথা বলার সাহস করে না অগ্নি কোনদিনই। তাই মাথা নিচু করে মেনে নিল সবটা।

স্নিগ্ধা সুন্দরী,শিক্ষিতা,আর অগ্নির মতোই এমএনসি তে চাকরি করে।প্রেম হয়েছে অনেকবার কিন্তু কোনোটাই পাঁচ মাসের বেশি টেকে নি। তাই অগত্যা বিয়ের বয়স হলে, বাবা-মার কাধেই সব দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছিল স্নিগ্ধা। যোগ্য সুন্দরী মেয়ের জন্য পাত্র খুঁজতেও কোন খামতি রাখেনি স্নিগ্ধার বাবা। খুঁজে পেতে বনেদি পরিবারের ছেলে অগ্নি সম্বন্ধ নিয়ে এসেছিলেন। অর্থ,মর্যাদা,ক্ষমতা সবদিক দিয়ে যারা শক্তিশালী।বাবা-মায়ের নির্দেশ মতো অগ্নি স্নিগ্ধার বাড়ি গিয়ে, বেশি কথা বলছিল না। এদিকে স্নিগ্ধা ছটফট করছিল ওর সাথে কথা বলার জন্যে। অতশত না ভেবে স্নিগ্ধা বলেই বসলো,” আমাকে একটু একা কথা বলতে পারি কি?” তাদেরকে বাড়ির পেছনের বাগানে পাঠিয়ে দেওয়া হল একান্তে কিছু সময় কাটানোর জন্য। কথা বলে, দুজনকে দুজনের ভালো লেগে গেল। ফোন নাম্বার এক্সচেঞ্জ, হোয়াটসঅ্যাপ ফেসবুকে সবেতেই লিংক আপ হয়ে গেল সাথে সাথেই। ভালোলাগা ভালবাসায় কখন পরিণত হয়ে গেল কেউই বুঝতে পারল না। দু’মাসের মধ্যেই প্রেম জমে একেবারে ক্ষীর। এদিকে বিয়ের পিপারেশন শুরু হয়ে গেছে দু’বাড়িতে।স্নিগ্ধা মা, সোফা সেট, আলমারি, খাট, ডেসিন টেবিল ইত্যাদি ঘরকন্যার জিনিস কিনতে চাইছিলেন মেয়েকে দেবেন বলে।কিন্তু স্নিগ্ধার বাবা বেঁকে বসলে, বললেন,” শুনলে না ওরা কি বলেছে।

এক কাপড়ে দিতে হবে মেয়েকে।গয়নাগাটি ও বেশি কিছু দেওয়া যাবে না। এমনকি ওরা মাত্র 50 জন বরযাত্রী নিয়ে আসবে।কি দরকার! ওরা খারাপ পেলে। তা ছাড়া স্নিগ্ধা শ্বশুরবাড়ি এত বড়লোক আমাদের এই সামান্য জিনিস ওদের মুখে রোচবে না।”কথাগুলো যুক্তিযুক্ত বুঝে, স্নিগ্ধার মা ক্ষান্ত হলেন। দরজার আড়াল থেকে মা-বাবার এই জাতীয় কথোপকথন শুনে ,স্নিগ্ধার বেশ একটা অহংকারই হচ্ছিল। বড়লোক হওয়া সত্বেও কত ভালো মনের মানুষ অগ্নির বাড়ির লোকেরা। আজকাল সবাই ওপর ওপর যৌতুক নেবে না বলে ঠিকই,কিন্তু তার সাথে এটাও জুড়ে দেয়, আপনার মেয়েকে সাজিয়ে-গুছিয়ে আপনি যা দিবেন। মেয়েরই তো থাকবে। আমরা নিচ্ছি না।” বাধ্য হয়েই মেয়ের বাবারা, প্রয়োজনের তুলনায় একটু বেশি জিনিস দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। হয়তো সোজা মুখে যৌতুক চাইলে এর থেকে অনেক কমই দিতে হতো। আর সে যুগে দাঁড়িয়ে এমন পরিবার যারা কোনরকম আতিশয্যে বিশ্বাস করে না,পাওয়া অত্যন্ত ভার।যাই হোক নির্ধারিত দিনে মাত্র 50 জন বরযাত্রী নিয়ে অগ্নি আর স্নিগ্ধার বিয়ে সুসম্পন্ন হলো। পরদিন খবরের কাগজের তিন নম্বর পাতায় সীতেশ বাবুর সপরিবারে ছবি উঠলো।খবর ছাপলো,” কোন যৌতুক না নিয়ে এক মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ের সাথে নিজের একমাত্র ছেলের বিয়ে দিয়ে সমাজে নিদর্শন রাখলেন বনেদি ব্যবসায়ী ও রাজনীতিক নেতা সীতেশ বসু।”হানিমুন থেকে ফিরে আসার পর অগ্নি স্নিগ্ধার প্রেম এখন রামধনুর চেয়েও বেশি রঙিন। এদিকে বিয়ের পর আজ স্নিগ্ধার প্রথম অফিস।

অগ্নির আদরের ঠেলায় ঘুম থেকে উঠতে একটু বেশি দেরি হয়ে গেলো।নিজের আর অগ্নির টিফিন আর ব্রেকফাস্টের সব তৈরি করে নিতে দেরি হয়ে যাচ্ছে দেখে স্নিগ্ধা তাড়াহুড়ো করতে শুরু করলো। বিয়ের আগে এমন দেরি হলে মায় ই তো সব সামাল দিয়ে দিতো।কিন্তু এখন এসব ভেবে লাভ নেই। তাড়াতাড়ি হাত চালাতে হবে। অগ্নি ব্রেকফাস্ট টেবিলে চলে এসেছে তারা লাগাচ্ছে। গরম টোস্ট অগ্নিকে সাভ্ করতে গিয়ে স্নিগ্ধার হাত লেগে ডাইনিং টেবিলের ওপর রাখা কাঁচের ভাসটা পরে গিয়ে ভেঙে চুরমার হলো। শব্দ শুনে স্টাডি থেকে বেরিয়ে এলেন স্নিগ্ধার শাশুড়ি লাবনী দেবী, হাউস হেল্প মিনুর থেকে কড়া চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,” কার কাজ?” মিনু আঙ্গুল ঘুরাতেই তিনি স্নিগ্ধাকে বললেন,” তোমার আর তোমার বাবার তিন মাসের স্যালারি এক করলেও এই ভাস কেনা যাবেনা।

প্যারিস থেকে আনা এটা।”কথাগুলো খুব গায়ে লাগলো স্নিগ্ধার। তার চোখ মুখ লাল হয়ে গেলো। কিন্তু চোখ থেকে একফোঁটাও জল পরলো না। বিকেলে অফিস থেকে ফেরার সময় কলকাতার একটা অভিজাত শপিং মলে গিয়ে দামি একটা ভাস কিনে ডাইনিং টেবিলের ওপর সাজিয়ে দিলো স্নিগ্ধা ।রাতে ডিনার করতে এসে সীতেশ বাবুর মিনুকে জিজ্ঞেস করলেন,” এই ভাস টা কে আনলো? আগেরটা কোথায়?” মিনু যথাযথ উত্তর দেওয়ার আগেই স্নিগ্ধা বলে উঠলো,” আমি এনেছি বাবা, পুরোনোটা আমার হাত লেগে পড়ে ভেঙে গিয়েছিল সকালে। তাই।”সীতেশ বাবুর অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বললেন,” মা তুমি এসব আর করতে যেও না। আমাদের বাড়িতে হরেক মাল 10 টাকার জিনিস ঠিক চলে না। ঠিক আছে,ভেঙেছে, ভেঙেছে।আবার চলে আসবে। কোন চিন্তা নেই।”রাতে বালিশ ভিজিয়ে খুব কাঁদলো স্নিগ্ধা।

অগ্নি পাশে শুয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো সারারাত। কিন্তু পরদিন সকালে উঠে তার বাবা-মার কাছে বউয়ের অপমানের উত্তর চাইতে পারলোনা। স্নিগ্ধা বুঝে গেল প্রদীপের নিচে কতটা কালো অন্ধকার। তবে স্নিগ্ধার বোঝার আরো অনেকটা বাকি ছিলো এখনও।ইলেকশনের দিন ঘনিয়ে আসতেই বাড়ি চিত্রটা কেমন যেন বদলে গেলো। প্রতিদিন দশ থেকে পঁচিশ জন লিভিং রুমে।বাড়ি ভর্তি পোস্টার আর টেমপ্লেট। স্নিগ্ধকেও রালিতে যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানালেও স্নিগ্ধার শ্বশুরমশাই।স্টেজে দাঁড়িয়ে সীতেশ বাবুর তার একমাত্র পুত্রবধুর সাথে আলাপ করিয়ে দিলেন। এসব কোনদিন এত কাছ থেকে দেখেনি স্নিগ্ধা। তবে সব কিছুর সাথে মানিয়ে নেওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করছিল সে ।সুযোগ বুঝে সাহায্য করে দিচ্ছিলো। একদিন সকালে যখন স্নিগ্ধা অগ্নি অফিস যাবার জন্য তৈরি হচ্ছিল হঠাৎ সীতেশ বাবুর ঘরে ঢুকলেন। খুব ব্যস্ততার সাথে অগ্নি ও স্নিগ্ধাকে বললেন,” তোমরা অফিস থেকে উইদাউট পে নিয়ে নাও দু’মাসের। আর হ্যাঁ ,স্নিগ্ধা তোমার বাবাকে বলো লাখ দশেক টাকা অগ্নির একাউন্টে ট্রান্সফার করে দিতে।

“শ্বশুরমশাই ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার পর স্নিগ্ধা যথেষ্ট উত্তেজিত হয়ে অগ্নিকে প্রশ্ন করল ,”এসব কি হচ্ছে।আমার বাবা তোমাকে এত টাকা কিসের জন্য দেবেন।”অগ্নি তার বাবার এই আবদারের মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারলো না। রাতে বাবা মার সাথে কথা বলবে, এই সান্তনা দিয়ে আপাতত স্নিগ্ধাকে শান্ত করলো।অগ্নি সারাদিন অফিসে মন বসছিল না। এই ভেবে যে বাবা-মার সাথে সে কিভাবে এসব নিয়ে কথা বলবে।তবুও স্নিগ্ধার মুখের দিকে তাকিয়ে প্রাণপণ সাহস নিয়ে বিকেলবেলা অগ্নি হাজির হলো বাবা-মায়ের ঘরে। আশেপাশে আট পাঁচ কথা বলার পর,বাবাকে প্রশ্ন করলো,”স্নিগ্ধার বাবাকে টাকাগুলো কেন দিতে হবে?” সীতেশ বাবুর গম্ভীর গলায় উত্তর দিলেন,” তোমার মায়ের বাবা আমাদের বিয়ের প্রায় বছর খানেক পর আমার ব্যবসাটা দাঁড় করানোর জন্য টাকা দিয়েছিলেন।

আর এখন টাকাটা পেলে আমি আমার ভোটের কাজে লাগাতে পারবো।তাছাড়া টাকাটা তো দিতেই হত স্নিগ্ধার বাবাকে আজ না-হয় তো কাল। এটাই আমাদের বাড়ির রীতি।” অগ্নির মা সাথে যুক্ত করলেন,”যদি স্নিগ্ধার বাবার টাকা দিতে অসুবিধা থাকে তাহলে আমাদের জানিয়ে দিও। আমরা তোমার অন্য কোথাও বিয়ের ব্যবস্থা করবো আবার।”কথাটা শুনে আঁতকে উঠলো অগ্নি। তার বাবার পক্ষে কিছুই অসম্ভব নয়, সে তা জানে। কিন্তু আর্থিক,প্রশাসনিক ও সবদিক দিয়ে শক্তিশালী বাবা-মার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সাহস হলো না। আর এই শহর কি, দেশের অন্যান্য শহরেও সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে তারা বেঁচে থাকতে পারবেনা বাবা-মার সাথে প্রতিবাদ করে।আর অগ্নি স্নিগ্ধাকে যথেষ্ঠ ভালোবাসে। তাকে ছেড়ে বেঁচে থাকা বা জীবন কাটানোর কথা সে স্বপ্নেও ভাবতে পারে না।

ঘরে ফিরে এসে স্নিগ্ধাকে অগ্নি বলল,”বাবা বলেছে, টাকাটার এখন আর দরকার নেই। অন্য ব্যবস্থা হয়ে গেছে।”আর পরদিন অফিসে গিয়ে লোনের অ্যাপ্লাই করে দিলো এইচআর এর কাছে। বিকেলে অফিস থেকে ফিরে মোবাইল স্ক্রল করতে করতে এক বছর আগের মেমোরি হিসেবে এই পোস্টা ঝলসে উঠল অগ্নির মোবাইল ফোনে। পোস্টটা দেখে একটু আনমনা হয় দুমিনিট কিছু একটা ভেবে আবার পোস্টটি শেয়ার করে দিলো অগ্নি।ক্যাপশনে লিখলো, #stayawayfrom দেনা পাওনা।

কলমে -মৌমিতা ভাওয়াল দাস ✍

Facebook Comments Box

LEAVE A RESPONSE

Your email address will not be published. Required fields are marked *