কর্মস্থল আমার কলকাতাতে হলেও কর্ম সূত্রে বিভিন্ন জেলায় যেতে হয়।
সালটি ছিল ২০০৭, ৪ঠা জুন সকাল ৮টা তে ধর্মতলা থেকে বাস ধরে ১১টা নাগাদ তমলুক পৌঁছে যাই। সেখানে কাজ শেষ করে দুপুর ১:১০এর বাস ধরে কাঁথি(কনটাই) এর উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যাই। যখন কাঁথি পৌঁছালাম ঘড়িতে তখন প্রায় ২:৩০টে বাজে। আবহাওয়া হঠাৎ করেই ভোল বদলায়- ঝোড়ো হাওয়া আর ঘনঘটা, বৃষ্টি তখনও শুরু হয়নি। আকাশে তখন কৃষ্ণ মেঘের আচ্ছাদন। যত শীঘ্র সম্ভব ওখানে কাজ শেষ করে ৪:৩৫এর শেষ বাসে উঠলাম। ততক্ষণে আকাশে মেঘের বাঁধ ভেঙে গেছে। আবহাওয়া শুকনো থাকলে সূর্যাস্তের পড়ন্ত আলোটা দেখা যেত, কিন্তু সেদিন সন্ধ্যার আগে অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। বজ্রবিদ্যুৎ সহ বৃষ্টি তার সাথে ঝড়। কাঁথি থেকে খড়্গপুর হয়ে মেদিনীপুর যাওয়ার কথা ছিল আমার। কিন্তু আবহাওয়ার প্রতিকূলতার জন্য বাস থেকে খড়্গপুর নামতে পারলাম না।
বাসে যখন উঠেছিলাম হাতে গোনা দশ থেকে বারো জন যাত্রী ছিল। তার মধ্যে বেশিরভাগ জন মেদিনীপুর আসার আগেই নিজেদের গন্তব্যে নেমে যায়। তবে মেদিনীপুর পর্যন্ত বাসে আমার সাথে ছিল আরও দুজন, তবে তারা স্হানীয় বাসিন্দা। সাড়ে ৬:৩০টা নাগাদ ঝড়ের দাপট একটু কমলেও ছিপছিপে বৃষ্টি চলতে থাকে অবিরাম। বাসে স্হানীয় দুই ভদ্রলোকের কথোপকথন শুনে বুঝলাম সেটা সন্ত্রাসী প্রবণ অঞ্চল, সন্ধ্যার পর স্হানীয় দোকান পাঠ সব কিছুই বন্ধ থাকে সন্ত্রাসীদের ভয়ে। সব কিছু শুনে আবহাওয়ার প্রতিকূলতা তুচ্ছ মনে হলো, কিন্তু ফিরে যাওয়ার পথ নেই।
বাস যখন মেদিনীপুর পৌঁছায় ঘড়িতে তখন প্রায় সাড়ে সাতটা। স্থানীয় দুজন বাস নেমে দ্রুত হাঁটা দিল নিজেদের বাড়ির উদ্দেশ্যে। আমায় যাওয়ার আগে শুধু বলে গেলেন- “এখানে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবেন, বিপদ হতে পারে।”
বাসস্ট্যান্ডে তখন আমি একা, বড়ো অসহায় লাগছিল। ওই দুজন ভদ্রলোকের মুখে এলাকায় সন্ত্রাসীদের দাপটের কথা শুনে ভয়ে হৃদপিণ্ড সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছিল। পুরো এলাকা জন শুন্য। একটা রিক্সা না পেলে লজ পর্যন্ত যাওয়া সম্ভব নয়। এদিকে কখনো গতি বাড়ছে আবার কখনো কমছে, বৃষ্টি অবিরাম হয়ে চলেছে। কোনো যানবাহনের চিহ্ন নেই রাস্তায়। অগত্যা নিজের ছাতা সম্বল করে হাঁটতে শুরু করলাম। বৃষ্টির জন্য সামনের সব কিছু ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল। মাঝে মাঝে বিদুৎ এর ঝলকানি এক পলকের জন্য আলোকিত করছিল চারিপাশ, তার পরক্ষণেই সব কিছু অন্ধকার।
কিছু পথ হাঁটার পর মনে হলো কেউ যেন অনুসরণ করছে আমায়। ঘাড় ঘুড়িয়ে একবার দেখলাম কিন্তু চোখে পড়লো না কাউকে। একে জলীয় আবহাওয়া প্রায় ভিজে গেছি তার সাথে মনের ভয় আর প্রাণের সংশয় মিলে গাঁয়ে কাঁটা দিচ্ছে আমার। আরও জোড়ে হাঁটতে শুরু করলাম। কিন্তু দুপুর থেকে কাজের তাগিদে কিছু খাবার খাওয়া হয় নি। শরীরের সব শক্তি যেন ক্ষীণ হয়ে আসছে। পা যেনো আর চলছে না আমার। তার উপর রাস্তায় জমা জল তাড়াতাড়ি হাঁটতে পারছিলাম না। এক ফোঁটা জলও পেলাম না বোতলে তৃষ্ণা নিবারণের জন্যে। ঠোঁট গলা সব শুকিয়ে গেছে। বড়ো ক্লান্ত লাগছিল। কিন্তু আমার থেমে গেলেও চলবে না প্রাণের ভয় আছে।
বজ্রপাত ব্যতীত কানে ভেসে আসলো ঘন্টার শব্দ। পিছন ঘুরে তাকাতেই দেখলাম দূর থেকে একটি হারিকেনের আলো এগিয়ে আসছে আমার দিকে। একটু দাড়িয়ে গেলাম। একটু এগিয়ে আসতেই বুঝলাম একজন রিক্সা নিয়ে আসছে। দেখে একটু স্বস্তি পেলাম। রিক্সা নিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো সে। ফ্যাস ফ্যাসে গলায় বললেন-
“আপনি একা এই আঁধারে কী করতেছেন বাবু। একা দাঁড়ানো ঠিক হবেক নাই। চলেন আমার সাথে। কাছাকাছি কোনো লজ পাবেক নাই।”
খুব চিন্তায় পড়ে জিজ্ঞেস করলাম-
“তবে সারারাত আমি থাকবো কোথায়? শুধু রাতে থাকার একটি ব্যবস্থা করে দিন।”
“আগে বসেন তাড়াতাড়ি। আমার নাম রতন। রিক্সা স্ট্যান্ডের পাশে একটা পুরানো লজ আছে। চলেন ওখানে নিয়ে যাবো।”
আলো আঁধারে ভদ্রলোকের মুখটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম না। তবে ছিপছিপে চেহারার, মাথাটা গামছা দিয়ে ঢাকা। ভদ্রলোক ছাড়া জন মানবহীন সড়কে কেউ ছিলো না। অগত্যা উনার রিক্সাতে চেপে বসলাম। তারপর কানে সজোরে একটি শব্দ এসে বাজলো- “বো… ম…”
রিক্সা দ্রুত গতিতে চালিয়ে ভদ্রলোকে বললেন-
“চিন্তে করবেন না বাবু।”
ওই রকম শব্দ আর কানে এলো না তারপর।
কিছুক্ষণ পরেই একটা ঝাকুনি দিয়ে থামলো রিক্সা।
রিক্সা থেকে নেমে দেখি সামনে একটা লজ। একটি ছোট হলুদ ডিম লাইট জ্বলছে। সামনে লোহার একটা ছোট গেটে ভিতর দিয়ে তালা লাগানো আছে।
“কেউ আছেন? কেউ কী আছেন? “
একজন বেটে খাটো ছিপছিপে চেহারার লোক লম্ফ নিয়ে বেড়িয়ে এসে বললো, “কাকে চাই? “
“আসলে আজ রাতটা যদি আপনাদের লজে থাকার ব্যবস্থা হতো… “
“নানা, এখন অথিতিদের থাকার ব্যবস্থা নেই। “
“শুধু রাতটা থাকতে দিন, খুব উপকার হবে। “
কাকুতি মিনতি করার পর এদিক ওদিক তাকিয়ে তালা খুলে দিয়ে বললেন ” আচ্ছা ভিতরে আসুন তাড়াতাড়ি। “
“অনেক ধন্যবাদ দাদা। “
ভিতরে ঢুকতে গিয়ে থমকে পিছনে তাকালাম, “আরে রিক্সা চালক ভদ্রলোক কথায় গেলেন? পারিশ্রমিক তো দেওয়া হলো না। “
“কী হলো দাদা দাড়িয়ে গেলেন কেনো, চলুন… “
মনে মনে ভাবলাম এই বিপদে না দাড়িয়ে হয়তো চলে গেছেন, কাল স্ট্যান্ডে দেখা করে ভাড়াটা দিয়ে দেব। এই বিপদে উনি আমার পরম বন্ধু ছিলেন।
সম্বিত ফিরলো ভদ্রলোকের ধমকে। একটি ছোট ঘর খুলে দিয়ে বললেন, “আজ রাতে এখানে থাকতে হবে, অন্য ঘর পরিষ্কার করা নেই। “
“দাদা কিছু খাবার পাওয়া যাবে? “
“সেই রকম কিছু নেই, ভাত দিতে পারি, তার সাথে কাঁচা পেঁয়াজ আর সিদ্ধ ডিম। “
“ঠিক আছে তাতেই চলবে। “
লজটি দেখে বুঝেছিলাম সেটি বন্ধ থাকে, থাকার অযোগ্য, কিন্তু সেদিন রাতে ওটাই স্বর্গ ছিল আমার কাছে। মুখ হাত ধুয়ে সারাদিন ওইটুকু খাবার তৃপ্তি করে খেয়ে ক্লান্ত শরীরটা তক্তাপোষে এলিয়ে দিলাম। কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসছে না। সারাদিনের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠছে। আর ওই ভদ্রলোক ছিলেন বলেই এই নিরাপদ আশ্রয় পেলাম।
এক ফালি খোলা জানালা সূর্যের আলো চোখে এসে পড়তেই ঘুমটা ভেঙে গেলো। বুঝলাম ভাবতে ভাবতে কাল রাতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। উঠেই ভদ্রলোকের কথা মনে পড়তেই রিক্সা স্ট্যান্ডে চলে যাই, যদি রতনের সাথে দেখা হয়।
লজ থেকে বেড়িয়ে দেখলাম বেশ কয়েকজনের জমায়েত। বুঝলাম শোক সভা হচ্ছে। দূর থেকে শুনে বুঝলাম সন্ত্রাসীদের জন্য কেউ প্রাণ হারিয়েছেন। একজনের কথা কানে ভেসে এলো, “রতনটা অকালেই প্রাণটা হারালো। “
ছ্যাঁত করে উঠলো মনটা। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে না পেরে বাকি রিক্সা চালকদের রতনের কথা জিজ্ঞাসা করতে জানতে পারলাম বিগত দুদিন আগে রতনের গ্রামে সন্ত্রাসীদের আক্রমনে গুলি বিদ্ধ হয়ে রতন প্রাণ হারিয়েছে।
তবে কাল রতন যে সাহায্য করলো আমায়। কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিনা ওদের বলা কথাগুলো। হতভম্ভ হয়ে গেলাম। বুঝলাম কাল রতন আমার রক্ষাকর্তা হয়ে এসেছিল, আমার পরম বন্ধু।