ডাক্তার সেন আর ওনার সহধর্মিণী এসেছেন, বাইরে অপেক্ষারত। সেক্রেটারি কাবেরী এসে জানালো ডাঃ বন্হি রায় কে। ওদের ভেতরে পাঠাতে বলে একটু গুছিয়ে নিলেন তিনি। ওনারা রাই এর মা, বাবা… ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশনের পেশেন্ট রাই যখন মনোবিদ ডাঃ বন্হির চেম্বারে প্রথমবার আসে, তার চোখে এক অদ্ভুত শূন্যতা দেখেছিলেন বন্হি, এ শূন্যতা তার খুব পরিচিত… ব্যস্ত বাবা মা জাগতিক জিনিসের অভাব রাখেনি কিছু, কিন্তু যা সে পায়নি তা হলো প্রিয়জনদের সময়, আদর, ভালোবাসা। অগত্যা বাচ্চা মেয়েটা বাইরের জগতেই খুঁজে নিতে যায় না পাওয়া গুলো কিন্তু সেখানেও ধাক্কা, বিশ্বস্ত বয়ফ্রেণ্ড বিশ্বস্ত থাকেনি বেশিদিন… আত্মহত্যা করতে গিয়ে ব্যর্থ হলে ব্যস্ত বাবা-মা উপলব্ধি করেন “সামথিং ইজ রং”… তারপর মেয়েকে শহরের নামী সাইকিয়াট্রিষ্ট এর কাছে নাম লিখিয়েই এক প্রকার দায়িত্ব সেরেছেন তারা। বেশিরভাগ সময়ই বাড়ির গাড়িতে একা আসে সে, দু একবার ওর অধ্যাপিকা মা সঙ্গে এলেও বাবা কে আসতে দেখেনি কোনোদিন, শুনেছেন তিনি ব্যস্ত কার্ডিওলজিষ্ট… আজকাল যেন প্রায় সব নিউক্লিয়ার ফ্যামিলিরই এক গল্প হয়ে উঠেছে।
মাঝে কেটে গেছে তিন-চার মাস, বিভিন্ন মেডিসিন, সাইকোথেরাপি আর সর্বোপরি বন্হির মাতৃসুলভ তত্ত্বাবধানে তাড়াতাড়ি সেরে উঠছিল রাই, বন্হি এখন তার কাছে কোনো ডাক্তার নয়, বন্হি আন্টি। বেশ মায়া পড়ে গেছে বন্হিরও। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় ট্রান্সফেকশন-কাউন্টার ট্রান্সফেকশন জাতীয় গভীর শব্দ থাকলেও বন্হির মনে হয় এ যেন তার সুপ্ত মাতৃত্বের বহিপ্রকাশ।
নিজের সন্তান কে কোনোদিন তেমনভাবে কাছে পাননি তিনি। মা বাবার ইচ্ছেপূরণে বিয়েটা করলেও সংসার করা হয়ে ওঠেনি বেশিদিন। পলাশ স্বামী হিসেবে মন্দ নয়, কিন্তু বন্হির মন সে পড়তে পারেনি কখনো। পলাশকে দোষ দেওয়া যায়না অবশ্য। আসলে তার মন তো আগেই বাঁধা পড়েছিল কারো কাছে… তাসের ঘরের মতো সংসারটা ভেঙে গেছিল, অথবা হয়তো সেটা কোনদিন গড়েই ওঠেনি তেমনভাবে, আর কাউকে জোর করে ধরে রাখায় বিশ্বাসী ছিলনা সে কোনোদিনই, চিরকালই নির্বিবাদী সে, আর প্রবল আত্মসম্মানী। একমাত্র ছেলেকেও সঙ্গে নিয়ে যায় পলাশ, মাসে দুদিন সে ছেলেকে দেখতে পায়, শুধু এইটুকুই… ছেলেরও মায়ের প্রতি টান তৈরী হয়নি তেমনভাবে।
ভাবনাগুলো ছিড়ে গেলো কারণ দরজা ঠেলে ঘরে প্রবেশ করেছেন ডাক্তার সেন ও মিসেস সেন, রাই এর বাবা-মা… থমকে গেলো বন্হি, এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো সে ভুল দেখছে… সেই শান্ত, স্নিগ্ধ মুখ, চশমার আড়ালে এক জোড়া উজ্জ্বল চোখ, অগোছালো চুল, বয়সে আর অভিজ্ঞতার ভারে মুখটা ভারিক্কি হয়েছে কিছুটা… ডাক্তার সাম্য সেন… সাম্যর চোখের বিভ্রান্তিটাও নজর এড়ালো না তার…
সময় থেমে গেল কি! চলতে শুরু করলো উল্টো দিকে!?নাহলে কেবিনে আরো দু দুটো মানুষের উপস্থিতি অনুভূত হচ্ছে না কেন? বছর কুড়ি পর সাম্য আর বন্হি আজ আবার মুখোমুখি, এরকমতো কথা ছিল না… মেডিক্যাল কলেজের ব্যাচমেট থেকে বন্ধুত্ব, সেখান থেকে প্রেম… তাদের বিয়েটা ছিল শুধুই সময়ের অপেক্ষা…কিন্তু সময় বড়ো অদ্ভুতভাবে মানুষকে বদলে দেয়… কর্মব্যস্ততার পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে বেড়েছিল একে অপরের প্রতি উদাসীনতা… সেটা আরো প্রকট হয়ে উঠেছিল বন্হির শারীরিক অসুস্থতার সময়ে সাম্যর অনুপস্থিতিতে… যে ভাঙনটা ধরেছিল সেটা আটকানোর ক্ষমতা তাদের ছিলনা, শেষ সীমারেখাটা অবশ্য টেনেছিল সাম্যই… তখন সেলফোনের চল হয়নি, বন্হির বান্ধবীর হাত দিয়ে পাঠানো একটা চিঠি তেই তাদের এতদিনের সম্পর্কের পাট চুকিয়েছিল সে, শেষ চেষ্টা করেছিল বন্হি কিন্তু পারেনি… একবার শেষ দেখাও হয়নি তাদের, যোগাযোগ, খোঁজ খবরও রাখেনি সাম্য তার একদা প্রিয় বন্ধুর… বন্হি বন্ধুবান্ধবদের মাধ্যমে টুকটাক খবরাখবর পেত, তারপর সময়ের সাথে সেসবও একদিন বন্ধ হল। উত্তর কলকাতার বড়ো গরাদওয়ালা টানা বারান্দার সাম্যদের বাড়ি টাতে তাদের একসাথে সংসার করা হয়নি… একটা শেষ না হওয়া শেষ রয়ে গেছে কারণ সব গল্পের হয়তো “হ্যাপিলি এভার আফটার” হয়না…
‘ম্যাম’, কাবেরীর ডাকে ঘোর কাটে। কেস ফাইল তৈরি করে রাখাই ছিল, আজ একটা ফাইনাল ওপিনিয়ন দেওয়ার জন্যই তিনি ডেকেছিলেন ওনাদের। কাবেরী অপেক্ষা করছে তার পরবর্তী নির্দেশের। বন্হি আরো কিছু নির্দেশ দিল, বুঝিয়ে দিলো সবটা তাদের। মিসেস সেন আগেই বুঝে নিয়েছেন তার যাবতীয় করণীয়। কাবেরী বেরিয়ে গেলো ফাইনাল রিপোর্ট তৈরির জন্য, মিসেস সেন ও গেলেন সাথে…
কেবিনে এখন দুটো মানুষ, মাঝে অনেক বারণ আর কুড়িটা বছর…
“কেমন আছিস?”, সাম্যই নিস্তব্ধতা ভাঙলো। ঠোটের কোণে মৃদু হাসিতে সুচারু ভাবে প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে বন্হি মুখ খোলে এবার, “দেখুন ডা: সেন একজন চিকিৎসক হিসেবে ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশনের ব্যাপারটা আপনার অজানা নয় নিশ্চয়ই! তার সাথে রাই এর অ্যাংজাইটি অ্যাটাকেরও হিস্ট্রি আছে… বাট সি ইজ ডুইং ফাইন নাও… ওর শুধুই আপনাদের সময় আর ভালবাসার প্রয়োজন এখন.” একটু সময় নিয়ে বন্হি বলে চলে, “আপনাদের ব্যস্ত জীবন থেকে ওকে একটু সময় দিন, দেখবেন ও ভালো থাকবে।”
সাম্য চোখ নামিয়ে বসেছিল। আজ সে আর কোনো নামকরা ডাক্তার নয়, একজন দিশেহারা বাবা, অথবা একজন ব্যর্থ প্রেমিকও কি? রাই এর জায়গায় আজ কি একবারও তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে অনেক পেছনে ফেলে আসা আর একজনের অসহায় মুখ যার সাথে তার একটা অসম্পূর্ণ গল্প আছে?
তাদের সম্পর্কটা আজ এখন শুধুই প্রফেশনাল সেটা বুঝতে পারছিল দুজনেই, চরম আত্মসম্মানী বন্হি যে কিছুতেই পুরনো কোনো কথা তুলবেনা তা বেশ বুঝেছিল সাম্যও… একটা কেজো “থ্যাংক ইউ” জানিয়ে সে উঠে পড়ে।
“সাম্য”, বন্হি জানে চলে যেতে থাকা মানুষকে পিছু ডাকতে নেই, তবুও সে আজ ডাকলো, হয়তো এই শেষবারটা তাকে ডাকতেই হতো। “কাজ জীবনের অঙ্গ কিন্তু কাজটাই জীবন নয়।”… “কাছের মানুষদের সময় থাকতে সময় দিলে তাদের হারিয়ে ফেলার ভয় থাকেনা। মেয়েটার কাছে গিয়ে বলিস ও তোদের কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ… ভালো থাকিস তোরা ।”
চলে গেছে সাম্য, রাই… ওদের চলে যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে এক ফোঁটা চোখের জল কেন যে ঝরে পড়ল বন্হির, সে জানেনা। একটা অধ্যায়ের সমাপ্তি।
আরও একটা পিছুটান মুক্ত হলো সে। কাবেরী এসে জানালো বাইরে আরো পেশেন্ট অপেক্ষা করছে… তাদের এক এক করে ভেতরে পাঠাতে বলে প্রখ্যাত সাইক্রিয়াটিষ্ট ডাঃ বন্হি রায় জীবনের আরেকটা নতুন অধ্যায় শুরু করলেন।