গত ১৪ই মার্চ, ২০১৮-য় পৃথিবীর বুকে নেমে এল কৃষ্ণগহ্বর স্বরূপ এক শোকের অন্ধকার, ৭৬ বছর বয়সে প্রয়াত হলেন সৃষ্টিতত্ত্ব ও মহাকাশ বিজ্ঞানের অন্যতম পথিকৃৎ তথা বিজ্ঞানজগতের বিস্ময়, বিজ্ঞানী স্টিফেন ডব্লিউ হকিং৷ বুধবার সকালে একটি বিবৃতি প্রকাশ করে তাঁর মৃত্যুর কথা জানান হকিংয়ের সন্তান লুসি, রবার্ট এবং টিম৷
স্টিফেন শুধুমাত্র একজন বিজ্ঞানসাধকই নন, তার থেকেও বড় এমন এক অনুপ্রেরণা, যা শেখায়, কোনো প্রতিবন্ধকতাই জীবনে এগিয়ে যাওয়ার পথে বাধা হতে পারেনা৷
কাকতালীয় হলেও সত্যি, যে গ্যালিলিওর মহাপ্রয়াণের ঠিক তিনশো বছর পর ১৯৪২ সালের ৮ই জানুয়ারি ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ডে জন্মগ্রহণ করেছিলেন স্টিফেন হকিং৷ বাবা ফ্র্যাঙ্ক হকিং ছিলেন চিকিৎসা শাস্ত্রের গবেষক এবং মা ইসোবেল হকিং ছিলেন প্রথমে আয়কর ইন্সপেক্টর, পরে মেডিক্যাল গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সেক্রেটারি৷ ভাইবোনদের মধ্যে স্টিফেন ছিলেন বড়৷
১৯৫৩-১৯৫৮ সালে উত্তর লন্ডনের সেন্ট আলবান্স স্কুলে পড়াশোনা, সেখানেই গণিতের সাথে সখ্য৷ নবীন বয়সে তাঁর উৎসাহ ছিল অশ্বারোহণ এবং নৌকা বাইচে৷ অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যায় স্নাতক, কিন্তু বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্র হিসেবে যেহেতু তখন কেমব্রিজের প্রতিষ্ঠা অক্সফোর্ডের উপরে, তাই স্টিফেন ১৯৬২ সালের অক্টোবরে কেমব্রিজে যোগ দেন৷ ১৯৬৬ সালে তিনি ”সৃষ্টিতত্ত্ব” বিষয়ে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন৷
১৯৬২ সালে কেমব্রিজে ভর্তি হওয়ার কিছুদিন আগে, হঠাৎ একদিন নিচু হয়ে জুতোর ফিতে বাঁধতে গিয়ে অনুভব করলেন আঙুলগুলো নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে৷ এরপর নববর্ষের এক অনুষ্ঠানে, গ্লাসে পানীয় ঢালতে গিয়ে হকিং পুরো পানীয়টাই ঢেলে দিলেন টেবিলে৷ ১৯৬৩ সালে শারীরিক পরীক্ষা-নিরিক্ষার পর জানা গেল রোগটি হল অ্যামিওট্রপিক ল্যাটেরাল সক্লেরোসিস৷ ডাক্তাররা বলেছিলেন খুব বেশি হলে তিনি দু-তিন বছর বাঁচবেন৷
১৯৬৩ সালের নববর্ষের সেই আনন্দসন্ধ্যায় হকিং-এর বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন জেন নামে একটি মেয়ে৷ হকিং সম্পর্কে ডাক্তারদের মন্তব্য ”বড় জোর দু-তিন বছর বাঁচবে” জেনেও জেন হকিংকে জীবনসঙ্গী করার কথা ভেবেছিলেন৷ ১৯৬৫ সালের জুলাই মাসে হকিং আর জেনের বিয়ে হয়৷ পরে হকিং ও জেনের তিনটি সন্তান হয়৷
মারণরোগের প্রতিবন্ধকতা কখনই আত্মবিশ্বাসী হকিং-এর গবেষণার রথের চাকাকে থামাতে পারেনি, ১৯৭৪ সালে জনসমক্ষে নিয়ে আসেন তাঁর ‘ব্ল্যাকহোল থিয়োরি’৷ তিনি বলেন, কৃষ্ণগহ্বর থেকে আলো বিকিরণ হতে পারে, ব্ল্যাকহোলেরও সমাপ্তি আছে অর্থাৎ ব্ল্যাকহোল নশ্বর নয়৷
১৯৮৮ সালে প্রকাশিত হল হকিং-এর লেখা ”ব্রিফ হিস্ট্রি অফ টাইম”৷ ২৩৭ সপ্তাহ ধরে বেস্টসেলার তালিকার শীর্ষে থাকা বইটিই তাঁকে আন্তজার্তিক তারকার সম্মান দেয়৷ ৪০টি ভাষায় অনুবাদ হয় এবং বইটির ১০ মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়েছে৷ জ্যোর্তিবলয় সম্পর্কে ছোটোদের জন্য লেখেন, ”জর্জেস সিক্রেট কি টু দি ইউনিভার্স”৷
১৯৮৫ সালে অসুস্থতায় তাঁর কথা বলার শক্তি হারিয়ে যায় চিরতরে। এরপর যন্ত্রই ছিল তাঁর কথোপকথনের একমাত্র সহায়৷ ২০০৪ সালে “কৃষ্ণগহ্বর রহস্য” সমাধানের ঘোষণা করেন হকিং৷ ডাবলিনের আন্তজার্তিক সম্মেলনে গবেষণাপত্র তুলে ধরেন৷
২০১৪ সালে তাঁর প্রথম স্ত্রী জেন হকিং-এর লেখা মূল কাহিনী ”ট্র্যাভেলিং টু ইনফিনিটি: মাই লাইফ উইথ স্টিফেন” থেকে বায়োগ্রাফিকাল রোম্যান্টিক ড্রামা ফিল্ম ”দ্য থিওরি অফ এভরিথিং” তৈরি হয়৷ সিনেমাটির অভিনেতা এডি রেডমেইন জিতে নিয়েছিলেন অস্কার৷
বহু পুরস্কার তাঁর ঝুলিতে থাকলেও নোবেল কমিটি তাঁকে সম্মান জানায়নি কারণ কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে তাঁর আবিষ্কার পুরোপুরি প্রমাণ করা যায়নি এখনও, তবে এই বিজ্ঞানীকে পুরস্কারের মাপকাঠিতে মাপা সম্ভব নয়, তাঁর জ্ঞান মহাকাশের ন্যায় অনন্ত৷
ব্ল্যাকহোল, ডার্ক এর্নাজি, ডার্ক ম্যাটার এবং কোয়ান্টাম-গ্র্যাভিটি প্রবলেম(অসম্পূর্ণ) নিয়ে তাঁর সাধনা কতটা তাৎপর্যপূর্ণ তা সময় বলবে৷
হকিং এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ”I AM NOT AFRAID OF DEATH, BUT I AM NO HURRY TO DIE. I HAVE SO MUCH I WANT TO DO FAST.”
বিজ্ঞানজগত থেকে বেরিয়ে বিজ্ঞানী হকিং পৌঁছে ছিলেন আমজনতার আগ্রহের উপকন্ঠে৷ তাঁর দৈহিক মৃত্যু ঘটলেও তিনি মহাকাশ বিজ্ঞান তথা সৃষ্টিতত্ত্বের গবেষনার ইতিহাসে উজ্বল নক্ষত্র হিসাবে সর্বদা বিরাজমান থাকবেন৷