LaughaLaughi

You Create, We Nurture

I got a story to tell

একেই বলে বন্ধুত্ব

বন্ধুত্বের কোনো বয়স হয়না, কোনো লিঙ্গ হয় না, কোনো জাত-ধর্ম, ধনী-গরীব কিছুই হয় না— এমন উদার বাণী ছোটো থেকেই শুনে এসেছি। তবুও অসম বয়সী কিংবা একটা ছেলে ও মেয়ের গভীর বন্ধুত্বকে মানুষ একটু বাঁকা চোখেই দেখে। ক্যালেন্ডার বদল হলেও কিছু মানুষের চিন্তাধারার আর বদল দেখি না। তার জন্য অবশ্য শুধু সেই মানুষগুলোকে দোষ দেওয়া চলে না। কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষ বন্ধুর মুখোশ পরে সহজ সরল মানুষগুলোকে যে ভাবে ঠকাচ্ছে তাতে এমনটা ভাবা অস্বাভাবিক কিছু নয়।

তবে এখনও নির্মল বন্ধুত্ব আছে। পথে ঘাটে ভেকধারী পাতি মানুষের ভিড়ে আজও কিছু আনকোরা সম্পদ লুকিয়ে আছে। আসল হিরে। আসল বন্ধু। খাঁটি বন্ধুত্ব।

চায়ের দোকানে বসে চা-বিস্কুট খাচ্ছি, এমন সময় বছর আশির কাছাকাছি এক বৃদ্ধ দোকানে ভিক্ষা করতে এলো। এ আর এমন কি কথা! এ দৃশ্য গ্রাম শহর নির্বিশেষে সর্বত্রই দেখা যায়। কিন্তু সেই তিন ঠেঙো বৃদ্ধকে দেখে বড়ো বেশিই ক্লান্ত মনে হচ্ছে। বৃদ্ধের এই অবস্থা দেখে নিজের ভীষন খারাপ লাগলো। দু’নম্বর বিস্কুটটায় একটা কামড় দিতে গিয়েও পারলাম না। পায়ের কাছে যে কুকুরটা প্রভু ভক্ত সুলভ দৃষ্টি নিয়ে মিনিট পাঁচেক লেজ নাড়াচ্ছিল, তার মুখের কাছেই সাত টাকা পিস পুরু চাকতির মতো খাস্তা বিস্কুটটা ছুঁড়ে দিলাম। বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করলাম, “কি দাদু! কোথায় থাকা হয়?” দাদু কাঁপা কাঁপা গলায় উত্তর দিল, “খা—ল পা—ড়ের বস—তি—তে। ”আমি একটু বিজ্ঞ ভাব দেখিয়ে বললাম,“সানকি পাড়া যেতে যে আশ্রমটা পড়ে, তা ওখানেই খাওয়া দাওয়া হয় নাকি?” দাঁত ফোকলা থুরথুরে দাদু চামড়া ঝুলে পড়া গাল নিয়ে মাথা নাড়িয়ে বললো, “মাঝে মধ্যে…” ইঙ্গিতেই কিছুটা বোঝানোর চেষ্টা করলো। “পুঁটলিতে চাল ডাল? দিদার জন্য নাকি?” দাদু ঘাড় নেড়ে জানালো না, ডান হাতের তর্জনী উঁচিয়ে বুঝিয়ে দিল তার স্ত্রী গত হয়েছে। আমি আবার প্রশ্ন করলাম, “তবে তোমার আর কে আছে?”এক মুখ হেসে বললেন,“প্রাণ সখা…” দাদুর উত্তর শুনে অবাক হলাম। কিছুটা নয়, বেশ অনেকটা অবাক হলাম। প্রায় আশি বছরের বৃদ্ধ লাঠি হাতে নাকি তার বন্ধুর জন্য ভিক্ষা করতে বেরিয়েছে!

কেনো জানিনা আমার বেশ কৌতূহল হচ্ছিল তার বন্ধুর ব্যাপারে। কেমন বন্ধু? দুজনে তো আশ্রমেই খেতে পারে! ওখানে তো বৃদ্ধদের থাকার ব্যাবস্থাও আছে। তবে ভিক্ষা কেনো? জানে না নাকি! ইরিং বিড়িং নানা প্রশ্ন মাথায় এলো। বললাম,“দাদু তোমরা তো আশ্রমেই থাকতে পারো। বললে আমি ব্যাবস্থা করে দিতে পারি।” দাদু হাত নাড়িয়ে বোঝালো তার দরকার নেই। কিছুক্ষণ পর বললো,“আমরা দুই বুড়ো চালে ডালে ফুটিয়ে খাই, গপ্প গুজব করি, ঠাকুরের নাম গান করি… আমাদের ঠিক দিন চলে যায়, ভাই!” “তোমার বন্ধু ভিক্ষায় বেরোয় না?”—জিজ্ঞেস করলাম।

দাদু মুখ নিচু করে আপসোস করতে লাগলো,“আমার জন্যে ভাই, সব আমার জন্যে!” বলা হয়নি, এরই মধ্যে আমি ঠিক করেছি দাদুর পুঁটলি বস্তিতে পৌঁছে দিয়ে আসবো, আর তার বন্ধুকেও দেখে আসবো। রথ দেখা কলা বেচা একসঙ্গে আর কি! চায়ের দোকানে দাম মিটিয়ে, এক প্যাকেট বিস্কুট আর দুটো কেক কিনে অনেকক্ষণ হল আমরা হাঁটতে শুরু করেছি। দাদু থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো। জিজ্ঞেস করলাম,“কী হল?” কান্নায় ভেঙে পড়লো দাদু। আমি উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,“কাঁদছো কেন?” বললো,“গেলেই দেখতে পাবে ভাই!”

গিয়ে যা দেখলাম তাতে আমার চোখ ফেটে জল এলো। একটা বৃদ্ধ মাটিতে বসে মাটি জল নিয়ে খেলা করছে। উষ্ক খুষ্ক মাথা, পরনে শত ছিন্ন তেলচিটে ময়লা বস্ত্র, বস্ত্র না বলে ন্যাকড়া বললেও অত্যুক্তি হয় না। সবচেয়ে বেশি অবাক হলাম, বলা ভালো স্তম্ভিত হয়ে গেলাম, যখন চোখ শরীরের একটা জায়গায় গিয়ে থেমে গেল। তার দুটো পা’ই হাঁটুতে গিয়ে শেষ। মানুষটার পা নেই, একই সঙ্গে বদ্ধ পাগল। আমার শরীরটা হঠাৎ করেই কেমন খারাপ হতে শুরু করলো। যে দাদুর সঙ্গে এতো দূর এলাম তাকে যেনো আরো অচেনা মনে হল। নিজেকে কিছুটা সামলে নিলাম। দাদু এখন তার ‘প্রাণ সখা’কে আমার কিনে দেওয়া কেকটা খাওয়াতে ব্যাস্ত। পরম যত্নে সন্তান স্নেহে, সখা প্রেমে মগ্ন সেই বৃদ্ধকে দেখে শ্রদ্ধায় মাথা নত করতে ইচ্ছা করছে। আর মনে হাজার হাজার প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। দাদু নিজেই শুরু করল— “দিনু আর আমি একসঙ্গে দু’কুড়ি বচর লেদ কারখানায় কাজ করিচি। আমার ছেলেপুলে কেউ নেই, বউটাও মরলো অকালে। দিনুর কেউ নেই, বিয়ে থাওয়া করেনে, আমাদের সঙ্গেই থাকতো। তার পর থেকে আমরা দুজন দুজনের সুখ দুখের সাথী। চাকরি শেষ হব হব সেই সময় করেই আমাদের কপাল পুড়লো। দুজনেরই নাইট ডিউটি। ভোর রাতে ঘুম ঘুম আসছে, তাই আলসি ভাঙতে বেড়িয়েছিলুম। আমি আনমনে রাস্তা পাড় হচ্ছিলুম, তখনই কারখানার মাল বোঝাই লরি বেরোচ্ছিল। হর্নের আওয়াজ যেন কানেই যায়নে। সেদিন আমিই চাপা পড়ে মরতুম। দিনু আমাকে ঠেলে সরিয়ে দিল, কিন্তু ও আর উঠতে পারলো না। মাল বোঝাই লরি ওর দুটো পা চেপে দিয়ে চলে গেল। পায়ের নীচে থেকে বাদ দিতে হল, নাহলে ওকে বাঁচানো যেত না। মাস সাত আট হাসপাতালে ভর্তি ছিল। আমার বাড়িতেই এনে রাখলুম। দিন দিন ওর মাথাটাও বিগড়াতে লাগলো। যা ছিল সব বেচে দিয়ে ওকে ডাক্তার দেখিয়েছি ভাই! কিন্তু…” আক্ষেপ করে চোখের জল মুছলো দাদু। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে আবার এমন সখা প্রেম দেখে অভিভূতও হচ্ছি। কিছু বলার কোনো ভাষা পেলামনা, শুধু ভগবানের কাছে একটাই প্রার্থণা এমন বন্ধুত্ব হাজার হাজার বছর বেঁচে থাকুক।

কলমে- অর্যমা

Facebook Comments Box

LEAVE A RESPONSE

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আমি বাংলা সাহিত্যের একজন গুণমুগ্ধ ছাত্রী। বর্তমানে লাফালাফির কন্টেন্ট রাইটার। লেখালিখির পাশাপাশি বিভিন্ন সৃজনশীল কাজ করতে ভালোবাসি। নিজের শৈল্পিক সত্তাটিকে সযত্নে লালন করি।