রাজার বাড়ি ঘুরতে মজা ভারি

ছোটবেলা থেকেই রাজার বাড়ির গল্প শুনে কেইনা বড় হয়েছে। আর এই গল্পগুলোর প্রতি একটা অমোঘ আকর্ষণ আমাদের চিরন্তন। রাজপরিবার ও তাদের বাড়ি দেখার সুযোগ যদি কোনোদিন কারোর হয়, তাহলে জিঘাংসু মনের কিছুটা হলেও নিরসন ঘটে।

এমন একটা সুযোগ আমারও এসেছিল উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন। কিছু ভিন্ন রকম বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করব, এমন ইচ্ছা আমার বরাবরের। তাই স্নাতক পাস করার পর টী রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট নিয়ে আমি ভর্তি হই উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে। হোস্টেলে থাকতে শুরু করি। যেখানেই যাব সেখানেই একদল বন্ধুবান্ধব পাতানো আমার বরাবরের স্বভাব।আর বিশ্ববিদ্যালয় গিয়ে লেজ গজায় নি এমন প্রাণী হয়তো এ বিশ্ব চরাচরে কমই আছে। আমিও তার ব্যাতিক্রম হয় কি করে? তাই বন্ধুদের আবদারে এবং নিজের উৎকণ্ঠা নির্বাচন করার জন্য, বাড়িতে একপ্রকার না বলেই কোচবিহার চলে গেলাম।

এনজিপি স্টেশন থেকে এই তিন ঘন্টার পথ। প্রচুর ট্রেন ও বাস থাকায় যাতায়াতে অসুবিধা হয়নি বিশেষ। ছাত্রজীবন, অতএব পকেট ফাঁকা। তাই ঠিকানা হিসেবে বেছে নিতে হল বন্ধুর এক আত্বীয়ের বাড়িকে। একপ্রকার নাক-কান কেটেই। তবে কোচবিহারের রাজবাড়ি দর্শনের উৎকণ্ঠা এতটাই ছিল বাদবাকি আর সবকিছুই তাঁর কাছে ছিল তুচ্ছ।

যেদিন পৌঁছালাম, ঠিক তার পরের দিন ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়ল রাজবাড়ীর উদ্দেশ্য। সারাদিনটা ওখানেই কাটাবো বলে আমার সিদ্ধান্ত। আমার বন্ধু-বান্ধবেরা অবশ্য আমার সাথে একমত ছিল না। তারা এই ঘন্টাখানেক ওখানে কাটিয়ে, বাদ বাকিটা সময়টা পুরো শহরে এবং শহরের আশপাশে ঘুরে দেখবে বলে ভেবেছিল। কিন্তু আমার সাথে পেরে ওঠা তাদের আর হলো না। ঘুরতে যাওয়ার আগে আমি বরাবরই একটু পড়াশোনা করে নিতে বিশ্বাসী।

সেই থেকেই জানতাম,হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত পাশ্চাত্য শিল্পের অনুকরণে স্বাধীন রাজ্য হিসাবে কোচবিহার ভারতবর্ষের অন্যতম রাজ্য, যার রাজধানী ছিল বিহার ফোর্ট। অতীতে বৃহত্তর কামরূপ রাজ্যের অন্তর্গত ছিল এই কোচবিহার জেলা। বলা হয়, এই স্থানে কোচ বংশ প্রায় ৫০০ বছর শাসনকার্য চালায়। ১৫৩০ সালে কোচ বংশের রাজা বিশ্ব সিংহ এই কোচবিহারে এসে শাসন শুরু করেন। তারপর তাঁর ছেলে নরনারায়ণ এই রাজ্যকে বহুদূর বিস্তৃতি দেন। ১৭৭২ সালে ভুটানের সঙ্গে যুদ্ধের ফলে কোচবিহার রাজ ধৈর্জেন্দ্র নারায়ণ ও ওয়ারেন হেস্টিংস-এর মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর ফলে কোচবিহার ব্রিটিশদের ‘করদ’ রাজ্যে পরিণত হয়। অতঃপর শর্ত মতো কোচবিহারের অর্ধেক রাজস্ব ব্রিটিশদের দখলে আসতে শুরু করে।

১৭৭৩ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে এই স্থানের নতুন নামকরণ করা হয় ‘কোচবিহার’। কোচ জাতির বাসস্থান হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার সময় কোচবিহার ভারত ও পাকিস্তান কোন দেশের সঙ্গে যুক্ত না হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এবং এরপর ১৯৪৯ সালের ২৮শে আগস্ট জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ ভারতের সঙ্গে ‘ইন্সট্রুমেন্ট অফ আক্সেশন’ স্বাক্ষর করেন। ফলে, ওই বছর ১২ই সেপ্টেম্বর থেকে কোচবিহার ভারতে কমিশনার শাসিত প্রদেশে পরিণত হয়। ১৯৫০ সালের ১লা জানুয়ারি ভারত সরকার ব্রিটিশ আমলের ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের ২৯০-এর ক ধারায় প্রাদেশিক আইনের দ্বারা কোচবিহার রাজ্যটিকে পশ্চিমবঙ্গের একটি জেলায় পরিণত করে। তবে কোচবিহার গেজেট অনুযায়ী, মহারাজার নির্দেশে এই রাজ্যের সর্বশেষ নামকরণ হয় কোচবিহার। সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে রচিত ‘শাহজাহাননামা’ গ্রন্থে কোচবিহার নামটি উল্লেখ রয়েছে। জয়পুরের বিখ্যাত মহারানী গায়েত্রী দেবী এই কোচ রাজবংশের কন্যা। তবে এখানে যে নিতান্ত সামান্য তা ওখানে গিয়ে প্রমাণ হয়ে গেল।

ঢুকতেই প্রথমে চোখে পড়ে বিশাল এক এন্ট্রান্স গেট। যার মধ্যে বড় করে খোদাই করা কোচবিহারে রাজপরিবারের রাজকীয় চিহ্ন বা এমব্লেম। পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতবর্ষে অনেক অনেক রাজবাড়ী আছে কিন্তু কোথাও এরকম বৈভবশালী গেট এবং তার মধ্যে রাজকীয় কায়দায় খচিত চিহ্ন খুব একটা চোখে পড়ে না। যা দেখে সত্যি প্রমাণ হয়েছে, কোচবিহার রাজাদের বৈভব কোন অভাব ছিল না। সামান্য কিছু অর্থের বিনিময়ে প্রবেশ করি রাজবাড়ির ও রাজবাড়ী রাজবাড়ীর মিউজিয়ামে। বিশাল এই রাজবাড়ীর টিকিট কাটার সময়, সাথে আমি একটা বইও সংগ্রহ করি। যাতে রাজবাড়ি সম্পর্কে ছোট্ট করে কিছু তথ্য দেওয়া রয়েছে। যেমন,স্থাপত্য রীতিক্ল্যাসিক্যাল ওয়েস্টার্ন / ইতালীয় রেনেসাঁ। অবস্থান কোচবিহার, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।নির্মাণ শুরু হয়েছে১৮৮৭।গ্রাহক মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ।

কোচবিহার রাজবাড়ি ইষ্টক-নির্মিত। এটি ক্ল্যাসিক্যাল ওয়েস্টার্ন শৈলীর দোতলা ভবন। মোট ৫১,৩০৯ বর্গফুট (৪,৭৬৬.৮ মি২) এলাকার উপর ভবনটি অবস্থিত। বাড়িটি ৩৯৫ ফুট (১২০ মি) দীর্ঘ ও ২৯৬ ফুট (৯০ মি) প্রশস্ত। এর উচ্চতা ৪ ফুট ৯ ইঞ্চি (১.৪৫ মি)। ভবনের কেন্দ্রে একটি সুসজ্জিত ১২৪ ফুট (৩৮ মি) উঁচু ও রেনেসাঁ শৈলীতে নির্মিত দরবার হল রয়েছে। এছাড়া বাড়িতে রয়েছে ড্রেসিং রুম, শয়নকক্ষ, বৈঠকখানা, ডাইনিং হল, বিলিয়ার্ড হল, গ্রন্থাগার, তোষাখানা, লেডিজ গ্যালারি ও ভেস্টিবিউল। যদিও এই সব ঘরে রাখা আসবাব ও অন্যান্য সামগ্রী এখন হারিয়ে গিয়েছে।

তবে এই ইনফর্মেশন গুলো ছিল যৎসামান্যই। ভেতরে ঢুকে রাজবাড়ীর মিউজিয়াম ঘুরে আমার চক্ষু ছানাবড়া। কি নেই তাতে। বিশাল এক বিলিয়ার্ড থেকে শুরু করে রাজপরিবারে অনেক আসবাবপত্র, খাট-পালঙ্ক। এসব দেখা মনে হয় যেন আমি টাইম মেশিনে চড়ে পৌঁছে গেছে একশো বছর পেছনে। এবং উপভোগ করছে রাজকীয় জৌলুস নিজের চোখে। রাজবাড়ী আনাচে কানাচে ঘুরে জেনে নেওয়া গেল রাজবাড়ির অনেক অজানা ইতিহাস।
৹কোচ রাজবংশ (ইংরেজি: Koch Dynasty;অসমীয়া: কোচ রাজবংশ),

৹কোচ জাতির নাম থেকে এ শহরের নাম,

৹এখনকার ভারতের অসম ও বঙ্গের অন্তর্গত কমতা রাজ্যের এরা প্রাচীন শাসকগোষ্ঠী।

৹১৪৯৮ সনে খেন রাজবংশ -এর পতনের পর ১৫১৫ সনে কোচ রাজবংশ নিজেকে শক্তিশালী রুপে প্রকাশ করে।

৹কোচ রাজবংশের প্রথম রাজা বিশ্ব সিংহ ও তার পুত্র নরনারায়ন এবং সেনাপতি চিলারায়।

৹ অল্প দিনের মধ্যে কামরুপ রাজ্যের পশ্চিম অংশ ও দক্ষিণ অসমের কিছু অংশ দখল করে। পরবর্তী সময়ে রাজবংশটি দুইটি ভাগে বিভক্ত হয়ে কোচ বিহার ও কোচ হাজো নামে শাসন করা আরম্ভ করেন।
৹অবশেষে কোচ বিহার মোগলের অধীনস্থ হয় ও কোচ হাজো আসমের সাথে যুক্ত করা হয়।

এত সুন্দর একটা রাজবাড়ি ঘুড়ে, এক ব্যাগ ভর্তি তথ্য নিয়ে আনন্দে যথাসময়ে ফিরে এলাম বিশ্ববিদ্যালয়।এবং মনের মণিকোঠায় রেখে দিলাম আদ্যপ্রান্ত সাজানো শহর কোচবিহার ও তার ছবির মতো সুন্দর রাজবাড়ীটিকে।

Facebook Comments Box
Moumita Bhowal Das

Recent Posts

SVF Music Unveils April Edition of “Banglar Gaan Indies”

Following the resounding success of the inaugural edition, SVF Musicproudly announces the arrival of the…

1 week ago

Mimi Chakraborty and Nabila to Star Alongside Shakib Khan in ‘Toofan’

Amidst ongoing speculations regarding the leading lady opposite Shakib Khan in the upcoming film 'Toofan',…

1 month ago

Why Does a Rich Chicago Law Firm Keep Suing Indian Tribes?

This article originally appeared in DC Journal: https://dcjournal.com/why-does-a-rich-chicago-law-firm-keep-suing-indian-tribes/ Why does a deep-pockets Chicago law firm keep…

5 months ago

Anupam Roy’s ‘Aami Sei Manushta Aar Nei’ is a Musical Masterpiece

In a spectacular celebration coinciding with the birthday of the iconic actor Prosenjit Chatterjee, the…

7 months ago

অনুষ্কা পাত্রর কণ্ঠে শোনা যাবে দে দে পাল তুলে দে

হিমেশ রেশামিয়ার পর সুরাশা মেলোডিজ থেকে অনুষ্কা পাত্রর নতুন গান পুজো আসছে মানেই বাঙালির নতুন…

7 months ago

Srijit Mukherji’s Dawshom Awbotaar is On a Roller Coaster!

The highly awaited trailer of grand Puja release, "Dawshom Awbotaar", produced by Jio Studios and…

7 months ago

This website uses cookies.