Categories: Story Series

রাতের সহযাত্রী: প্রথম পর্ব

রাতের সহযাত্রী- প্রথম পর্ব

০২৮০৭- এম জি আর চেন্নাই সেন্ট্রাল এসি এস এফ স্পেশাল মেইলটি একেবারে ঝাঁ চকচকে, নতুন। কোথাও এতটুকু ধুলো নেই। এসি কামরার কোণ মোড়া চৌকো জানালার কাঁচ, মসৃণ সাদা স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ। যেন এক টুকরো প্রকৃতি চোখ ঠেলে সাঁই সাঁই করে পিছনে চলে যায় প্রতিনিয়ত। লতাপাতা আঁকা মোটা সুতোর কারুকার্য করা নীল সাদা পর্দা তার শোভা বর্ধন করছে। রাতের ঘন অন্ধকার আরো ঘনিয়ে উঠছে সারি সারি মিটমিটে নীলচে আলোয়। মুখোমুখি আপার বার্থের একটিতে তৃণা, অপরটিতে ওর থেকে আট বছরের ছোট ভাই রাহুল। লোয়ার বার্থে বাবা ও মা। সমিরন বসু অর্থাৎ তৃণার বাবা বছর দুয়েক হল নার্ভের সমস্যায় ভুগছেন। হাই প্রেসার, সুগার তো দশ বছর আগে থেকেই সঙ্গী। মাস দুয়েক মস্তিষ্ক বিকৃতির লক্ষণ দেখা দিচ্ছে। অযথা ভয় পান, শিশুদের মত আঁতকে আঁতকে ওঠেন, হঠাৎ ছায়ামূর্তি দেখতে পান। স্বপ্ন না সত্যি বলতে পারেন না। সমিরন বাবুর চিকিৎসার জন্যই ওদের চেন্নাই যাওয়া।

তৃণা অঘোরে ঘুমিয়ে পড়েছে। গল্পের বইটা খোলা অবস্থায় বুকের উপর পড়ে আছে, ডান হাতটা বইয়ের উপর রাখা। অচেতন হওয়ায় বাম হাত বার্থ থেকে অর্ধেকটা ঝুলছে। তখন রাত অনেক। হঠাৎ জানালার পর্দাটা উড়ে এসে তৃণার হাতে ঠেকলো। শুধু ঠেকলো না, যেন জড়িয়ে ধরল। ঘুম ভেঙে ধড়ফড় করে উঠে বসল তৃণা। কিন্তু বাইরে থেকে হওয়া ঢুকলো কী করে! সব জানালাই তো বন্ধ!

হাওয়া কী করে ঢুকলো, সেই নিয়ে এত রাতে খানাতল্লাশি কে করবে? বই টা বন্ধ করে পাশে রেখে তৃণা আবার শুয়ে পড়লো। তলিয়ে গেল গভীর ঘুমে। আস্তে আস্তে নীলচে আলোটা ধূসর কালো ধোঁয়ার মতো হয়ে কীসের একটা অবয়ব ধারণ করলো। যেন সবকিছু দানবের মত গিলে নেবে। রাহুল কেমন যেন বদলে যাচ্ছে। ভাই মুখ বিকৃত করে এমন হাসছে কেন! ওর কী হল? মুখটা! মুখটা ক্ষতবিক্ষত কেন! রক্তের স্রোত কোথা থেকে আসছে! মায়ের একটা হাত কই! মুখে স্টোন চিপ গুলো গাঁথা, যেন কেউ হাতুড়ি দিয়ে ঠুকে ঠুকে গেঁথে দিয়েছে। মায়ের দেহটা ঘুরপাক খাচ্ছে, ঘুরপাক খেয়ে কোন শূন্যে মিলিয়ে যাচ্ছে। বাবার চোখ দুটো ভাই উপরে নিতে যাচ্ছে, বাবা হাততালি দিয়ে খিলখিল করে হাসছে। তারপর বাবা আর ভাই একটা দড়ি নিয়ে ফাঁস তৈরি করলো; সেটা পরিয়ে দিল তৃণার গলায়। একি! বাবা জানালা খুলছে কেন? জানালার বরফি আকারের জালটা হাতে করে মাখনের মত কেটে ফেলল!‌ ফাঁকা জানালাটা দিয়ে মাথা গলিয়ে শরীরটাকে বার করে দিল চলন্ত মেল থেকে। বাবার হাতে ওর গলার সাথে বাধা দড়িটা— গলাটা একেবারে চেপে গেছে, দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আওয়াজ বেরোচ্ছে না গলা থেকে। অনেক চেষ্টা করে ‘‘বা—বা’’ বলে চিৎকার করে উঠল তৃণা। ওর সারা শরীর যেন অসাড় হয়ে গেছে, নড়াচড়া করার শক্তি নেই। কথা বলতে পারছে না। এতক্ষণ ও স্বপ্ন দেখছিল। বলাবাহুল্য দুঃস্বপ্ন। তখন প্রায় রাত দুটো বাজে। তৃণার মা মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,“কি হলো, ভয় পেয়েছিস? কতবার বলেছি রাত দুপুরে এসব ভূতের গল্প পড়িস না… কে কার কথা শোনে! জল খাবি?” মায়ের কণ্ঠস্বরে তৃণার সম্বিত ফিরল। মুখটা দেখে বুকে বল পেল। বলল,“না, ঠিক আছি।” ভাই ভেংচি করে বলল,“খুব তো বলিস, তুই সাহসী… ভয় পেলি তো? দশবার বল ভূত আমার পুত পেত্নী আমার ঝি, রাম লক্ষণ সঙ্গে আছে ভয়টা আমার কি” তৃণা মুখোশী রাগ দেখিয়ে বকা দিলো,“আহ! চুপ করবি? নাকি টক-ঝাল-মিষ্টি গাট্টা খাবি?” মনের ভিতর কি চলছিল বলা যায় না, তবে মুখে মৃদু হাসি। বাবা শান্ত স্বরে বললেন,“দিদি-ভাইতে খুনসুটি কাল সকালে কোরো! এখন চুপ করো। অন্যদের ডিস্টার্ব করোনা।” তৃণা ও রাহুল দুজনেই চুপ করে শুয়ে পড়ল। তৃণার বয়সটাই শুধু বেড়েছে। একুশ। ছেলেমানুষি ভাব কাটেনি, তবে সময় বিশেষে খুব সিরিয়াস; দায়িত্ব সহকারে সব কাজ গুছিয়ে করে। তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ওর দারুন।

তৃণা শুয়ে পড়ল বটে, কিন্তু ঘুম আর এলোনা। বাঁহাত ভাঁজ করে মাথার নীচে রেখেছে, ডান হাতটা পেটের উপর রেখে কিছুক্ষণ অন্তর অন্তর তাল দিচ্ছে; পা দুটো ভাজ করে তুলে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। মাথার মধ্যে একরাশ চিন্তা ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে। তৃণার সুন্দর ফরসা মুখটা বিবর্ণ হয়ে উঠছে, কপালে দুশ্চিন্তার বলিরেখা। গল্পের বইটা পাশে খোলা ছিল: ‘আতঙ্কের জ্বলন্ত ছবি’। একবার ভাবল ভূতের গল্প পড়ার জন্যই কি এমন ভয়ংকর শ্বাসরোধী স্বপ্ন দেখলো! মনে মনে বললো,“তাই হবে হয়তো! সাইকোলজিতে তো পড়েছিলাম, মনের তিনটি স্তর— চেতন, অবচেতন, ও অচেতন। অবচেতন স্তরে হয়তো সেই ভয়ঙ্কর কল্পনার ছবি রয়ে গিয়েছিল, সেটাই স্বপ্ন দেখেছি। ওটাই হবে, তা নয় তো আবার কি? এসব উল্টোপাল্টা চিন্তা আর করব না। না! না! না!” মনোবৈজ্ঞানিক যুক্তি খাড়া করে মনের ভয় কাটাতে চাইলে তৃণা। আবার পরক্ষনেই মনে পড়ল তবে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত বদ্ধ কামড়ায় দমকা হাওয়া কি করে ঢুকলো? এসব চিন্তা ভাবনায় মস্তিষ্কের সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর স্নায়ুগুলি যেন দাপাদাপি করতে শুরু করল। মাথাটা যন্ত্রনায় টনটন করছে। চোখ বুঝে নিজের মনটা, মাথাটা একটু স্থির করতে হবে। আবার একটা শব্দ শোনা গেল। জানালায় টোকা মারার আওয়াজ না? হ্যাঁ, তাইতো! জানালার পর্দাটা সরিয়ে দেখে ঘুটঘুটে অন্ধকার ভেদ করে, উঁকি দিচ্ছে কচি কচি দুটো হালকা গোলাপি হাত। কাঁচে মাকড়সার মতো আঁকড়ে ধরে আছে। ছোট ছোট হাত গুলো সবে মাত্র ভ্রূণ থেকে পুষ্ট হয়ে আকার পেয়েছে। আঙুলগুলোয় পাতলা আঁশের মতো সাদা চামড়া উঠে আছে। তৃণা খুব ভয় পেয়ে গেল। পর্দাটা সজোরে টেনে দিয়ে, কাউকে কিছু না বলে আবার শুয়ে পড়লো। এপাশ ওপাশ করছে। তৃণাকে অদ্ভুত এক অস্থিরতা ঘিরে ধরল।

কলমে- অর্যমা

Facebook Comments Box
Rikta Dhara

আমি বাংলা সাহিত্যের একজন গুণমুগ্ধ ছাত্রী। বর্তমানে লাফালাফির কন্টেন্ট রাইটার। লেখালিখির পাশাপাশি বিভিন্ন সৃজনশীল কাজ করতে ভালোবাসি। নিজের শৈল্পিক সত্তাটিকে সযত্নে লালন করি।

Recent Posts

পশ্চিমবঙ্গে ৩৪ বছরের CPIM সরকার

হলদিয়াতে পেট্রোকেমিক্যাল কারখানা শুরু হওয়া থেকে সিঙ্গুর থেকে টাটাদের চলে যাওয়া। বান্তলা থেকে ধান্তলা, ওদিকে…

2 months ago

The Legend Rides Again – Official Poster of Raghu Dakat Unveiled

A storm is brewing this Puja. The poster of Raghu Dakat has been revealed, and…

3 months ago

Kolkata to Witness B Praak’s Mesmerizing Performance at ‘Kolkata Odyssey’ on October 20th

The vibrant city of Kolkata is set to host an extraordinary musical event as renowned Indian music…

1 year ago

Celebrating Friendship and Togetherness with Pujo Pujo Gondho

In a heartwarming ode to friendship and the unifying spirit of Pujo, SVF Brands has…

1 year ago

Frustration Turned To Calmness, Thanks To These Websites

The year 2024 has not been what I had planned so far. Everything went downhill.…

1 year ago

SVF Music Unveils April Edition of “Banglar Gaan Indies”

Following the resounding success of the inaugural edition, SVF Musicproudly announces the arrival of the…

2 years ago