লেখনীর একরত্তি দেহে বন্দি জীবন হয়তো বা একসময় ফুরিয়ে আসে, কিন্তু প্রতিদিনের জীবনকে কেবল দুই মলাটের মাঝে আটকে রাখা চলে না। চোখ বুজে মনের অতল গর্ভ থেকে যখন খুশি এক আঁজলা তুলে নিলে, ঠিক কিছু না কিছু জুটে যায়। যদি না সে স্মৃতিভ্রষ্ট কোনো মানুষ হয়। তার চাইতে অসহায় বোধহয় দ্বিতীয় কেউ নেই।
অবশ্য সারা ঘরময় এটা-সেটা ছড়ানো থাকলে সেগুলো গোছানোও চাট্টিখানি কথা নয়। তেমনই রীতিমতো সাধনা না করলে আমার মতন একজন বিশিষ্ট অগোছালো হওয়াও সম্ভব নয়। একটুখানি ভূমিকা লিখতে গেলে নিজের অজান্তেই উপসংহারের প্রসঙ্গ পায়ে পায়ে এগিয়ে আসতে থাকে। আর শেষে চিরকালীন সেই অস্বস্তি – ইস! কত কিছু যে লিখে রাখার ছিল। ওইগুলো না বলা হয়েই থেকে গেল, সেগুলো তো গুছিয়ে লিখতেই পারলাম না। কোথাও কোথাও জিভটা যে এত আড়ষ্ট হয়ে যায় কেন! গাড়িটাকে ঠেলা দিতে যা একটু পরিশ্রম, তারপর সেখান থেকে একেবারে সোজা গড়ানে।
বহু বছর বাদে বুজুম ফ্রেন্ডের সাথে হঠাৎ সাক্ষাৎ ঘটলে যেরকমটা সচরাচর ঘটে থাকে।
‘কি রে পাঁচুউউউ! কেমন আছিস? আমায় নেমতন্ন করতে ভুলেই গেছিস বল?’ বলে সেই যে ছোটোখাটো বিস্ফোরণ হল, এরপর অনন্তকালের সময়ও বোধহয় মনের আশ মেটানোর জন্য যথেষ্ট নয়।
অবশ্য আমার কাছে অমন বন্ধু হতে গেলে তাকে গোটাকয়েক ধাপের মধ্যে দিয়ে যেতে হত। যখন স্কুলে পড়তাম, তখনই এসব অভিনব খেয়াল মাথায় এসেছিল। স্কুলের খাতাটার সেই বিখ্যাত শেষ পেজে চুপিচুপি কয়েকটা শর্ত বানিয়ে লিখে রেখেছিলাম। শিরোনামটা ছিল এইরকম – ‘ভালো বন্ধুর লক্ষণ।’ যে এইগুলো পাশ করতে পারবে, তার গায়ে আমি মনে মনে একখানা ব্যাজ সেঁটে দেব।
পঁচিশ বছরে পৌঁছে এখন এগুলো বেশ হাস্যকর ঠেকে, কিন্তু এটা ভেবে বেশ আক্ষেপ হয় যে জীবনকে সেই বয়সে কত সহজ ভাবতে পারতাম।
যাই হোক, সবকটা পয়েন্ট আর আমার স্মরণে নেই। তবু রচনার স্বার্থে একটু মনে করার চেষ্টা করছি।
এই যেমন আমার কেমন জানি ধারণা ছিল যে যাদের জামার কলার তোলা থাকে তারা বুঝি ঠিক সুবিধের ছেলে হয় না। কলার গোটানো থাকলে দেখতেও তো খানিক ভদ্র-সভ্য লাগে।
কিন্তু ক্লাবের ভোলাদাকে চাক্ষুষ করার পড়ার থেকে আমার এ ভুল ভেঙে গেছে। ওকে দেখতে চিরকালই পাগল টাইপ, কলারসমেত প্রিন্টেড শার্টের দুটো বোতাম খোলা, ঠোঁটের ফাঁকে সিগারেট, লোকে বলে উচ্ছন্নে যাওয়া ছেলে। কিন্তু ব্যাপার হল, দরকারে-অদরকারে সেই ভোলাকেই ডাকতে হয়। পাড়ার খিটখিটে পিসিমার বাড়ির বাজার থেকে শুরু করে অনীশজেঠুকে ধরে ধরে প্রতিমাসে চেক-আপে নিয়ে যাওয়া, কিংবা রাস্তার জঞ্জালকুড়ুনি ছেলেটাকে কাঁধে হাত রেখে “দিনকে দিন চুপসে যাচ্ছিস। খাওয়া-দাওয়া করছিস তো নাকি?” বলতে শুনে কখন যেন ধোপদুরস্ত কাঠখোট্টাদেরও মুখ ফসকে বেরিয়ে আসে – আশ্চর্য! ওর হৃৎপিন্ডটা তো আমাদের মতন বিগড়ে যায়নি!
যাক গে, কথায় কথা বাড়ে। আবার খাতার পাতায় ফিরি। পরের কোনো একটা লাইনে লিখেছিলাম, যদি কখনও কারোর সাধের স্কুলব্যাগ দিয়ে নিজের জায়গাটা মোছার অদম্য পরিকল্পনাটাকে বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করি, তাহলে আর পাঁচজনের মতো আমার পিঠে গুদুম করে কিল বসিয়ে দিলে চলবে না।
এ প্রসঙ্গে সুবীরের কথা খুব বলতে ইচ্ছে করছে। একবার টিফিনে ওর জলের বোতল থেকে খানিক জল চলকে গোটা বেঞ্চের ওপর পড়ে গিয়েছিল।
সেদিন আমার খুব জ্বর ছিল। আমার আবার শরীর খারাপ হলে স্কুল যাওয়ার বাসনাটা আরও চাগাড় দিয়ে উঠত। প্যারাসিটামল গিলে মায়ের যাবতীয় দুশ্চিন্তাকে হেলায় উপেক্ষা করে পিঠে ব্যাগ ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়তাম।
বলা নেই কওয়া নেই, সুবীর হঠাৎ ওর ব্যাগটা দিয়ে নিজেই বেঞ্চটা বিনাবাক্যে মুছে দেয়। আমি তখনও অনিমেষনেত্রে তাকিয়েই আছি, “তোর ব্যাগ তো পুরো ভিজে ন্যাতা হয়ে গেল রে!”
“ও কিছু নয়। তোর তো আজকে জ্বর, তাই ভাবলাম যদি আমার জন্য ঠান্ডা লেগে যায়…”
সত্যি, সেই যে টুয়েলভের পর ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল, তারপর যেন কত যুগ সুবীরের সাথে দেখা হয়নি।
দোষটা অবশ্য আমার ওপরেই বর্তায়। কলেজে অ্যাডমিশনের পর পরই আমরা শ্রীরামপুরে বাড়ি ভাড়া নিয়ে চলে এসেছিলাম। কাউকে জানাইনি। হঠাৎ করে কোম্পানিটা উঠে যাওয়ায় বাবা এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
কতরাত মা-বাবা দু-চোখের পাতা এক করতে পারেনি। আমি শুধু চুপচাপ দেখেছি আর পাশ ফিরে শুয়েছি। কিন্তু কিচ্ছু তো করতে পারিনি।
দুখানা ঘুপচি ঘর, আর একটা চারকোনা বাথরুম। তাই-ই সই। ভাড়াটাও তো বাবার সাধ্যের মধ্যে ছিল। কলেজ আর নতুন অফিস দুটোই কাছে হল, বাস ছেড়ে পায়ে হেঁটেই যাওয়া যাবে।
একমাত্র ছেলে কিনা, বাবা আমার জন্য যতটা পারছিল জমিয়ে রাখতে চাইছিল। কখনও চায়নি যে আমি খরচের কথা ভেবে পড়াশোনা থেকে পিছিয়ে আসি। সবসময় নতুন বই কিনে দিয়েছে, যাতে আমি বইয়ের মনকাড়া গন্ধ নেওয়াটা থেকে বঞ্চিত না হই।…
রবিবারে বেলায় রান্নাঘর থেকে মাছভাজার গন্ধ এলেই পড়া ফেলে ছুটে যেতাম।
“আমি কিন্তু একা মাছ খাব না মা।”
মা খুন্তিটাকে নামিয়ে রেখে বলত, “আমি জানি না। তোর বাবা রান্না করতে বলেছে। তুই না খেলে বাবা খুব কষ্ট পাবে। বলবে মাইনে পেয়ে বাজার করে আনলাম, আর ছেলে ছুঁয়েই দেখল না।”
আমি আর কি বলব। দুটো বাতাসা খেয়ে মায়ের আঁচলে মুখ মুছে আবার ঘরে চলে যেতাম।
সন্ধেবেলায় লোডশেডিং হলে একটু সমস্যা হত। হ্যারিকেন জ্বালিয়ে ভেক্টর অ্যানালিসিস-এর প্রবলেম প্র্যাকটিস করে যেতাম।
বাবা বলেছিল জেনারেটর ভাড়া নেবে। আমিই নিতে দিইনি। শীত কি শুধু বাবা-মা সহ্য করবে, আর আমি চাদর মুড়িয়ে আরামে বসে থাকব?
বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলত, “এই তো কটা বছর। চাকরিটা পেয়ে যা, তারপর থোড়াই রোজ আমরা ডালভাত খাব। আবার আগের মতো সব হয়ে যাবে দেখিস।”
মাঝে মাঝে শীতকালে তুলিদির বাড়ি বেড়াতে যেতাম। তুলিদি আমার কেমন যেন দূরসম্পর্কের তুতো দিদি। দুর ছাই! আত্মীয়তার অত জটিলতা বুঝি না। শুধু এটুকুই বুঝি ও ছাড়া ভাইফোঁটায় আমার কপালে আঙুল ছোঁয়ানোর আর কেউ নেই।
ওর পরিবারের অবস্থাও আমাদের চেয়ে খুব একটা আলাদা কিছু ছিল না। ভাত খাওয়ার সময় তুলিদি সবার শেষে মায়ের সাথে মেঝেতে খেতে বসত।
হঠাৎ এক দুপুরবেলায় দেখি, তুলিদি কুঁজো থেকে গবগব করে গেলাস গেলাস জল গিলে চলে এল।
আমি তক্ষুণি বললাম, “একি রে! তোর খিদে পায়নি? এর মধ্যেই খাওয়া-দাওয়া হয়ে গেল?”
তুলিদি কাঁচুমাঁচু মুখে বলল, “না রে। আজ তেমন খিদে নেই।”
“কেন? তুই তো এই টিউশন পড়িয়ে ফিরলি। সেই সকালে বেরিয়েছিলিস, আর এখন বলছিস…ডায়েটিং করছিস নাকি?”
“হ্যাঁ। এই যে, তোর জন্য। যা কাঁকলাস হয়ে যাচ্ছিস তুই…” বলে চট করে সামনে থেকে পালিয়ে গেল তুলিদি।
আমার আর বুঝতে বাকি রইল না। মনে পড়ল, তুলিদি প্রায়ই জোর করে ঝপাঝপ পাতে অতিরিক্ত কয়েক হাতা ভাত ঢেলে দেয়। আমিও আকাট মূর্খের মতন গোগ্রাসে খেয়ে নিই।
নিজের ওপর অত রাগ কক্ষনো হয়নি। বুকে এসে ধাক্কা লেগেছিল – এগুলোকে দেখনদারি বলে না। সত্যি সত্যি বুঝেছিলাম, মেয়েদের মায়ের জাত কেন বলে।
ঠিক এই মুহূর্তে যদি আমার চোখের কোলে অশ্রুর আভাস ফুটে ওঠে, তাহলে পূবালীও থাকতে না পেরে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলবে। আমি জানি। সযত্নে আমার চোখদুটো মুছিয়ে দেবে, কিন্তু নিজের চোখমুখের দিকে খেয়াল অবধি করবে না।
মাঝে মাঝে নিজেকেই সন্দেহ হয়, কোনোভাবে আশপাশের মানুষগুলোর দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে তুলছি না তো! যে চৌহদ্দির মধ্যে বেড়ে উঠেছি, সেখানে ওরা আমায় আজন্ম আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে। নির্দ্বিধায় আমার অবয়ব থেকে কষ্টগুলো উপড়ে নিয়ে নিজেদের গায়ে টেনে নিয়েছে। যাতে এই দূষিত পরিবেশে আমি অন্তত প্রাণ ভরে বাঁচতে পারি।
পুরোনো পাড়া ছেড়ে চলে আসার পর আর ভুলেও ওমুখো হইনি। কাউকে নতুন ঠিকানাও দিইনি। এইটেই সবচেয়ে কঠিন কাজ ছিল। নিকটজনদের সাথে যোগাযোগ ছিন্ন করতে চাইলে তারা যে আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরতে চায়।
আটটা বছর এভাবেই কেটে গেছে। ভাগ্যক্রমে কারোর সঙ্গে সামনাসামনি দেখা হয়নি। সেরকম ঘটলে আমায় হয়তো দোষীর মতো মুখ লুকোতে হত।
কিন্তু ওই যে বলে, যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধে হয়। সেদিন অন্যমনস্কভাবে বাসস্ট্যান্ডে পায়চারি করছি, বাড়ি ফেরার তাড়া ছিল। মা একবার শাড়ির দোকানে যেতে চেয়েছে। পূবালীর জন্মদিন মা কিছুতেই ভোলে না। এই ফাঁকে মাকেও একটা জামদানি কিনে দেব।
আচমকা পিঠে একখানা থাবড়া এসে পড়ল। না না টেনিদার মতন অত তীব্রতা তার নেই, তবে গায়ে খানিকক্ষণের জন্য জ্বলুনি ধরিয়ে দেওয়ার পক্ষে ওটুকুই যথেষ্ট।
পিছন ফিরতেই আমি মারাত্মক চমকে উঠি। সামনে দাঁড়িয়ে আছে একজন যুবক, মাথাভর্তি ফুরফুরে চুল। পরনে মসৃণ চামড়ার ওপর ঝকঝকে একখানা ব্লেজার। কবজিতে সোনাটার রিস্টওয়াচ।
আমি ঢোক গিললাম। বেশভূষা আমূল পালটে গেলেও চোখের দৃষ্টি অবিকল সেই ছেলেবেলার মতো জ্বলজ্বলে। এতটুকু পরিবর্তন হয়নি।
ছেলেটা মারমুখী হয়ে তেড়ে এল, “তুই না…একটা আস্ত উল্লুক। সেই কবে এ সেকশনের সেকেন্ড বেঞ্চ খালি করে বেরিয়ে গেলি, তারপর কোনো পাত্তা নেই। রেজাল্টের দিনকয়েক পর শুনলাম তোরা নাকি পাড়া ছেড়ে চলে গেছিস। কতবার ল্যান্ডলাইনে তোকে ফোন করেছি জানিস? আমাকে একবারও জানানোর প্রয়োজন মনে করলি না?”
ক্রমশ…
পর্ব ১ঃঅলিগলি
পর্ব ২ঃঅলিগলি
The vibrant city of Kolkata is set to host an extraordinary musical event as renowned Indian music…
In a heartwarming ode to friendship and the unifying spirit of Pujo, SVF Brands has…
The year 2024 has not been what I had planned so far. Everything went downhill.…
Following the resounding success of the inaugural edition, SVF Musicproudly announces the arrival of the…
Amidst ongoing speculations regarding the leading lady opposite Shakib Khan in the upcoming film 'Toofan',…
This article originally appeared in DC Journal: https://dcjournal.com/why-does-a-rich-chicago-law-firm-keep-suing-indian-tribes/ Why does a deep-pockets Chicago law firm keep…
This website uses cookies.