নির্মল ও লটারির যোগসূত্রে সুতো বাঁধলো অশরীরী

দুপুর থেকেই মেঘ ধরেছিল। মুষলধারে বৃষ্টি নামল তার সঙ্গে এলোপাতাড়ি বজ্রপাত। আবহাওয়া দপ্তরের নিম্নচাপের পূর্বাভাস এতোটা সত‍্যি হবে এবং এতো তীব্র হবে ভাবতে পারেনি নির্মল । আজই তার কাছে লটারি তে পাওয়া নগদ ৬০০০০ টাকা দিয়ে যাওয়ার কথা ছিল মন্টুর লটারির দোকানের ছোকরার। নির্মলের অভাবের সংসারে ৬০০০০ টাকা আসলে মাস দুয়েক তাকে ভাবতে হবেনা। নিশ্চিন্তে কেটে যাবে। সঙ্গে তো মাছ ধরা আছেই।

নির্মল জন্ম থেকেই নয়নপুরে থাকে। নির্মলের কথায় নয়নপুরের বন, জঙ্গল, গাছপালার হাওয়ায় একটা চুম্বকীয় ভালোবাসা আছে, তাই সে এই জায়গা ছেড়ে অন‍্য কোথাও যেতে পারেনি। নির্মল পেশায় একজন জেলে। মাছ ধরেই তার সংসার চলে। তিনজনের সংসারে চাহিদাও তেমন কিছু না থাকায় খেয়ে, পরে কাটাতে কষ্ট বেশ একটা হয় না।  তবে এবার মেয়েটাকে একটা ভালো ডাক্তার দেখাতেই হবে তাকে। মেয়েটা তার ৮ বছর বয়স থেকে হৃদরোগে আক্রান্ত, এখন ১১ বছর বয়স। হৃদরোগের ভালো চিকিৎসা করানোর সাধ‍্যি নির্মল এর নেই। তাই সে মাসে দু একবার লটারি  কাটে, যদি ভাগ‍্যের জোরে মোটা অঙ্কের টাকা জেতে এই ভেবে। কোনোবারেই সে হাজার দেড় হজারের বেশি জেতেনি। এবারের লটারি তে জেতা টাকাটাই তার সর্বোচ্চ মূল‍্যের। এই টাকা জমিয়েই সে মেয়ের চিকিৎসা করাবে। এছাড়া তার লটারি খেলার কোনো উদ্দেশ্য নেই।

যত রাত বাড়ে বৃষ্টি বাড়তেই থাকে আর তার সঙ্গে বিদ‍্যুতের ঝলকানিতে আঁধার রাত আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে থাকে। এই বৃষ্টি আজ আর থামার নয়, খামখা সকালবেলায় ঘরে বসেছিল নির্মল । আজ বিকেলেও মাছ ধরতে যেতে পারলোনা। ঘরে দুমুঠো চাল আর নুন ছাড়া কিচ্ছু নেই। নুনভাত খেয়েই তাদের তিনজনকে আজ রাতটা কাটাতে হবে। তাই খেয়েই শুয়ে পড়লো নির্মল , তার বৌ ও মেয়ে।  একটু রাত বাড়তেই দরজায় কড়া নাড়ানোর শব্দ শুনে ঘুম ভাঙল নির্মলের। এতো রাতে আবার কে এল!

দরজা খুলতেই হুড়মুড়িয়ে এক তরুণ ঢুকে পড়লো। নির্মল কিছুক্ষণ অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকার পর দুজনকে তার পরিচয় জিজ্ঞেস করায় সে বলল শহর থেকে এই নয়নপুরে কাজে এসেছিল কিন্তু বৃষ্টি পড়ায় এখানে ফেঁসে যায়। তাই আশ্রয়ের খোঁজ করতে করতে এখানে এসে পৌঁছেছে। নির্মল তার বসার জন‍্য খাট পেতে দিল আর বৌকে চা করতে বললো।

নির্মলের বৌ তরুণ ব‍্যক্তিটিকে চা দিল। চা খেতে খেতে নির্মল লোকটিকে জিজ্ঞেস করলো- “আপনি কোন কাজে নয়নপুরে এসেছিলেন?”
নির্মলের কথার উত্তরে লোকটা বললো
– “অফিসের কাজে তো বটেই তার সঙ্গে নয়নপুরে ঘুরতেও এসেছিলাম। নয়নপুর ঘোরা হলেও অফিসের কাজটি হয়নি!”
–তা আপনার অফিসের কী কাজ?
– আমি লটারি এজেন্সিতে কাজ করি। এখানের এক ব‍্যক্তি লটারিতে ৬০ লক্ষ টাকা জিতেছে সেই টাকা দিতেই এখানকার স্থানীয় লটারি দোকানে এসেছিলাম সঙ্গে নয়নপুর ঘুরতেও।
– ৬০ লক্ষ টাকা! কে জিতেছে, কি ভাগ‍্য তার!
– তার ভাগ‍্য ভালো থাকলেও এখানকার লটারি দোকানের লোকটা মোটেও ভালো না, আমি যখন বলেছি নিজে গিয়ে লোকটার  হাতে চেক তুলে দেব, অমনি তিনি খচে গেলেন!
– তা কে পেয়েছে এত টাকা?
– দাঁড়ান, নাম টা দেখে বলছি।
–সত‍্যি বলতে খুব ভাগ‍্যবান সে, এতগুলো টাকা কোনোদিন চোখেই দেখিনি।
– নির্মল মাঝি পেয়েছে।
– কি বলেন! আমিই তো নির্মল মাঝি।
– যাকগে ভালোই হল, বৃষ্টি বাদলে আপনার ঘরেই এলাম আর এটাই আমার গন্তব্য ছিল। নিন চেকটা ধরুন। ব‍্যংকে গিয়ে ভাঙিয়ে নেবেন।

নির্মল লোকটার হাত থেকে চেকটা ধরতে গিয়ে দেখলো, লোকটার শরীর থেকে রক্ত ধুয়ে মেঝেতে বৃষ্টির জলের সঙ্গে বয়ে যাচ্ছে। শুধু মেঝে নয় সমস্ত উঠোনে রক্ত আর জলের মিশ্রণ!

নির্মল কিছু বলার আগেই, লোকটা ব‍্যতিবস্ত হয়ে ব‍্যাগ কাঁধে দরজার দিকে এগোল। যাওয়ার আগে নির্মলের সঙ্গে হাত মেলানোর জন‍্য হাতটা বাড়িয়ে দিল। নির্মল হাতটা ছুঁতেই বরফের মতো ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল গোটা শরীরে। এমন ঠান্ডা সে কোনোদিন অনুভব করেনি। বুকে ভয়ের সঞ্চয় হতে থাকলো নির্মলের। হাঁ করে অবাকের মতো তাকিয়ে থাকলো লোকটার দুচোখে। চোখগুলোতে যেন আর প্রাণ নেই, ধবধবে সাদা দুটি চোখ।

নির্মল এর মনের মধ‍্যে তখন অনেকগুলো প্রশ্নের জট, উত্তর খুঁজতে গিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছে সে। ঠিক তখন লোকটা ভারী গলায় বলল–
“লটারি দোকানে এরপর লটারি কাটলে নিজে গিয়ে চেক করে আসবেন। দোকানের লোকটা বড্ড লোভী। অন‍্যের টাকায় নিজের পকেট গোছায়। আজ হাতেনাতে ধরেছি। তবে ধরে রাখতে আর পারলাম না। নিজের কুকর্ম ঢাকতে সে খুন পর্যন্ত করতে দ্বিধা বোধ করলো না! খুন করলেও আপনার টাকা সে কিছুতেই পাবেনা, এই শপথ নিয়েই আপনার কাছে আসা। আমার কাজ শেষ, এবার আমি আসি।”

দরজা পার হতেই লোকটা তার বাইকে বসে স্টার্ট দিলো আর মূহুর্ত্তের মধ‍্যেই মিলিয়ে গেল রাতের অন্ধকারে আর বলে গেল – “বিশ্বাসে মিলায়ে বস্তু, তর্কে বহুদূর”।

নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেনা নির্মল।   ৬০ লক্ষ টাকা সে পেয়েছে এটাও যেমন বিশ্বাস করতে পারছেনা, ঠিক তেমনই বিশ্বাস করতে পারছেনা একটা অশরীরী এতটা সৎ হতে পারলে মানুষ কেন হতে পারেনা!

Facebook Comments Box
Staff Writer

Editorial Team of LaughaLaughi

Recent Posts

পশ্চিমবঙ্গে ৩৪ বছরের CPIM সরকার

হলদিয়াতে পেট্রোকেমিক্যাল কারখানা শুরু হওয়া থেকে সিঙ্গুর থেকে টাটাদের চলে যাওয়া। বান্তলা থেকে ধান্তলা, ওদিকে…

2 months ago

The Legend Rides Again – Official Poster of Raghu Dakat Unveiled

A storm is brewing this Puja. The poster of Raghu Dakat has been revealed, and…

3 months ago

Kolkata to Witness B Praak’s Mesmerizing Performance at ‘Kolkata Odyssey’ on October 20th

The vibrant city of Kolkata is set to host an extraordinary musical event as renowned Indian music…

1 year ago

Celebrating Friendship and Togetherness with Pujo Pujo Gondho

In a heartwarming ode to friendship and the unifying spirit of Pujo, SVF Brands has…

1 year ago

Frustration Turned To Calmness, Thanks To These Websites

The year 2024 has not been what I had planned so far. Everything went downhill.…

1 year ago

SVF Music Unveils April Edition of “Banglar Gaan Indies”

Following the resounding success of the inaugural edition, SVF Musicproudly announces the arrival of the…

2 years ago