হেরে যাওয়া মানুষের মৃত্যুর পরে জিতে যাওয়ার গল্প- ” জার্সি ” !

আমি হেরে গেলাম- এই কথাটা বলতে বলতে আমরা একদিন ক্লান্ত হয়ে পড়ি। তারপর একটা সময় পর হাল ছেড়ে ভাগ্য কিংবা নিয়তিকে নিষ্ঠুর আখ্যা দিয়ে পুরো একটা জীবন আপসোসেই কাটিয়ে ফেলি! ” জার্সি” আমাদের জীবনটাকে নতুন ভাবে বাঁচতে শেখাবে এবং চিনতে শেখাবে। এই যে আমরা ভাবি পঁচিশ থেকে তিরিশের মধ্যেই জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে না পারলে আমরা ফুরিয়ে যাবো, তলিয়ে যাবো অনিশ্চিত পথের অন্ধকারে কিন্তু এই সিনেমার হিরো তার জীবনের সাফল্যের পথচলা শুরু করবে চল্লিশ বছর বয়সে, হ্যাঁ ঠিক শুনেছেন চল্লিশ!

এই গল্প একজন হেরে যাওয়া ক্রিকেটার অর্জুনের যার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন সাউথ অভিনেতা ন্যানি।তাঁর অসামান্য হৃদয় নিঙ্গড়ানো অভিনয় আমাকে প্রতিটা মুহূর্তে মুগ্ধ করেছে! গল্পের শুরুটা হয় নিউ ইয়র্ক শহরের এক নাম না জানা বুক স্টোরে, যেখানে একজন যুবক একটি বেস্ট সেলিং বইয়ের লাস্ট কপি কিনবে! এরপর দু’জন মেয়ে সেই বই কিনতে এলে যুবক তার বইটি তাঁদের দিয়ে দেয়! মেয়ে দু’টি কার্যতই অবাক হয়ে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে যুবকটি জানায় এই বই তার’ই বাবার জীবনকাহিনী। তারপর শুধু হয় ছেলের মুখে তার হেরে যাওয়া বাবার অমরত্বের কাহিনী।

সালটা ১৯৮৬ যখন অর্জুন একজন প্রাণশক্তিতে ভরপুর, তেজস্বী রঞ্জি ক্রিকেটার যার ভালোবাসা হল সারা, এই গল্পের নায়িকা যার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন শ্রদ্ধা শ্রীনাথ। সেইসময় অর্জুন ছিল সবচেয়ে প্রতিভাবান ক্রিকেটার , তার ব্যাটিং টেকনিক ছিল সবার থেকে ভিন্ন, তৎকালীন সময়ে তাঁর প্রতিভার সীমানার ধারেকাছেও কেউ ছিল না। তবু সিলেকশন টিমের রাজনৈতিক চক্রান্তে সে শেষ অব্দি ন্যাশেনাল টিমে জায়গা করে নিতে পারেনি। অবশ্য এরপর একটি বিশেষ কারণে অর্জুন তাঁর প্রাণাধিক প্রিয় ক্রিকেট খেলায় চিরকালের মতো ইতি টেনে দেয়, শুরু করে প্রিয়তমা সারা’র সাথে স্বপ্নের সংসার!

খেলা ছেড়ে দেবার পরেও সে হেরে যায়নি। আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতো দশটা পাঁচটার চাকরিতে জয়েন করে অর্জুন, তারপর ছকবাঁধা জীবন ভালোবাসায়, আদরে- আপ্যায়নে এগিয়ে যেতে থাকে মসৃণভাবে! দু’জনের প্রেমের সাক্ষ্য বহন করে পৃথিবীতে আসে তাঁদের ছেলে- নানি। এই নির্মল, প্রাণবন্ত অক্সিজেনের মাঝে হঠাৎ আগমন ঘটে প্রাণনাশক কার্বন মনোক্সাইডের। মিথ্যে বদনামে অর্জুনের চাকরি চলে যায়, দিশেহারা অর্জুন এরপর একটু একটু করে ফুরিয়ে যেতে থাকে! দশবছর আগে ব্যাট হাতে মাঠ কাঁপানো সেই মানুষটা আজ, নিজের ভেতরের প্রাণশক্তি হারিয়ে জুয়া-মদের শেকলে বাঁধা পড়ে প্রতিমুহূর্তে ছটপট করছে একটু মুক্তির জন্য! এখন সে নিজের স্ত্রীর কাছে একজন অপদার্থ স্বামী আর ছেলের সামান্য না মেটাতে পারা একজন অসহায় বাবা, এটাই তাঁর পরিচয় হয়ে দাঁড়ায়।

এই হেরে যাওয়া বাবা নিজের ছেলেকে মাত্র পাঁচশো টাকার ” জার্সি ” ও কিনে দিতে ব্যর্থ! গল্পের মূল স্তম্ভ এই জার্সিকে কেন্দ্র করেই। একজন অপদার্থ স্বামীর থেকে একজন অপদার্থ বাবার পরিচয় অনেক বেশি বেদনাদায়ক! ছোট্ট নানি তার বাবার খেলা সচক্ষে দেখার পর থেকে সে মুগ্ধ, সচিনের ছবির জায়গায় নিজের বাবার ছবি বসিয়ে ছোট ছেলেটি নিজের মুগ্ধতাকে ব্যক্ত করে! সেই থেকেই শুরু হয় অর্জুনের ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই। হেরে যাওয়া মানুষটি আবার নতুন করে সবকিছু শুরুর করার প্রচেষ্টায় নিজেকে সম্পূর্ণ ভাবে নিয়জিত করে। ছেলের জন্য সে আবার লড়াই করার শক্তি জোগাড় করে এবং অসমর্থ হবার অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে চায়!

এটাও পড়তে পারেন- Special Ops: A breathtaking suspense thriller web series!

এরপর হেরে যাওয়া ক্রিকেটারের সাফল্যের গল্পটা শুরু হয়। চল্লিশ বছর বয়সে আবার ব্যাট হাতে মাঠের আঙিনায় দেখা যায় একজন প্রাণশক্তিতে পরিপূর্ণ বাবাকে, যার একমাত্র লক্ষ্য নিজের ছেলের চোখে ‘হিরো’ হয়ে নতুনভাবে জন্ম নেওয়া। রঞ্জির প্রতিটা ম্যাচে অসামান্য প্রদর্শন, বয়সের ভারে নুইয়ে ভরা অর্জুনের হাতের শক্তি দেখে গোটা স্টেডিয়াম তখন সরগরম! এরমাঝে ছন্দ কাটে অর্জুনের ক্রিকেট ছাড়ার মূল কারণ- ” অ্যারিথমিয়া ” , একটি হার্ট ডিজিজ যারফলে মানুষের অনিয়মিত হার্টবিট সৃষ্টি হয়! ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী সে খেলা ছাড়তে বাধ্য হয় কারণ অতিরিক্ত শারীরক পরিশ্রম তারজন্য প্রাণনাশক হয়ে দাঁড়াবে।

হেরে মানুষটি কি তাহলে আবারও নিয়তির পরিহাসে হেরে গেল? সিনেমার দৃশ্যপটে গল্পের সূত্রকার অর্জুনের ছেলে একটি প্রেস কনফারেন্সে জানায় রঞ্জি ম্যাচের ফাইনালের দু’দিন পরেই তার বাবা মারা যায়। তাঁর মৃত্যুই তাঁকে অমরত্ব দান করে, হেরে যাওয়া মানুষটিকে জিতিয়ে দিয়ে যায় পুরো দুনিয়ার কাছে আর নিজের ছেলের চোখে সে “হিরো” হয়ে প্রতিষ্ঠাতা লাভ করে চিরকালের জন্য! অর্জুনের সেই অসামান্য হার না মানা লড়াইয়ের গল্প নিয়ে লেখা বই এখন বেস্ট সেলিং। আজ ছেলে নানির হাতে সেই ইন্ডিয়ান “জার্সি”। মৃত্যুর পরেও একজন হিরো বাবা তাঁর ছেলের আব্দার মিটিয়ে নিজের দায়িত্ব পালন করেছে! আজ সবকিছু আছে- নাম, সাফল্য কিন্তু শুধু সেই সাফল্য অর্জন করা মানুষটাই নেই।

হেরে যাওয়া মানুষের মৃত্যুর পরে জয়ী হওয়ার এই সিনেমার IMDb রেটিং ৮.৬। নিঃসন্দেহে এই সিনেমাটি মনে দাগ কেটে যাওয়ার মতো কিন্তু গল্পের খাতিরে কিছু দৃশ্য অতিরঞ্জিত করা হয়েছে বলে আমার মনে হয়েছে যেমন- এতোগুলো বছর বিনা প্র্যাকটিসে নতুনভাবে ফিরে আসার পরেও প্রতিটি অর্জুনের অসামান্য প্রদর্শন, এক্ষেত্রে আমার মনে হয়েছে যেকোনো ব্যাটসম্যানের পক্ষে বিনা অনুশীলনে এতোটা ফর্মে থাকা সম্ভব কী? তবু বলব গল্পের খাতিরে এই প্রচেষ্টা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে! জীবনের পরাজয় যতবারই আসুক না কেন, নতুন করে শুরু করার কোনো বয়স হয় না। ভাগ্য কিংবা নিষ্ঠুর নিয়তির ওপর আমাদের কোন হাত নেই কিন্তু নিজেদের অদম্য জেদ আর প্রাণশক্তি দিয়ে আমরা ফুরিয়ে যেতে যেতেও আগুনের স্ফুলিঙ্গ সাথে নিয়ে জ্বলে উঠতে পারি! হেরে যাওয়া খরস্রোতা নদীর স্ত্রোতকে নিজেদের চেষ্টা দিয়ে শান্ত করতে পারি! এই সিনেমা আমাদের সেটাই শেখাবে। কিছু সিনেমা শুধুমাত্র হয়তো এন্টারটেইনমেণ্টের জন্য হয় না, কিছু সিনেমা ভাবতে শেখায়, আমাদের বাঁচতেও শেখায়!

Facebook Comments Box
Staff Writer

Editorial Team of LaughaLaughi

Recent Posts

অনুষ্কা পাত্রর কণ্ঠে শোনা যাবে দে দে পাল তুলে দে

হিমেশ রেশামিয়ার পর সুরাশা মেলোডিজ থেকে অনুষ্কা পাত্রর নতুন গান পুজো আসছে মানেই বাঙালির নতুন…

2 days ago

Srijit Mukherji’s Dawshom Awbotaar is On a Roller Coaster!

The highly awaited trailer of grand Puja release, "Dawshom Awbotaar", produced by Jio Studios and…

4 days ago

আসছে Klikk Originals NH6 ওয়েব সিরিজ

আসছে Klikk Originals এর আগামী ওয়েব সিরিজ। জন হালদার এর প্রযোজিত ও পরিচালিত রোমহর্ষক থ্রিলারNH6…

4 days ago

Jeet Unveils the First Look of Manush

On the auspicious occasion of Ganesh Chaturthi, Bengal's Superstar Jeet Unveils the First Look of…

1 week ago

Pokkhirajer Dim Gears Up for an Enchanting Journey

'Pokkhirajer Dim' Gears Up for an Enchanting Journey with Jio Studios and SVF Entertainment We…

1 week ago

Raktabeej Teaser Wows Audience

Windows Productions --- loved by its audiences for content-driven cinema --- is bringing its biggest…

3 weeks ago

This website uses cookies.