থ্রি ইডিয়ট

ইডিয়ট কথাটা শুনলেই আমাদের মনে এক অন্যরকরম অনুভুতি হয়, ভৎর্সনা হিসেবেই সবাই কথা টাকে নেয়, এই ভাব ধারা বদলে ইডিয়ট শব্দকে থ্রি সিক্সটি ডিগ্রি বদলে দিয়েছিলো রাজকুমার হিরানি ২০০৯ সালে।
‘থ্রি ইডিয়ট’ এই নামেই ২০০৯ সালে প্রকাশ পায় রাজকুমার হিরানির কমেডি/রোমান্স সিনেমা। যাতে অভিনয় করেছেন অনেক গুণ্যমান্য অভিনেতা অভিনেত্রি কিন্তু তাদের মধ্যে যাদের নাম না নিলে বলাটাই সার্থক হবে না, তারা হলেন আমির খান( রাঞ্চোড়), ওমি( চাতুর/সাইলেন্সর), আর. মাধভান(ফারান), বোমান ইরানি( ভিরু সাহাস্ত্রাবুদ্ধে/ ভাইরাস), সারমান জোসি( রাজু রাস্তোগি), কারিনা কাপুর(পিয়া), রাহুল কুমার(মিলি মিটার)।

সিনেমাটা আদতে একটি কেমডি সিনেমা কিন্তু কেমডির আড়ালে এই সিনেমাতে আছে শিক্ষা সমাজের একটি খারাপ দিকের প্রতি বিদ্রুপ।
আমাদের ছোটোর থেকেই শেখানো হয় যে পরীক্ষাতে বেশি নম্বর পেতেই হবে, নাহলে ভালো স্কুলে সুযোগ পাবো না, ভালো কলেজে সুযোগ পাবো না, ভালো চাকরি পাবো না। আমাদের মনে কি আছে তা জানার চ্যাস্টা কেউ করে না আর এই সমাজের সাথে পাল্লা দিতে দিতে আমরাও নিজের অন্তরে লুকিয়ে থাকা সুপ্ত প্রতিভাগুলোর গলাটিপে মেরে ফেলি ঠিক যেমন ফারান করেছিলো সিনেমাতে। সে ছিলো ফোটোগ্রাফিতে পারদর্শী কিন্তু বাড়ির চাপে সে ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ভর্তি হয়, কারণ তার বাবার চেনা জানা অনেকের ছেলেই ইঞ্জিনিয়ার। আসলে তার বাবা তাকে সমাজের এক ভিষন নোংরা প্রতিযোগিতায় ঠেলে দিতে চেয়েছিলেন কিন্তু ফরানের মন যেনো সেই ওয়াইল্ড লাইফ ফোটোগ্রাফিতেই পড়েছিলো। এই হলো এই সিনেমার প্রথম ‘ইডিয়ট’ যে বাড়ির চাপে, সমাজের চাপে নিজের প্রতিভার থেকে পালাতে চেয়েছে শুধু।

আমাদের মধ্যে আবার অনেকের মনে ভিষন রকমের ভিতু মানুষ লুকিয়ে থাকে, যা বেশি করে প্রকট হয় ঠিক পরীক্ষার আগে। বিভিন্ন তান্ত্রিকের দেওয়া মাদুলি বা ধূপ-ধুনো দিয়ে আমরা পরীক্ষায় পাশ করার প্রয়াশও করি। ঠিক যেমনটা করে ছিলো রাজু রাস্তোগি। সিনেমাতে দেখাগেছে রাজু গরিব ঘরের একমাত্র সন্তান, যার বাড়িতে একজন অবিবাহিত বোনও আছে। স্বাভাবিক ভাবেই তার উপর সর্বদা একটা চাপ থেকেই যায়, আর এই চাপের সাথে প্রতিদিন লড়তে লড়তে সেও আর ইঞ্জিনিয়ারিং-এ মন বসানো তো দূরের কথা প্রতিবার পরীক্ষায় শেষ স্থানটা পায়। এই হলো সিনেমার আর এক ‘ইডিয়ট’ যার ভয় তাকে রোজ একটু করে শেষ করছিলো।

সবশেষ ‘ইডিয়ট’ হলো রানঞ্চোড়। এই ছেলেটা পুরো গল্পটাকে বদলে দেয়। তার পরিচয় কি, সে কে, কেউ জানতো না হঠাৎ করে একটা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ যেখানে সবাকে ইঞ্জিনিয়র না যন্ত্রে রুপান্তরিত করা হয় সেখানের সবার চিন্তাধারাতে কোপ মারার জন্য এসে উপস্থিত হয়। সে যেনো বাসার সব ছোটো পাখিদের মধ্যে একা লুকিয়ে থাকা বাজ পাখি, সবাই যখন আকাশে উড়তে ব্যস্ত সে তখন মেঘেদের ভেদ করে তারও উপরে উড়ার প্রচেষ্টা চালাতে ব্যস্ত। কেলেজের রেগিং-এর সময় তাকে দেখা যায় প্রথম, রেগিং থেকে বাঁচতে সে কিছু মুহূর্তের মধ্যেই একটি যন্ত্র বানিয়ে সিনিয়রদের যেনো বুঝিয়ে দেয় যে ‘ তোমাদের আমি শেখাবো আসলে ইঞ্জিনিয়ারিংটা কি!’।

হোস্টেলের একটি রুমের মধ্যেই থাকতো রাজু, ফারান, আর রাঞ্চোড়। সবাই যেখানে সিলেবাসের পড়ার বাইরে কিছু পড়ার কথা ভাবতে চায়তো না সেখানে রাঞ্চোড় তার মনের মতো ক্লাসরুমে বসে পড়তো কারণ তার মতে জ্ঞান সব জায়গাতে আছে যেখান থেকে পারবে নিয়ে নাও। সে যেনো অন্যরকম, সে যেনো কলেজের সবাইকে এটা বোঝাতেই এসেছিলো যে ‘ডিগ্রি বা নম্বারের পিছুনে ছুটে লাভ নেই, ছুটতেই হলে জ্ঞানের পিছনে ছুটো। কতো নাম্বার পেলাম ভেবে লাভ নেই, কি শিখলাম ভেবে লাভ আছে।’

ক্লাসের সবথেকে বড়ো যন্ত্র ছিলো চাতুর বা সাইলেন্সর। সে প্রায় সব বইকেই বলা চলে একরকম মুখস্ত করে নিয়েছিলো যেখানে রাঞ্চোড় কোনোদিন বইয়ের পুথিগত জ্ঞানের পিছনে ছুটেই নি কিন্তু হ্যাঁ ক্যাম্পাসের কোনো যন্ত্রকেই সে বাদ রাখে নি খুলতে। সে ক্লাসের সবথেকে তাথাকথিত ‘খারাপ ছাত্র’ ফরান এবং রাজুর খুব ভালো বন্ধুছিলো। সে তো শিখিয়েছিলো রাজুকে যে ভয়ে ভয়ে বেঁচে কিছু হবে না। চাকরি পেতে গেলে ভয় কাটাতে হবে, জেতার মনোভাবকে মনের মধ্যে জন্মাতে দিতে হবে। সে ফারানকে শিখিয়েছিলো যে ইঞ্জিনিয়ারিং তার জন্য নয়। সে হয়তো কোনোরকমে ইঞ্জিনিয়র হয়ে গেলেও মন থেকে খুশি থাকবে না। সে তৈরিই হয়েছে ওয়াইল্ড লাইফ ফোটো গ্রাফারের জন্য।

যেহুতু রাঞ্চোড় ফারান এবং রাজুর সাথেই বেশি সময় কাটাতো তাই সবাই বিশেষ করে ভইরাস এবং চাতুর ভেবেই নিয়েছিলো যে সেও পড়াশোনাতে খারাপ কিন্তু আদতে সে ইঞ্জিনিয়ারিংকে ভালোবাসতো আর তাই সে যখন কলেজে ফার্স্ট হয় সবাই প্রায় চমকে গেছলো, আর রাজু এবং ফারান লাস্ট হয়। আর সেই দিনই রাঞ্চোড় ভাইরাসকে কথা দিয়েছিলো যে একদিন রাজু এবং ফারানও ভালো চাকরি পাবেই।
এই ভাবে বেশ কেমেডির আড়ালে এক অন্যরকমের ছবি ফুটে উঠছিলো কিন্তু এখানেই শেষ নয়, ভাইরাস মানে স্বয়ং কলেজের প্রিন্সিপালের ছোটো মেয়ে পিয়ার সাথেই প্রেমের ফাঁদে পড়ে গেলেন আমাদের রাঞ্চোড়।
রাঞ্চোড় পিয়াকে বুঝিয়ে ছিলো যে এমন মানুষের সাথে থাকা পিয়ার পক্ষে দম বন্ধকর হবে যে শুধু টাকার পিছুনে ছুটে।

রাঞ্চোড়কে সব থেকে বেশি খারাপ ভাবতো ভাইরাস। সে ভাবতো রাঞ্চোড়ই রাজু এবং ফারানকে খারাপ করছে। রাঞ্চোড়কে ভাইরাস সাসপেন্ডও করে। রাঞ্চোড় যে সময় কেলেজ ছেড়ে চলে যাচ্ছে ঠিক সেই সময় ভাইরাসের বড়ো মেয়ের লেবার পেন শুরু হয় কিন্তু গোটা শহর তখন বন্যায় ভাসছে। এমন বিপদের কথা রাঞ্চোড় শোনা মাত্রই ছুটে গিয়ে বেচ্চা ডেলিভারি করেন নিজের হাতেই। কিন্তু যখন বাচ্চাটি নড়চড় করছিলো না তখন রাঞ্চোড়ের বলা সেই কথাটা টা ” অল ইজ ওয়েল” শুনেই ব্চ্চাটি স্বাভাবিক হয়। শেষে ভাইরাসও বুঝতে পারে যে রাঞ্চোড়ই তার প্রকৃত সেই ছাত্র যে তার সেই মহামূল্যাবান পেনটি পাওয়ার যোগ্যতা রাখে।
শেষে দেখা যাচ্ছে, চতুর, যে কিনা গোটা ইঞ্জিনায়ারিং জীবনে শুধু নাম্বারের পিছনে ছুটে যায় সে রাঞ্চোড়ের একটা সাইনের জন্য ছুটে ছুটে বেড়াচ্ছে।

রাজু, যে পরীক্ষা আর জীবনের অসুবিধাগুলোকে এতোই ভয় পেতো যে কোনোদিন ভালো নাম্বার তো দূরের কথা সর্বদা লাস্ট হতো, সেও শেষে বড়ো কোম্পানিতে চাকরি করছে।
ফারান, যে বাড়ির চাপে জোর করেই ইঞ্জিনিয়ারিং-এ এসেছিলো সে রাঞ্চোড়ের কথাই ওয়াইল্ড লাইফ ফোটোগ্রাফিতে গিয়ে শেষে অনেক শুনাম করেছে।
মিলিমিটার, যে ক্যাম্পাসে সবার ব্যাগপত্র পৌঁছে দেওয়ার কাজ করতো শেষে দেখা যাচ্ছে রাঞ্চোড় তাকে দ্বিতীয় রাঞ্চোড় বানানোর প্রক্রিয়াতে ব্যস্ত।

আর যাকে ঘিরে এতো সবকিছু মানে রাঞ্চোড়, তার নামই রাঞ্চোড় নয়, আসল রাঞ্চোড় তো বড়োলোক বাড়ির একটা বখাটে ছেলে যে নিজে ইঞ্জিনিয়ারিং না পড়ে শুধুমাত্র ডিগ্রি পাওয়ার জন্য ফুংসুক ওয়াংড়ুকে রাঞ্চোড় সাজিয়ে ইঞ্জিনিয়ারং পড়িয়ে ছিলো। ফুংসুক ওয়াংড়ুর দরকার ছিলো জ্ঞানের আর রাঞ্চোড়ের দরকার ছিলো ডিগ্রি। অবশেষে জ্ঞানের জয় হয় এবং ডিগ্রি আবারও হেরে যায়।
সিনেমাটাতে তো অনেক রসদই রয়েছে কিন্তু একটা জিনিষ না বললেই নয় সেটা হলো বন্ধুত্ব।

Facebook Comments Box
Rohit Paramanik

লিখতে আমি ভালোবািস, সাহিত্যের সাথে প্রেম করি। আপনার মনের অজানা কথা, কলম দিয়ে উজাড় করি। যদি জানতে চান আরো, আমার সৃষ্টিগুলো দেখুন, মনে রাখতে আমার নাম ডাইরির পাতায়, 'রোহিত' বলে লিখে রাখুন।

Recent Posts

Kolkata to Witness B Praak’s Mesmerizing Performance at ‘Kolkata Odyssey’ on October 20th

The vibrant city of Kolkata is set to host an extraordinary musical event as renowned Indian music…

2 weeks ago

Celebrating Friendship and Togetherness with Pujo Pujo Gondho

In a heartwarming ode to friendship and the unifying spirit of Pujo, SVF Brands has…

2 weeks ago

Frustration Turned To Calmness, Thanks To These Websites

The year 2024 has not been what I had planned so far. Everything went downhill.…

1 month ago

SVF Music Unveils April Edition of “Banglar Gaan Indies”

Following the resounding success of the inaugural edition, SVF Musicproudly announces the arrival of the…

6 months ago

Mimi Chakraborty and Nabila to Star Alongside Shakib Khan in ‘Toofan’

Amidst ongoing speculations regarding the leading lady opposite Shakib Khan in the upcoming film 'Toofan',…

7 months ago

Why Does a Rich Chicago Law Firm Keep Suing Indian Tribes?

This article originally appeared in DC Journal: https://dcjournal.com/why-does-a-rich-chicago-law-firm-keep-suing-indian-tribes/ Why does a deep-pockets Chicago law firm keep…

11 months ago