LaughaLaughi

You Create, We Nurture

English Movies

DUNKIRK : Review by অভিলাষ দে

ডানকার্ক:

 

হয়ত প্রথম দেখায় নাও চিনতে পারেন, কিন্তু ভাল করে লক্ষ্য করুন অ্যালেক্সের চরিত্রে আছে ওয়ান ডিরেকশনের হ্যারি স্টাইলস। স্টাইলসকে ছবিতে ভূমিকায় নিয়ে, এখনকার যুবাদের কাছে নোলান এই ছবিটির ইমোশন্যাল আবেদন পৌছে দিতে চান হয়ত। বিশ্বযুদ্ধের দামামা ভুলতে বসেছে পাব-হপিং ব্রিটিশ যুবারা, ভুলতে বসেছে সেই ঘুণধরা দিনগুলো গোনার অভিজ্ঞতা। তাদের টেনে আনতে চান হয়ত ডানকার্কের আকাশে যেখানে থেকে থেকে জার্মান এম-ই ১০৯ ফাইটার শেল ফেলে ফেলে যাচ্ছে।

সমালোচকরা বলছেন যে, নোলানের এখনো পর্যন্ত সবথেকে টানটান, প্রশংসনীয় ছায়াছবি ডানকার্ক। নোলানের গত দুই-তিন দশকের প্রতিটি ছবি, Tarantella/লার্সেনি থেকে শুরু করে ইন্টারস্টেলারের রুদ্ধশ্বাস রোমাঞ্চ, ডানকার্কের আইম্যাক্স পর্দায় এসে পেয়েছে চড়ম সীমা। আমাদের মনে হয়, নোলানের পরিচালনায় তৈরি ছবিগুলির মধ্যে সবথেকে চ্যালেঞ্জিং মোড় হয়ত ডানকার্কেই আছে। প্রথমেই বলতে ইচ্ছে করে হ্যান্স জিম্মারের সংগীতের কথা। ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর ছবিতে চুপই থাকে না। সারাক্ষণ যেন টাইম বমের ঘড়ির কাঁটার মতো চলছে স্কোর। কিছুতেই থেমে থাকেনি জিম্মারের বুমিং ড্রাম, ওর নিপুণ সিন্থ কর্ড আর দক্ষ কয়িং স্ট্রিংস। যেন জিম্মারের উদ্দেশ্য আমাদের মনে সিনেমাটির গমগমে/ছমছমে ইয়ুংগিয়ান এক আর্কিটাইপাল আঁচড় কেটে যাওয়া, যেরকম আঁচড় কেটে গেছে য়ুরোপের তটে তটে, শহরে শহরে বিশ্বযুদ্ধ।

ফ্রান্সের ডানকার্কের তটে আটকা পড়ে আছে প্রায় তিন লক্ষ ব্রিটিশ, ক্যানাডিয়ান, ডাচ ও ফ্রাংকো-বেলজিয়ান সেনা। চারিদিক থেকে ফ্রেঞ্চ অ্যালায়েড ফোর্সকে ঘিরে ধরছে জার্মান ফোর্স। প্রতিদিন, প্রত্যেক ঘণ্টায় ছোট হয়ে আসছে ডানকার্কে আটকা পড়া সেনাদের সুরক্ষার পরিধি। এমতাবস্থায় বার বার পিছনে ফিরে তাকানো আর চার্চিলের অপেক্ষা। কমান্ডার বোল্টন (কেনেথ ব্রানা) নিজের পদ থেকে, নিজের দায়িত্ব থেকে এক মুহূর্তের জন্যও অবসর নেন নি, আর ডানকার্কের বিস্তৃত তটে রয়েছে ১৯ থেকে ২৩ বছর বয়সী সব ব্রিটিশ যুবা।

         এই প্রসঙ্গে বলা উচিৎ যে, নোলানের ছায়াছবিতে মুখ্য নায়ক আর খলনায়কের মধ্যে ব্যবধান ভেঙ্গে যায়। আগেও প্রত্যেকটি ছবিতে নোলান নায়কদের মধ্যে এক মানসিক তথা নৈতিক টানাপড়েন দেখিয়েছেন যা ডানকার্কের তটে এসে ওনার অসামান্য চরিত্রায়নের ঢেউ হয়ে আছড়ে পড়েছে। ফিওন উইটহেডের বয়স মাত্র ১৯, আর তাছাড়াও বড়পর্দায় ফিওনের সবুজ অনভিজ্ঞ সারল্য ছবিতে এনে দিয়েছে সেই বিশ্বযুদ্ধে তাড়া-খেয়ে-পালানো ব্রিটিশ যুবাদের সারল্য আর আনকোরা বিস্ময়। বিশৃঙ্খলা তো আছেই যুদ্ধের, আছে এক্সপ্রসিভ লাইটিংও, যা নোলানের ফটোগ্রাফির স্বাক্ষর। যখন গিবসনের (অ্যানিরিন বার্নার্ড) যুবা চরিত্রটি প্রতিষ্ঠিত হয় জার্মান হিসেবে, তখন বোঝা যায় নোলান কেমন চরিত্রায়নে “পরিচয়” ভেঙ্গে দেওয়ার চেষ্টায় সমর্থ, কেমন চরিত্রগুলির “নৈতিক মাপকাঠি” ভেঙ্গে দিতে সমর্থ।          

লক্ষণীয় যে, নোলানের এই ছবিতে মহিলা ভূমিকায় শুধুমাত্র দুটি মুখ দেখা গেছে—এক নার্স আরেক মহিলা সিভিলিয়ান প্লেজার ইয়াটের ডেক থেকে কমান্ডার বল্টনকে বলছেন যে, ওনারা ডার্টমুথ থেকে তড়িঘড়ি এসেছেন চার্চিলের ডাকে সাড়া দিয়ে ব্রিটিশ সেনাকে ডানকার্ক থেকে ফিরিয়ে আনতে ইংলিশ চ্যানেলের অন্য প্রান্তে। মহিলাদের ভূমিকা শুধুমাত্র হিতৈষী হিসেবে। নায়কের ভূমিকায় যারা আছেন প্রায় অনেককেই চিত্রনাট্যে নাম দেন নি নোলান। কিলিয়ান মার্ফির চরিত্রটি শুধু এক শেল-শকড য়ু-বোটের সারভাইভর। উদ্বর্তী এই চরিত্রের মধ্যে দিয়ে নোলান ফুটিয়ে তুলেছেন ট্রমা আর অবিন্যস্ত মানসিক শোক। অবিন্যস্ত এই ছন্নছাড়া ডানকার্কের তটেই শৃঙ্খলা আনতে উঠে পড়ে লেগেছে নোলানের দৃষ্টিলব্ধ  চিত্রনাট্য।          

এই ছবিটি যদিও মাত্র এক ঘন্টা সাতচল্লিশ মিনিট ব্যাপী। নোলান সচরাচর দুই থেকে চার ঘন্টাব্যাপী সিনেমা বানিয়ে এসেছেন। তাতে পরিচালক ও চিত্রনাট্যকার হিসেবে নায়ক-নায়িকার নৈতিক টানাপড়েনের সাথে দর্শকদের আন্তরিক সম্পর্ক স্থাপন করার একটা প্রাঙ্গণ তৈরি হয়ে ওঠে ছবির শেষে। ডানকার্কের চমক যদিও অন্য দুটি জায়গায়। 

প্রথম হল, ছায়াঙ্কনে ও্যালি ফিস্টারকে ছেড়ে হোয়েট ভ্যান হোয়েটেমাকে ইন্টারস্টেলারের পর আরো একবার নিপুণভাবে ব্যবহার করা। ফটোগ্রাফিতে বার বার ইন্টারস্টেলারের সেই বাড়ি ফেরার ইচ্ছে, মনকেমনকরা একাকীত্ব, আবেশ, রাগ আর মানব অবস্থার অনুশোচনা ফুটে উঠেছে। ভ্যান হোয়েটেমা সিনেমার টানটান থ্রিল ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন হ্যান্ডহেল্ড ক্যামেরায়। গুলি থেকে মুখ ফিরিয়ে পালানোর সময় আমরা তাকাব না কোথা থেকে গুলি আসছে, সেই দিকে। চারিদিকে কানের পর্দাফাটানো বিস্ফোরণ হলে আমরা শুধু মাথা গুঁজে আত্মরক্ষার চেষ্টা করব। ভ্যান হোয়েটেমাও লং শট বেশি ব্যাবহার না করে, ক্লোজ আপ আর মিডিয়াম ক্লোজ আপের স্বরগ্রামে সিনেমাটিতে পারিপার্শ্বিক ছবি না দেখিয়ে, আমাদেরকে এই যুবা সৈনিকদের অস্তিস্ববাদী “অ্যাংগস্ট” দেখতে, সহ্য করতে, আরেকবার অনুভব করতে বাধ্য করেছেন। 

টেরেস্ট্রিয়্যাল সেনাদের গল্পে আমরা ক্লস্ট্রোফোবিয়ার শিকার হয়েছি বার বার। এমন ভাবে শটগুলি বাছা যাতে দেখে আপনারও দম বন্ধ হয়ে আসে । পর্দায় শট এমনভাবে সেনাদের মাথা দিয়ে ঘেরা, যেন আপনি শটটি থেকে মুক্তই হতে পারবেন না। অথচ সিনেমাটি মুক্তি নিয়ে, সেনেমাটি “মুক্তির জয়” নিয়ে, চার্চিলের ভাষণে। “ক্যামেরা হাইট” এমন ভাবে অভিনেতাদের উচ্চাতার আর দৃষ্টির সাথে তালমিলিয়ে ওঠানামা করছে যে, সেনারা যখন জলের তলায়, পর্দায় সমুদ্রের জল যেন আমাদের চোখ ঢেকে দিচ্ছে। সেই ডোবার অভিজ্ঞতা চাক্ষুষ করানোর নিরন্তর চেষ্টা করে যাচ্ছেন ভ্যান হোয়েটেমা।  

আরেক চমকপ্রদ বৈশিষ্ট্য সিনেমাটির “তিনটে ভিন্ন ন্যারেটিভ” ও “তিনটি ভিন্ন টাইমলাইনের সংমিশ্রণ”, যা আগে এভাবে বড়পর্দায় খুব কম দেখানো হয়েছে। ইন্টারস্টেলারে ছিল ঠিকই সময়কে নিয়ে পরীক্ষা কিন্তু ডানকার্কের মতো দক্ষতার সাথে না। এক, ফিওন হোয়াইটহেড ও হ্যারি স্টাইলসের পদাতিক বাহিনী এক মাস ব্যাপী এক “ধির গতির টাইমলাইনের প্লটে” সিনেমাতে এগোচ্ছেন। দুই, কেনেথ ব্রানার নেভি তথা মিস্টার ডসনের (মার্ক রাইল্যান্সের) সিভিলিয়ান রেসকিউ প্রমোদতরণী “জলগামী আরেক প্লটের টাইমলাইন” যেখানে পাদাতিক বাহিনীর থেকে বেশ তাড়াতাড়ি গতি এগোয়, যা জলপথে জাহাজ বা তরণীর গতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে লেখা। তিন, টম হার্ডির চরিত্র (ফারিয়ার) রোলস রয়েস ফাইটার প্লেনের পাইলট হিসেবে আকাশপথে আরেকটি প্লটের টাইমলাইনে সিনেমা এগোচ্ছেন। ফাইটার বিমানের গতির সাথে তাল মিলিয়ে এই প্লটটির গতিও অনেক বেশী। বিমানপথের প্লটটি খুব বেশী হলে, দুপুর ৩টে থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত মাত্র। তাঁর বেশী নয়।         

অসামান্য এক সিনেম্যাটিক চিত্রনাট্যে নোলান জল-স্থল আর বিমানপথের তিনটি প্লটকে ছবির শেষেরদিকে এক বিশেষ মুহূর্তে এক করেছেন, আবার প্লটটি ছড়িয়ে দিয়েছেন। জল, স্থল আর বিমানপথের গতিবেগের উপর নির্ভরশীল এই “সময়-বক্রিকরণ প্লট” নোলানের দর্শকরা আশাও করেননি। ছবিটির সময়রেখা না বোধগম্য হলে, কেন এই ছবিটি নোলানের শ্রেষ্ঠ জয় তা বোঝা সহজ নয়।         

ফাইটার বিমানের ককপিট থেকে টম হার্ডির ফারিয়ারের চোখে দেখা কিছু “বার্ডস আই ভিউ” স্মৃতিতে দাগ কাটার মতো শট। বার বার নোলান সেনাদের “পয়েন্ট অফ ভিউ” দেখানোর চেষ্টা করেছেন, যার জন্য ছবিটি “ক্লস্ট্রোফোবিয়া” ও চাপা উত্তেজনায় জর্জরিত। পর্দায় দর্শকদের বার বার “চোখ আড়াল করে শটগুলি” আমাদেরকেও মুক্তি পাওয়ার জন্য ছটফট করায়। কোনো চরিত্রকেই নোলান বিশেষ গুরুত্ব দেন নি ছবিতে, দেন নি চরিত্রগুলির বেড়ে ওঠার সুযোগ, দেন নি চরিত্রগুলির জন্ম বৃত্বান্ত। শুধু আমাদের চোখের সামনে তিনটি সময়রেখায় একবার মিলিত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে সিনেমাটির অনবদ্য ভিজুয়্যাল প্লট। কালোত্তীর্ণ সিনেমা স্পিলবার্গের সেভিং প্রাইভেট রায়ান, কিন্তু ডানকার্ক শুধু যুবা কয়েকটি সেনার ছোটো ছোটো সাময়িক ইতিহাস, একেক টুকরো বাঁচার লড়াইয়ের গল্প। এখানে যুদ্ধ নেই, আছে শুধু যুদ্ধ বিমানের ভয়াবহ শব্দ। এখানে নেই রক্তারক্তি, কিন্তু আছে মার্ক রাইল্যান্সের চরিত্রের ডানকার্কে ভেসে আসার জয়গাঁথা। এখানে নেই ভয়াবহ মৃত্যুযন্ত্রণা, কিন্তু আছে বার বার বেঁচে ফেরার ছোটো ছোটো ইতিহাস। মে ২৬ থেকে জুন ৮, ১৯৪০এর “অপারেশন ডায়নামোর” কথা মাথায় রেখেছেন নোলান। জার্মান শক্তি তখন তুঙ্গে। ৬৮ হাজার সেনার শোচনীয় মৃত্যুর স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছে ডানকার্কের অপারেশন ডায়নামো। নিজের ছবিকে নোলান লেস্লি নরম্যানের ১৯৫৮র সিনেমা আর বিবিসির ২০০৪এর অ্যালেক্স হোমসের ডানকার্ক থেকে সযত্নে সরিয়ে এনে নোলান তুলে ধরেছেন মর্মভেদী ইতিহাসের এক অসামান্য formalist time-bending ক্লাসিক। 

Facebook Comments Box

LEAVE A RESPONSE

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Editorial Team of LaughaLaughi