খিচুড়ির ইতিহাস আর ইতিহাসের খিচুড়ি

খাদ্যরসিক বাঙালীর বর্ষাকাল মানেই খিচুড়ির কাল। খিচুড়ির ইতিহাস ঘাঁটাঘাঁটি করতে গেলে দেখা যাবে, এ নিয়ে বাঙালির যত আবেগ থাকুক না কেন, এ খাবারের উৎস বাংলা নয়। এর প্রবেশ বাংলায় খানিকটা পরে। এর আভিধানিক অর্থ “বৈসাদৃশ্যময় উপকরণে তৈরি মিশ্র খাদ্য” ।
এবার একটু ইতিহাসটা অল্প করে জানি চলুন;
গ্রিকদূত সেলুকাস উল্লেখ করেছেন তখন ভারতীয় উপমহাদেশে চালের সঙ্গে ডাল মেশানো খাবার খুবই জনপ্রিয় ছিল। আল বেরুনিও তাঁর ভারততত্ত্বে খিচুড়ির প্রসঙ্গ বাদ দেননি। মরক্কোর বিখ্যাত পর্যটক ইবন বতুতা খিচুড়ি প্রস্তুতি চাল, ডাল নয় নির্দিষ্ট করে মুগডালের কথাও বলেছেন। চাণক্যের লেখা মৌর্যসম্রাট চন্দ্রগুপ্তের সময়কালে এর উল্লেখ মেলে। সপ্তদশ শতকে ভারত ভ্রমণকালে ফরাসী পরিব্রাজক তাভের নিয়ের লিখেছেন, সে সময় ভারতে প্রায় সব বাড়িতেই খিচুড়ি খাওয়ার রেওয়াজ ছিল।


মোঘল আমলের ইতিহাস বলে আকবরের মন্ত্রী আবুল ফজল তাঁর আইন-ই-আকবরী তে নানা ধরনের খিচুড়ি তৈরির কথা বলেছেন। খিচুড়ির প্রতি ভালোবাসা ছিল জাহাঙ্গীরেরও। তাতে মিশত পেস্তা ও কিসমিস, ভালোবেসে নাম রেখেছিলেন “লাজিজাঁ”।
বিদেশেও উনিশ শতকের ভিক্টোরিয়ান যুগে (১৮৩৭-১৯০১) খিচুড়ি ইংল্যান্ডের হেঁসেলে ঢুকে পড়েছিল। মোটামুটি উনিশ শতকের মাঝামাঝি মিশরীয়দের মধ্যে “কুশারি” নামে একটি পদ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এটি তৈরি হতো চাল, ডাল, চানা, ভিনিগার, টমেটো সস, পেঁয়াজ, আদা, রসুন প্রভৃতি উপকরণ দিয়ে। রন্ধনপ্রণালী হিসেবে এই কুশারীকেই খিচুড়ির ভিন্নরূপ বলা যেতে পারে।


বাংলায় প্রবেশ তবে কবে?
১২০০-১৮০০ সালের মধ্যবর্তী কোনো এক সময়ে বাংলায় খিচুড়ির আবির্ভাব। হালে ডালে গরিবের আমিষ বলা হলেও প্রথমদিকে ডাল ছিল উচ্চশ্রেণীর খাদ্য। “খিচুড়ির চার ইয়ার – ঘি পাঁপড় দহি আচার” কথাটি চালু থাকলেও বাঙালি মানেই খিচুড়ি পাঁপড়। তবে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে রন্ধনপটীয়সীরা বলেছেন “দই দিয়ে খিচুড়ি খাইতে মন্দ লাগে না। মনসামঙ্গল কাব্যে স্বয়ং শিব যে খাবারটি খাবার আবদার পার্বতীর কাছে জানিয়েছিলেন, তা হল খিচুড়ি।

চলুন এবার কয়েকটা অন্যান্য বিষয়ে খিচুড়ির ইতিহাস বৃত্তান্ত জেনে আজকের পর্বে ইতি টানা যাক। পুরীর জগন্নাথদেবের মন্দিরে প্রসাদ হিসেবে ভক্তদের যে খিচুড়ি বিতরণ করা হয়, তা লোকমুখে সংক্ষেপে “জগা- খিচুড়ি” নামে পরিচিত। যা কথ্যভাষায় আবার তালগোল পাকানোর প্রতিশব্দ। কাশ্মীরি পণ্ডিতেরা যক্ষদেবতা কুবেরকে খিচুড়ি ভোগ উৎসর্গ করেন, যার নাম “খেতসিমাভাস”। তামিলনাড়ুতে খিচুড়িকে “পোঙ্গল” বলে। রাজস্থানে যে হাল্কা খিচুড়ি রান্না হয় , তাকে “তেহরি” বলে , যা পুষ্টিকর। মহারাষ্ট্রে খিচুড়ির সাথে মেশানো হয় সরষে দানা। মহামুনি চরক বলেছেন খিচুড়ি, পোলাও এর থেকে কিছু কম গুণাগুণ যুক্ত নয়। তাই আজও খিচুড়ির একটা আলাদাভাবে “নান- ক্যান- বিট” ব্যাপার আছে বইকি!! আর জিহ্বের জলের দুর্বলতার জন্য অনায়াসে দায়ী করা যায় খিচুড়িকে।

Facebook Comments Box
Staff Writer

Editorial Team of LaughaLaughi

Recent Posts

Why Does a Rich Chicago Law Firm Keep Suing Indian Tribes?

This article originally appeared in DC Journal: https://dcjournal.com/why-does-a-rich-chicago-law-firm-keep-suing-indian-tribes/ Why does a deep-pockets Chicago law firm keep…

3 weeks ago

Anupam Roy’s ‘Aami Sei Manushta Aar Nei’ is a Musical Masterpiece

In a spectacular celebration coinciding with the birthday of the iconic actor Prosenjit Chatterjee, the…

2 months ago

অনুষ্কা পাত্রর কণ্ঠে শোনা যাবে দে দে পাল তুলে দে

হিমেশ রেশামিয়ার পর সুরাশা মেলোডিজ থেকে অনুষ্কা পাত্রর নতুন গান পুজো আসছে মানেই বাঙালির নতুন…

2 months ago

Srijit Mukherji’s Dawshom Awbotaar is On a Roller Coaster!

The highly awaited trailer of grand Puja release, "Dawshom Awbotaar", produced by Jio Studios and…

2 months ago

আসছে Klikk Originals NH6 ওয়েব সিরিজ

আসছে Klikk Originals এর আগামী ওয়েব সিরিজ। জন হালদার এর প্রযোজিত ও পরিচালিত রোমহর্ষক থ্রিলারNH6…

2 months ago

Jeet Unveils the First Look of Manush

On the auspicious occasion of Ganesh Chaturthi, Bengal's Superstar Jeet Unveils the First Look of…

2 months ago

This website uses cookies.