LaughaLaughi

You Create, We Nurture

Horror

ভুতুড়ে বাংলো

চা বাগানের বাংলো বলতেই আমাদের গা টা কেমন যেন ছমছম করে উঠে। সালটা ১৯৩৫ হবে। ভারতের সমস্ত চা বাগান তখন ইংরেজদের দেখলে। এমন একটা চা বাগান ছিল, গয়া- গঙ্গা টি-এস্টেট।অসম্ভব নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরা একটি চা বাগান।

সেই সময় ঐসব চা বাগান গুলিতে শ্রমিক হিসেবে স্থানীয় লোকজনের নেওয়া হলেও, উচ্চপদস্থ পদগুলিতে সাহেবদেরই নিযুক্ত করা হতো। আর সাহেবদের থাকা,খাওয়া ও জীবনযাত্রার মান রক্ষা করার জন্য টি-এস্টেট গুলি তৈরি করে দিতো রাজপ্রাসাদের মতো বড় বড় বাংলো। এই সালেরই ঠিক পুজোর সময় গয়া-গঙ্গা চা বাগানে নতুন ম্যানেজার হিসেবে নিযুক্ত হলেন মিস্টার হাটেন নিম্বার্ক। তার সাথেই থাকতে এলেন তার স্ত্রী এমিলি এম্বার্ক।রঙিন স্বভাবের হাতের সাহেব চা বাগানের এলাহি বাংলো ও বিস্তর সুযোগ-সুবিধা পেয়ে বেশ খুশি।

পুজোর পর শীতকালে চা-বাগানে বেশি কাজের চাপ থাকে না। পাতা তোলার কাজেও এই সময় থাকে বন্ধ। অফুরন্ত সময়ে মিস্টার এন্ড মিসেস এম্বার্ক বেরিয়ে পড়তেন আশপাশটা ঘুরতে। শীতকালীন অবকাশ তারা ডেকে নিলেন তাদের একমাত্র মেয়ে এমা এম্বারকে। তিনজন প্রায়ই রাতের বেলায় ফায়ার প্লেসের সামনে বসে আড্ডা দিতেন, সাথে থাকতো রঙিন পানিয়। এমনই এক সন্ধ্যায় চা বাগানের ডাক্তার মিস্টার ফারনেল এলেন দেখা করতে। ম্যানেজার মিস্টার এম্বার্ক তাকে ডেকে নিলেন ড্রইংরুমে। বেশ জমে উঠলো আড্ডা।কথায় কথায় মিস্টার ফারনেল জানালেন, শ্রমিক বস্তিতে এক অজানা জ্বর ছড়াচ্ছে।কাল এক শ্রমিকের দশ বছরের মেয়ে মারাও গেছে। কিন্তু মিস্টার এম্বাক তার কথায় বেশি গুরুত্ব দিলেন না। বরং ডাক্তার ফারনেলকে এসব ব্যাপারে বেশি মাথা ঘামাতে বারণ করে দিলেন। সাথে আরো যোগ করলেন, কোম্পানির কিছু যায় আসে না ক’জন বেঁচে আছে আর কজন মরেছে তাতে। ওরা খেয়ে পরে বাঁচতে পারছে, এটাই অনেক।

এদিকে মৃত্যুর সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করলো। কিন্তু স্বৈরাচারী বড় সাহেব মিস্টার এম্বাক তার অত্যাচারের মাত্রা একধাপ বাড়িয়ে দিলেন।যদি কোন শ্রমিক অসুস্থ হয়ে কাজে আসতে না পারতো,তাহলে তাদের মাইনে ও রেশন বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ জারি করলেন। সম্ভবতই ক্ষোভ দানা বাঁধতে শুরু করলো শ্রমিক বস্তিগুলোতে।

সেদিন তারিখটা ছিলো 31 শে ডিসেম্বর। বড় সাহেবের বাংলো তখন পার্টির মেজাজে। সূরা ডায়না নদীর জলের মতো ভাসছে কল কল শব্দে।সঙ্গে দোসর হয়েছে বিদেশি সংগীত ও নানা রকমের বাহারি খাবার-দাবার।হঠাৎ মিস্টার এম্বার্ক বাংলোর বাইরে থেকে হই- হট্টগোল শুনতে পেয়ে বাইরে বেরিয়ে এসে দেখেন প্রায় পাঁচশ শ্রমিক জমা হয়েছে সেখানে। তাদের অভিযোগ অজানা জ্বরে এত লোক মারা যাচ্ছে, কিন্তু কোম্পানি সে বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না। মিস্টার এম্বার্ক অভিযোগ শুনে বেচায় ক্ষেপে গেলেন। তার ওপর তিনি পার্টিতে দুই এক পেক বেশি গিলে নিয়েছিলেন সেদিন। মাথা গরম করে শ্রমিকদের যা-নয়-তাই বলে ভৎসনা করতে শুরু করলেন। ডাক্তার ফার্নেল এসেছিলেন থামানোর চেষ্টা করতে। কিন্তু কোন লাভ হয়নি। অবশেষে শ্রমিকরা উত্তেজিত হয়ে তাদের হাতের মশাল গুলো সব ছুঁড়ে মারতে শুরু করলো বাংলোর দিকে।নিমেষেই কাঠের তৈরি সুসজ্জিত বাংলায় দাউদাউ করে আগুন ধরে গেল। ডাক্তার ফানেল ও আরো কয়েকজন সহকর্মী বেরিয়ে আসার সুযোগ পেলেও বড় সাহেব মিস্টার এম্বার্ক ও তার পরিবার ওই আগুনে পুড়ে মারা গেলেন।

ঘটনার ঠিক তিন মাস পর গয়া-গঙ্গা টি-এস্টেটে নতুন ম্যানেজার নিযুক্ত করা হলো। তাকেও থাকতে দেওয়া হলো সদ্য পুনর্নির্মিত এলাহী বাংলোতে। মিস্টার রাইট শান্তশিষ্ট, নিরীহ কিন্তু নির্ভীক স্বভাবের মানুষ। তিনি নিয়মিত শ্রমিকদের বস্তিতে গিয়ে সমস্ত শ্রমিক সমস্যা নিরসন ঘটালেন। চা বাগান আবার ফিরল তার চেনা ছন্দে।এভাবেই ভালই কাটছিল। কিন্তু নভেম্বর মাস পার হতে না হতেই বাংলোতে নানা রকমের আজগুবি কান্ড হতে শুরু করল।রাতের ড্রইংরুমের ফায়ারপ্লেসের সামনে থেকে হঠাৎই গান বাজতে শুরু করত। সিঁড়িতে শোনা যেত ধব্ ধব্ শব্দের আওয়াজ। এসব দেখে বাংলোর কুক বাড়ি যাওয়ার নাম করে, যে গ্রামে গেল আর ফিরল না কোনদিনও।

এসবের মধ্যেই এসে পড়ল বছরের শেষ দিনটি। মিস্টার রাইট সাহেব বিশাল পার্টির আয়োজন করলেন বাংলোয়। ডাকলেন তার সহকর্মীদের। সবাই আসতে প্রথমে ইতস্তত বোধ করলেও বড় সাহেবের আজ্ঞা কেউ ফেলতে পারলেন না। বিকেল থেকেই পার্টি জমে উঠলো। গান-বাজনা -মদ- মাংসতে পরিপাটি। ঠিক সাড়ে এগারোটা নাগাদ হঠাৎই ওপরে ঘর থেকে চিৎকার-চেঁচামেচি আওয়াজ শোনা গেল তদারকি করতে মিস্টার রাইট এবং তার কিছু সহকর্মী যখনই ওপরের ঘরে পৌঁছালেন, তখনই শব্দগুলো নিচের ঘর থেকে আসতে শুরু করলো। সাথে যুক্ত হলো তীব্র কান্নার শব্দ ।এক নিমিষেই পার্টির সব আমেজ গেল ভন্ডুল হয়ে। সহকর্মীরা একে একে বাংলো ছেড়ে চলে যেতে শুরু করল। কিন্তু একটু ডাকাবুকো প্রকৃতির মিস্টার রাইট অত সহজে ভয় পাওয়ার পাত্রটি নন। তিনি তার কর্মচারীদের রাতের খাবার পরিবেশন করার অনুমতি দিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসতেই বাংলোর সব আলো গেল নিভে।

মোম জ্বালিয়ে মিস্টার রাইট অপেক্ষা করতে থাকলেন রাতের খাবার পরিবেশন করার। হঠাৎই তিনি দেখতে পেলেন তার চোখের সামনে কতগুলো ছায়ামানুষ হেঁটে চলে যাচ্ছে সিঁড়ির দিকে। তাদের পরনে ইংরেজি জামাকাপড়। রাইট সাহেব মোমবাতি নিয়ে তাদের পিছু নিলেন। সিঁড়ির সামনে পৌঁছাতেই রাইট সাহেব দেখলেন, তিনটে জলন্ত দেহ হাত বাড়িয়ে তার দিকে ধেয়ে আসছে। তিনি ওখানেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন।পরদিন তার জ্ঞান ফিরল চা-বাগানে হাসপাতালে। কিন্তু জ্ঞান ফিরে এলেও তিনি হারিয়ে ফেললেন তাঁর কথা বলার শক্তি। তার ব্যবহারেরও অসংলগ্নতা দেখে কম্পানি তাকে দেশে ফেরত পাঠিয়ে দিলেন।

তারপর থেকে ওই অভিশপ্ত বাংলোতে যতবার যত সাহেব এসেছেন তাদের একই দশা হয়েছিল।বাধ্য হয়েই কোম্পানি ওটাকে অভিশপ্ত ঘোষণা করে, ম্যানেজারদের জন্য নতুন বাংলা তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেয়। আজও সেই অভিশাপ ও কলঙ্ক নিয়ে খাঁড়া দাঁড়িয়ে আছে বড়বাবুর বাংলো।

মৌমিতা ভাওয়াল দাস।

Facebook Comments Box

LEAVE A RESPONSE

Your email address will not be published. Required fields are marked *