LaughaLaughi

You Create, We Nurture

Emotional

বেমানান

সন্ধে নামতে তখনও দেরি ছিল। এমনিতে গাঁয়ের উত্তরপ্রান্তে নাকি শীতটা একটু বেশিই পড়ে। একে তো সন্ধে হলে এদিকে আলো-টালোর নামগন্ধ থাকে না। অন্যদিকে এক পশলা বৃষ্টি নেমে সমস্যাটা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

এ জায়গায় মেঘ করলেই রাস্তায় জল জমে। বাক্যটা এখানকার জলহাওয়ার সাথে খাপে খাপে মিলে যায়। অন্তত লোকে তাই বলে। যত সাবধানেই পা টিপে টিপে চলো, থকথকে কাদার সাথে অন্তত কয়েক মুহূর্তের সখ্যতা তোমাকে স্থাপন করতেই হবে। আর হড়কে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়লে এলাহি ব্যাপার। নেহাত বেরোনোর প্রয়োজন পড়লে তিনভাগের এক ভাগ মোমবাতিই একমাত্র ভরসা। লোকজন বড়োই গরিব। অধিকাংশই চাষাভুষো লোক। আড়াই হাত চওড়া ঘরে ঘাড়ের ওপর গাদাগাদি করে ঘুমোয় ওরা। মেপে মেপে ডোলের চাল খরচ করতে হয় তাদের। কেরোসিন তো কোন ছার! বিদ্যুতের নাম শুনলেই মানুষ কপালে হাত ঠেকায়।

ডেকচিতে ফুটন্ত চায়ের ধোঁয়া কুন্ডলী পাকাতে পাকাতে বাইরে কুয়াশায় মিশতে চেষ্টা করছিল। ভাঙা বেঞ্চির ভিজে ধারটা বাঁচিয়ে কোনোমতে সিঁটিয়ে বসেছিল আনু। ঘুন ধরা কাঠ বলে সামান্য নড়লেই মচমচ করছে।

কনকনে ঠান্ডায় সোঁদা সোঁদা ভাবটা খানিকটা অস্বাভাবিক। রাস্তার পাশে অগুন্তি ঝোপঝাড়, কিসের যেন সব আওয়াজ হচ্ছে। কুপির কম্পমান শিখাটা নিজেকে নিজেই উপহাস করতে ব্যস্ত। মিটারদশেক পিছোলেই কাঁচা নর্দমা। সেখানকার রকমারি পোকামাকড়ের সম্মিলিত বাহিনী কোরাস তুলে প্রতি মুহূর্তে ধেয়ে আসছে গোলার মতন।

রমাকান্তর চা বিড়ির দোকান লোকালয় থেকে বেশ কিছুটা দূরেই। অবশ্য দোকান নামমাত্রেই। জরাজীর্ণ টিনের চাল বেয়ে টপটপ করে কালচে জল পড়েই চলেছে। জলের ছাটে রমাকান্ত-র আদি অকৃত্রিম গেঞ্জিটা ভিজে জ্যাবজ্যাবে ন্যাতা!

এসব সামান্য দুদিনের সর্দিকাশির ওকে কাবু করার মুরোদ নেই। পাতলা গোছের চুলগুলো অকালে পেকে গিয়েছে। খড়ি ফোটা চামড়ায় কালো ছোপ। অভিজ্ঞতার তুলনায় অভাবই হয়তো বেশি দায়ী এর জন্য। রমা কাজভোলা মানুষ, অতদিকে খেয়াল রাখার সময় বা ইচ্ছে কোনোটাই তার ধাতে নেই। সামনের বড়ো রাস্তা দিয়ে হাতে গোনা যে কটা বাস যায়, তাদের ওপর নির্ভর করেই মূলত রমাকান্তর পেট চলে। রাত বাড়লে এখানেই চাদর মুড়িয়ে শুয়ে পড়ে।

“কি গো রমাদা, চা হল?”

“এই যে নাও।” অভ্যস্ত অথচ কাঁপা হাতে ছাঁকনিতে ছেঁকে সযত্নে ভাঁড়ে চা ঢালে রমাকান্ত। কবজি দুখানা শুকনো প্যাকাটির মতো সরু হতে পারে, দেহে ক্যালশিয়ামের অভাবটা প্রকট হতে পারে, কিন্তু এই নিয়েই সে জীবন কাটাচ্ছে অনায়াসে। এতে ওর অনীহা নেই।

বয়াম খুলে দুটো বিস্কুট এগিয়ে দেয় সে। এক ঝলক দেখেই বোঝা যায় সেগুলো কবে ঝামরে মিইয়ে গেছে। ঝুরঝুর করে গুঁড়ো খসছে। পোকারাও বোধহয় ছুঁয়ে দেখবে না।

তবুও খিদের চোটে গোগ্রাসে সেই অখাদ্য বিস্কুট চিবোতে থাকে আনু। গ্রামে আর মন টেকে না একদম। বেলতলায় মাটির ঘরটা ব্যতীত সাতকূলে কেউ নেই ওর। ন্যাড়ার সেই বেলতলা নয়। মাথায় বেল পড়ুক আর যাই পড়ুক, দিনের শেষে তো সেখানেই তাকে বারবার ফিরতে হয়। ও জানে, মেঝেতে চিত হয়ে ঘুমোলে দেহের অবশিষ্ট গ্লানিগুলো চুপিসারে সরে যায়।

পথেঘাটে ঘুরতে ঘুরতে ছেলেবেলা থেকে কখন যেন কৈশোরে উপনীত হয়েছে নিজের অজান্তেই। কে-ই বা ওর দায়িত্ব নেবে। সেটুকুও সাধ্যি নেই কারো।

পেটে তেমন বিদ্যে বলতেও কিছুই নেই যে আনু কাজ করে খাবে। যদিও এসব নিয়ে সে ভীষণ উদাসীন। উপোস তার হরবখতের প্রিয় সঙ্গী। আদ্দেক দিন স্নানও করে না। আনু আশাবাদী, উকুনরা বাসা বাধলে অন্তত যদি দুটো নতুন বন্ধু মেলে। কেউই আনুর কাছের নয়। তাকে দেখলেই যেন আপনা হতেই সবাই নাক সিঁটকোয়। অনাথ, পাগল এসব বলে। তা বলুক গে। এর বাইরে পরিচিতি চাই না ওর। বাইরেটা নোংরা হলেই বুঝি মানুষ অসুস্থ হয়!

একমাত্র রমাদাই একটু আলাদা। ছেলেবেলায় রোজ দুপুরে ওকে একটা করে পাঁউরুটি দিয়ে যেত লুকিয়ে লুকিয়ে। আনুর দাঁতের ফাঁকে হাসি খিলখিলিয়ে উঠত। এর সামনে রমাকান্তর সমস্ত তথাকথিত সুখ ক্রমে তুচ্ছ হয়ে যেত।

 

“তুই এবার কাজকম্মের চেষ্টা কর বাবা। এভাবে সারা জীবন কাটিয়ে দিবি নাকি? তুই তো আমার মতো বুড়িয়ে যাসনি বল।” রমাকান্ত বলল। ছেলেটার প্রতি বড্ড মায়ায় জড়িয়েছে সে।

ছেঁড়া আস্তিনে মুখটা মুছে আনু বলে, “আছি তো একরকম। তাছাড়া আমার খুব ইচ্ছে করে জানো, পুরো দুনিয়াটা ঘুরে দেখব। কুয়োর ব্যাঙ হয়ে কদ্দিন থাকব বলতে পারো? একদিন এখান থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে ঠিক চলে যাব।”

“কি যে বকিস তার মাথামুন্ডু নাই। শোন, তোর বাবা একসময় মুড়ির ব্যবসা চালাত। শহরেও যেত কখনও কখনও। সেটাও তো করতে পারিস। তুই কি আটাশে ছেলে যে ঘরে বসে থাকবি?”

“আমি…আমি…তুমিও কিস্যু বোঝো না রমাদা? কিস্যু জানো না…” আনুর কথা আটকে আসে। তারপর আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায়। এগিয়ে যায় নিকষ অন্ধকারের পানে।

রমাকান্ত না বুঝেশুনেই ওর দুর্বলতার জায়গায় আঘাত করে বসেছে। ইস! বেচারা কেন যে ছেলে হয়ে জন্মাল। আহা রে, একটু কাঁদতেও পারে না!

আনুর ঘর কয়েক মিনিটের হাঁটাপথ, কিন্তু গোটা পথটা মারাত্মক সব সুগন্ধে ভরপুর। মশাদের পরিজনদের জমজমাট বাসা। নালায় স্তরে স্তরে পাঁক। পরিষ্কার করতে যেচে কেউ নামতে চায় নাকি! এ রহস্য উদ্ধারের চাইতে খড়ের গাদায় ছুঁচ খোঁজার ধাঁধাটা বরং খেলাই যায়। গাঁয়ের লোকে সহজে এদিক মাড়ায় না। অথচ রাস্তা পেরিয়ে এককালে মোড়লের মোটর পর্যন্ত চলেছে বুক চিতিয়ে। শর্টকার্ট হিসেবে এর নামডাকও ছিল প্রচুর। অদুরেই ঝিমোচ্ছে মজা পুকুরটা। সেখানে নাকি একদা পাড়ে রাতদিন বসে থাকত ছেলে ছোকরারা। দিনের যে সময়েই যাও, কাউকে না কাউকে ছিপের বঁড়শিতে চারা গাঁথতে দেখা যাবে।

সেসবের মাহাত্য এখন চুলোয় গেছে। কবেকার মড়কের ফল আজকে গোঁজামিলের ছবিতে এসে দাঁড়িয়েছে।

বৃষ্টিতে পচা গন্ধের মাত্রাটা আজ যেন অতিরিক্ত রকমের অসহ্য। উপরন্তু চলনপথে গাছের ডালপালা ভেঙে পড়ে রয়েছে। খুব সাবধানে কাদা বাঁচিয়ে চলছিল সে। পায়ের চাপে ছড়ানো ছেটানো জঞ্জাল চটকে যাচ্ছে। নিয়মিত এখানে যাতায়াত করলেও গা গুলোনোটা অভ্যেসে পরিণত করা সম্ভব নয়।

আনুর তবু কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। নিজের ওপরেই ইদানীং বিতৃষ্ণা এসে গেছে, তো আশপাশ কোন ছাড়। আচ্ছা, শহরে পালিয়ে গেলে কেমন হয়? ওখানে সবই ওর অচেনা। আর গাঁয়ের সবাই চিনেও অচেনা। তাহলে তফাত রইল কোথায়।

ওর কবেকার সাধ। ও অবশ্য বাসে চাপেনি কোনোদিন। ওর কাছে পয়সাই বা কই যে যাবে! এই রমাদাই গেল বছরে কয়েকটা টাকা জোর করে ভরে দিতে চেয়েছিল হাতের মুঠোয়।

আনু বহু কষ্টে হাত ছাড়িয়ে দূরে সরে গেসল। নেয়নি কিছুতেই। বলেছিল, “তুমি নিজের জন্য ফতুয়া কেনো বুঝলে। আমার লাগবে না।”

প্রথম রমাদার চোখে দু’ফোঁটা জল দেখেছিল আনু। আর কথা ফোটেনি মুখে।

হাঁটতে হাঁটতে দাঁড়িয়ে পড়ে আনু। যা ভাবার ভাবা হয়ে গিয়েছে। একটু আত্মবিশ্বাসের দরকার। ঠিক যেমন এই মুহূর্তে মাথার ওপর মেঘগুলো থেকে গুরুগম্ভীর শব্দ ভেসে আসছে। ঝমঝমিয়ে আবার বৃষ্টি নামবে। এ তো তারই পূর্বাভাস। আনুর জীবনের অনিশ্চয়তাও দুর হতে নিশ্চয়ই বেশি দেরি নেই।…

Facebook Comments Box

LEAVE A RESPONSE

Your email address will not be published. Required fields are marked *

A creative writer, constant learner, bookworm. Passionate about my work.