সাদা মেঘ, কাশফুল এবং পূজোর সেকাল একাল

পূজোর সময় আমার ছোটোবেলাটা মনে পড়ে খুব। আকাশে সাদা মেঘ দেখলেই মা কে বলতাম, “দূর্গাপূজো কবে মা?” মা বলতো পূজোর এখনো অনেক দেরি আছে।
তবুও যেন একটা পূজো পূজো গন্ধ পেতাম
আকাশে সাদা মেঘের ভেলা ভাসতে দেখলেই।
পাড়ায় পাড়ায় চাঁদা নিতে আসতে দেখলেই
লাফিয়ে উঠতাম পূজোর বন্দুক কেনার ঝোঁক নিয়ে।
প্যান্ডেল শুরু হলেই পড়াশোনা থেকে অল্প অল্প ছুটি নিয়ে শুরু হতো সকাল বিকেল সদ্য শেখা ক্রিকেট খেলার পালা।
তারপর শুরু হতো পূজোর প্যান্ডেল, দোকান বাজারে পূজোর কেনাকাটার ভিড়। আনন্দের সীমা যেন পূজো আসবে আসবে করে বেড়েই যেত সেইসময়।
পূজোর কেনাকাটা নিয়ে তখন মোটেও কোনো উৎসাহ ছিল না। পূজো মানেই গুলি পটকা আর বন্দুকের তখন রমরমা বাজার।
পূজো এগিয়ে আসতে আসতে সাদা মেঘ মাঝে মাঝে ঘন অকালবৈশাখীর রূপ ধারণ করতো। ঠিক তখনই পরীক্ষার কথা মাথায় আসত।
তখন হাফ ইয়ার্লি এক্সাম হতো পূজোর ঠিক আগে। পূজোর আগে ওই সাত আট দিন ধরে পরীক্ষা দেওয়া যে কি চাপের ছিল!
পরীক্ষার সময় থেকেই সাদা কাশফলের বন দেখতে দেখতে যেতাম স্কুলের দিকে। কি যে মনকেমন করতো বলে বোঝানো যাবে না!
এক্সাম শেষ হলেই পূজো প্রায় শুরু হয়ে যেত আমাদের। তারপর মহালয়ার ভোর এলে অফিসিয়ালি সব বন্ধ করে পূজোর তোড়জোড় শুরু করতাম। মহালয়ার আগের রাতে উত্তেজনায় ঘুমোতে পারতাম না মনে হতো কখন ভোর হবে।
এখনো আকাশে সাদা মেঘ ভাসে, এখনো পূজোয় গুলি পটকা ও বন্দুক কেনার ঝোঁক এখনো করে শৈশবের আঙিনার ছেলেগুলো; তবে আমরা অনেকটা বড় হয়ে গেছি হয়তো!
আকাশে সাদা মেঘ দেখে আর পূজো পূজো গন্ধটা আসে না। কোলকাতার বাইরের শহরে আধুনিকীকরণের চৌহদ্দিতে কাশফুলের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া খুব মুশকিল। এখন আমাদের কাছে পূজো বলতে অষ্টমীর মধ্যে কোনোক্রমে বাড়ির চৌকাঠ পেরোতে পারলেই হলো।
কোলকাতার বাইরের ছেলেমেয়েদের কাছে পূজো বলতে এটাই। তবে মহালয়া টা চিরন্তন। ওইদিন ভোরের মধ্যে না জানি কিসের যাদু আছে। ঘুম ভেঙে যায় প্রায় দেশবিদেশের সমস্ত বাঙালির। তখন মনে হয়, সাদা মেঘ, কাশফুল সবমিলিয়ে সবটাই সত্যি। শুধু আমরাই বড় হয়ে গেছি।
সাদা কালো শহরের মায়েদের মনে খুশি থাকে প্রবাসী বাঙালি ছেলের পূছোয় বাড়ি ফিরে আসার। পূজোর প্রাসঙ্গিকতা এখানেই। পূজো একটা অসম্ভব মেলবন্ধন করেছে বাঙালিদের মধ্যে।
রঙিন শৈশবের সেই পূজোর আনন্দটা বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ফিকে হয়ে গেলেও পূজোয় বাড়ি ফেরার আনন্দটা ওরা যারা দূর আকাশে শরতের সাদা মেঘের দিকে তাকিয়ে কাশফুলের ছবি এঁকে কল্পনা করে তারাই বোঝে।
সাদা মেঘ, কাশফুল আর পূজোর সেকাল একাল মেলাতে গেলে হয়তো আজ অনেকটাই স্মৃতির ফ্রেমে বন্দি।
তবে পূজোর চারটে দিন বাড়িতে ফেরার আনন্দ আর মহালয়ার ভোরের বীরেন্দরকৃষ্ণ ভদ্রের গলার আওয়াজের সেকাল একাল বলে কিছু হয়না। ওগুলো চিরন্তন ঠাঁই পেয়েছে বাঙালির বুকে।