LaughaLaughi

You Create, We Nurture

Special Story

সহধর্মিণী সহযোদ্ধা

লোকমুখে প্রায়ই শোনা যায় যে, “সফল পুরুষের পেছনে একজন নারীর অবদান থাকে। ”
এতদিন পর্যন্ত কথাটা লোকমুখে থাকলেও এখন তা বিজ্ঞান সম্মত। কার্নেগি মেলন ইউনিভার্সিটির (সি এম ইউ) একদল গবেষক প্রমাণ করে দিয়েছেন যে “একজন ব্যক্তির জীবনে সফলতা লাভের সম্ভাবনা তখনই বেড়ে যায়, যখন সে একজন সহায়ক জীবনসঙ্গীকে পেয়ে থাকে।” আর এই প্রসঙ্গে জীবন্ত উদাহরণ দিতে গেলে বাঙ্গালির ইতিহাসের অমূল্য পৃষ্ঠাতে ফিরে যেতে হয়। ফিরে যেতে হয় বাঙালির গর্ব, বাঙালির জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে জড়িত ইতিহাসে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর সহধর্মিণীর সম্পর্কে বলেন, “আমার জীবনে দুটি বৃহৎ অবলম্বন।

প্রথমটা হল আত্মবিশ্বাস, দ্বিতীয়টি হল আমার স্ত্রী আকৈশোর গৃহিণী।” বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কে ছিলেন, কি করেছিলেন, তাঁর মহত্ত্ব ইত্যাদির সম্পর্কে সবাই কম বেশি জ্ঞান রাখেন। কিন্তু একজন মানুষের সফলতার পেছনের সেই কারিগর, যে কিনা সারাক্ষণ তাঁকে অনুপ্রেরণা দিয়ে,সাহায্য এবং শক্তি দিয়ে ঘিরে রেখেছে সেই মহামূল্যবান মানুষটা অচিরেই আড়াল হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর উক্তিটা যদি একটু বিশ্লেষণ করে দেখি তাহলে বোঝাই যায় যে তিনি জানতেন এবং মানতেন যে তাঁর সহধর্মিণী তাঁর শক্তি, তাঁর প্রেরণা।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর জীবনের ১৪টি বছর কারাগারে ছিলেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে তাঁর পরিবার,তাঁর সন্তানদের হাল ধরেছেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা। পরিবারে বাবা বা ছেলের ভূমিকা অনেক বেশিই হয়ে থাকে। বিশেষ করে যে পরিবারের বাবা মা বৃদ্ধ এবং সন্তানেরা কম বয়সী। দেখা যায় যখন থেকে শেখ ফজিলাতুন্নেছা সংসার বুঝতে শিখেছেন তখন থেকেই বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতেও সংসার এবং পরিবারকে বেশ ভালো ভাবেই সামলে নিতে শিখেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ২৬শে মার্চ আজিমপুর গার্লস স্কুলে দেয়া এক ভাষণে বলেছিলেন,
” আমি দেখেছি ১০/১১ বছর জেলখানায় থাকলেও তিনি কোন দিন মুখ খুলে প্রতিবাদ করেন নি। যদি তিনি তা করতেন তাহলে আমি জীবনে অনেক বাঁধার মুখোমুখি হতাম। এমন অনেক সময় ছিল যখন আমি জেলে যাবার সময় আমার সন্তানদের জন্য একটি পয়সাও রেখে যেতে পারিনি। আমার নিরন্তর সংগ্রামী জীবনে তাঁর প্রচুর অবদান আছে।”

একজন মানুষ কখনই দুটো জায়গায় থাকতে পারবেন না এবং দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের প্রতি নিজ দায়িত্ব পালন করেছেন বা করতে পেরেছেন কারণ অপর দিকে তিনি জানতেন তাঁর অন্যান্য দায়িত্ব পালন করার জন্য একজন নেত্রী আছেন। আর তিনি হচ্ছেন সহধর্মিণী শেখ ফজিলাতুন্নেছা। সহধর্মিণী শব্দটার অর্থ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যিনি সব কাজ এবং দায়িত্বে সমান অংশীদার। সেটা পারিবারিক দায়িত্ব হোক বা হোক রাষ্ট্র গঠনের দায়িত্ব। আর একজন আদর্শ সহধর্মিণীর প্রতিকৃতি হলেন শেখ ফজিলাতুন্নছা।

শেখ জহুরুল হকের দুই কন্যা, জিন্নাতুন্নেছা এবং ফজিলাতুন্নেছা। কন্যা ফজিলাতুন্নেছার বয়স যখন দুই বছর তখন তাঁর বাবা মারা যান। বাবা হারানোর পর তাঁর দাদা বঙ্গবন্ধুর বাবাকে ডেকে বিবাহের প্রস্তাব দেন। এই পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা ” অসমাপ্ত আত্মজীবনী ” থেকে তাঁর নিজের কিছু লেখা উল্লেখ করবো। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন,” একটা ঘটনা লেখা দরকার, নিশ্চয়ই অনেকে আশ্চর্য হবেন। আমার যখন বিবাহ হয় তখন আমার বয়স বার তের বছর হতে পারে। রেণুর বাবা মারা যাবার পর ওর দাদা আমার আব্বাকে ডেকে বললেন, “তোমার বড় ছেলের সাথে আমার এক নাতনীর বিবাহ দিতে হবে। কারণ আমি সমস্ত সম্পত্তি তাদের দুই বোনকে লিখে দিয়ে যাবো।” রেণুর দাদা আমার আব্বার চাচা। মুরুব্বির হুকুম মানার জন্যই রেণুর সাথে আমার বিবাহ রেজিস্ট্রি করে ফেলা হয়। আমি শুনলাম আমার বিবাহ হয়েছে।”

যখন তাঁদের বিবাহ হয় তখন ফজিলাতুন্নেছা অর্থাৎ রেণুর বয়স তিন বছর। তাঁর বয়স যখন পাঁচ তখন তাঁর মা মারা যান। দাদার কাছেই ছিলেন তিনি। তাঁর বয়স যখন সাত তখন তাঁর দাদা মারা যান। তারপর তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মায়ের কাছে চলে আসেন। বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর ভাই বোনদের মাঝে হেসে খেলে বড় হতে থাকেন শেখ ফজিলাতুন্নেছা। পরবর্তীতে দেখা যায় শাশুড়ির প্রিয় সন্তান হিসেবেই তিনি আত্মপ্রকাশ করেন। এই প্রসঙ্গে ড. নীলিমার সূত্রে জানা কিছু উক্তি উল্লেখ করবো। তার আগে জেনে নিতে হবে ড.নীলিমা ইব্রাহিমের সাথে বঙ্গবন্ধুর মা সায়েরা খাতুনের প্রথম পরিচয় হয় বরিশাল-ঢাকা লঞ্চে। তখন সায়েরা খাতুন বলেছিলেন,” তাঁর দায়িত্বজ্ঞানহীন একটা পাগল ছেলে আছে। সে শুধু রাজনীতি জানে,ঘর-সংসার কিছুই বোঝে না, সবই বৌমার ঘাড়ে। এখন বৌমা আসন্ন প্রসবা। পাগল তো গিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে বসে আছে।”

ড.নীলিমা লক্ষ্য করলেন সায়েরা খাতুন তাঁর ছেলের সম্পর্কে প্রায় সময় পাগল বলছেন। তাই আগ্রহ প্রকাশ করে জিগ্যেস করলেন,” পাগল ছেলেটির নাম কি?” উত্তর পেলেন ,”মুজিব,শেখ মুজিবুর রহমান। ” এই উক্তি থেকেই বোঝা যায় যে পরিবারের কাছে শেখ ফজিলাতুন্নেছা কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন। তাঁর সংসার জ্ঞান কতটা বিস্তর ছিল। ঘর,পরিবার নিয়ে, যাবতীয় দায়িত্ব তিনি একাই পালন করে গেছেন। সংসার দায়িত্বের যে অংশটুকু বঙ্গবন্ধু পালন করার সুযোগ পান নি, তাঁর অসম্পূর্ণতাকে কত সাবলীল ভাবে বঙ্গমাতা পূরণ করে দিয়েছেন।

বঙ্গমাতাকে নিয়ে যেটুকু পড়েছি তা থেকে যা বুঝলাম তিনি খুব সাধারণ গ্রাম্য মেয়ে। যিনি পরিবার পরিজন নিয়ে একান্ত গ্রাম্য পরিবেশে থেকেছেন। বঙ্গমাতার সাংসারিক জীবনের চূড়ান্ত মন্তব্য খুঁজে পেয়েছি প্রয়াত সাংবাদিক এবং বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য এ.বি.এম মূসার লেখনীতে। তিনি লিখেছেন,” বহু বছর আগে স্বামীর সঙ্গে গ্রাম্যবধূর যে লেবাসটি পরে এসেছিলেন তা ছাড়তে চাননি। ……শেখ মুজিবের পত্নীকে আমি দেখেছি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির পত্নী ফার্স্ট লেডিকে দেখিনি। দেখেছি আটপৌরে শাড়ি পরনে পালঙ্কে বসে বাটা হাতে পান সাজাতে। রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের পাশে রাষ্ট্রীয় বাহনে তাঁকে দেখা যায়নি,দেখা যায় নি তাঁর সাথী হয়ে বিমানে করে রাষ্ট্রীয় সফরে যেতে।”

এই একটি উক্তিই যথেষ্ট শেখ ফজিলাতুন্নেছার সম্পর্কে ধারনা রাখার জন্য। যিনি একটা দেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী তাঁর স্ত্রী হয়ে বিমানে চড়ে বিদেশ সফর করেন নি। নাই বা পোশাকে বিলাসিতা দেখিয়েছেন। তিনি চাইলেই কতো কিছু করতে পারতেন নিজ ইচ্ছায়। কিন্তু তিনি তা করেন নি। আর এইখানেই তাঁর সাধারণের মধ্যে অসাধারণ হয়ে, উজ্জ্বল সূর্যের ন্যায় ফুটে উঠার প্রামাণ্যচিত্র পাওয়া যায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সূত্রে জানা যায়, যে বঙ্গমাতা গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করছেন। যে সময়ের কথা লিখছি সেই সময়ে গ্রাম্য পরিবেশে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া তাও আবার একজন নারী হিসেবে, অনেক বড় একটি ব্যপার। তবে এটুকুতেই আমাদের বঙ্গমাতা থেমে থাকেন নি। স্বশিক্ষায় নিজেকে শিক্ষিত করার প্রচেষ্টায় লেগে পরেন তিনি। বঙ্গবন্ধু যখন নানা কারণে, নানা জায়গায়, নানান কারাগারে ছিলেন তখন বঙ্গমাতা তাঁর সময় কাটাতেন বই পড়ে। তিনি পড়তেন বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, প্রবোধ সান্যাল, বিভূতিভূষণ প্রমুখের সাহিত্যকর্ম।

তাঁর তীব্র প্রচেষ্টার আরো একটি বিশেষ প্রমাণ স্বরূপ আমি উল্লেখ করতে চাই যে, বঙ্গমাতা এমন একজন নারী যিনি স্বামীর প্রিয় মনীষী বার্ট্রান্ড রাসেলকে নিয়ে স্বামীর সঙ্গে আলোচনা করেছেন। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়া নারীর পক্ষে মনীষী বার্ট্রান্ড রাসেল বোঝা এত সহজ ব্যাপার নয়। কিন্তু তিনি বুঝেছিলেন বিধায় আলোচনা করতেন। এ থেকে বোঝা যায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাই শুধু মানুষকে শিক্ষিত করে তুলে না বরং নিজ প্রচেষ্টায় যথার্থ জ্ঞান অর্জন করেও নিজেই নিজেকে শিক্ষিত করা যায়। আর এই বিষয়ের জীবন্ত উদাহরণ বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা নিজেই। পড়ার প্রতি, জ্ঞান অর্জনের প্রতি যে তাঁর তীব্র নেশা ছিল তার প্রমাণ স্বরূপ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি উক্তি উল্লেখ করছি। তিনি বলেছেন, “মা ও আব্বা মিলে কাগজ পড়তেন। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন।

…আমার মা খুব খুঁটিয়ে কাগজ পড়তেন। দুপুরে খাবার খেয়ে মা পত্রিকা ও ডাকবাক্সের চিঠিপত্র নিয়ে বসতেন। আমাদের বাসায় নিয়মিত “বেগম” পত্রিকা রাখা হতো। “ন্যাশনাল জিওগ্রাফি”,”লাইফ” এবং “ডাইজেস্ট”…এই পত্রিকাগুলি রাখা হতো ” সমকাল” সাহিত্য পত্রিকাও বাসায় রাখা হতো। মা খুব পছন্দ করতেন। “বেগম” ও “সমকাল” এই দুটো লেখা মায়ের পছন্দ ছিল।”

একজন নারীর সবচেয়ে বড় দায়িত্ব এবং পরিচয় হল মা হওয়া। শুধু জন্ম দিলেই কেউ মা হয়ে উঠতে সক্ষম নয়। মা হতে হলে সন্তানদের সবদিক থেকে শিক্ষিত করতে হয়, সন্তানদের ভালো মন্দ সম্পর্কে জানতে হয়। সন্তানদের ভুল পথে যাওয়া থেকে বিরত রাখতে হয়। শেখ ফজিলাতুন্নেছা মা হয়ে উঠতে পেরেছেন। তাঁর এবং বঙ্গবন্ধুর সন্তানদের তিনি মানুষ বানিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিততে তিনি সন্তানদের বেশ ভালো শিক্ষা দিয়ে বড় করেছেন। একজন মা হিসেবে যে দায়িত্ব আছে তার পাশাপাশি বাবার কর্তব্যও তিনি খুব সুন্দর করে পালন করেছেন। বঙ্গমাতার বলা কিছু কথা তুলে ধরবো যা থেকে বুঝা যায় তিনি সন্তানদের ভালো শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। এবং যে কোন পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য অগ্রিমভাবে তৈরি করেছেন। তিনি বলেছেন,” আমি চুবানি খাইয়া খাইয়া সাঁতার শিখছি,বাচ্চাদের এতটুকু বিলাসিতা শিখাই নাই।” এই ক্ষেত্রে কোন সন্দেহ নেই যে তিনি যেমন সাধারণ ভাবে জীবন যাপন করেছেন,তাঁর সন্তানদেরও তাই শিক্ষা দিয়েছেন।

মানুষ যখন পরিশ্রম করে কোনো কিছু অর্জন করতে পারে সেই অর্জনের গুরুত্ব সে বুঝে। আর যে জিনিসটা পরিশ্রম ছাড়াই হাতের নাগালে চলে আসে সেই জিনিসের প্রতি তার কোনো গুরুত্ব থাকে না। আর বিলাসিতার জীবনও ঠিক তেমন। আর কথায় আছে না, ” মানুষ যত পায়, ততো চায় ” । শেখ ফজিলাতুন্নেছার উক্তিতে তিনি জানান দিয়েছেন যে তিনি তাঁর সন্তানদের বিলাসিতা করতে শেখান নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছেন, ” … মাকে সবাই ভয় পেত। মার অপছন্দের কাজ করলে,পড়াশোনায় ফাঁকি দিলে মায়ের কাছে নির্ঘাত শাস্তি পেতে হবে। … তার ওপর মাকে তো আমরা আরও ভয় পেতাম,মার হাতে দু-চার ঘা যে খেতে হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।” এ থেকে বোঝা যায় শেখ ফজিলাতুন্নেছা সন্তানদেরকে শাসন করতেন যেন তারা ভুল পথে চলে না যায়। একজন সন্তানকে সত্যিকার অর্থে মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হলে অনেক সময় শাসন করতে হয়। আর এই শাসনের বিনিময়েই একজন সন্তান খাঁটি সোনা হয়ে উঠতে পারে।

বঙ্গমাতা শুধু যে শক্ত এবং দৃঢ় ছিলেন তা নয়। তিনি বেশ রসিক একজন মানুষ ছিলেন। তাঁর রসিক স্বভাবের উদাহরণ দেওয়ার জন্য একটি ঘটনা উল্লেখ করতে হয়। বঙ্গমাতা একবার ড.নীলিমাকে বললেন,” নিজের ভাইকে বানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু আর আমাকে বঙ্গমাতা,বেশ আমি বুঝি ‘ বঙ্গবান্ধুবি ‘ হতে পারি না। এতই কি বুড়ো হয়েছি। ” তাঁর এই ব্যাপারটা বেশ দারুণ। তাঁর কথায় বেশ রসিকতা রয়েছে। রসিক মেজাজের পাশাপাশি তিনি ছিলেন বেশ রুচিশীল। মা সম্পর্কে শেখ রেহানা বলেছেন,” … মায়ের রুচি ছিল অসাধারণ। ঘরদোর সব সময় থাকত সাজানো গোছানো। রান্নাবান্না সেলাই ফোঁড়াই সব কিছুতে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত।”

এবার আসি বঙ্গবন্ধু এবং বঙ্গমাতার সম্পর্কের দিকে। তাঁরা দুজন ছিলেন যোদ্ধা দম্পতি। বঙ্গবন্ধু যখন কারাগারে ছিলেন তখন বঙ্গমাতা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যেতেন এবং বাইরের সব খবর তিনি অবিকল পৌঁছে দিতেন বঙ্গবন্ধুর নিকটে। বঙ্গবন্ধুর লেখা “অসমাপ্ত আত্মজীবনী” লেখার প্রেরণাও বঙ্গমাতা। “অসমাপ্ত আত্মজীবনী” বইয়ের এক নম্বর পৃষ্ঠাতেই তিনি লিখেছেন,” আমার সহধর্মিণী একদিন জেলগেটে বসে বলল,” বসেই তো আছ, লেখ তোমার জীবনের কাহিনী।”একই লেখায় তিনি বারবার প্রকাশ করেছেন যে তাঁর এই লেখা লিখার জন্য তাঁর রেণু কতটা আগ্রহ প্রকাশ করতেন। তিনি খাতা শেষ হওয়ার আগেই খাতা এনে দিয়ে যেতেন। নানান বই দিতেন যেন কারাগারের অবসর সময়ে তিনি বই পড়তে পারেন। বঙ্গবন্ধু লিখেন,”রেণু তো নিশ্চয়ই পথ চেয়ে বসে আছে। সে তো নীরবে সকল কষ্ট সহ্য করে, কিন্তু কিছু বলে না। কিছু বলে না বা বলতে চায় না, সেই জন্য আমার আরও বেশি ব্যথা লাগে। ” বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জানতেন তাঁর অনুপস্থিতি তাঁর স্ত্রীকে কতটা দুঃখী করে দিচ্ছে দিনের পর দিন। আর তাঁর সহ্যের সীমা সম্পর্কেও বঙ্গবন্ধু বেশ জানতেন। আর এক জায়গায় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন “কলকাতা যাব, পরীক্ষাও নিকটবর্তী। লেখাপড়া তো মোটেই করি না।

ভাবলাম কিছুদিন লেখাপড়া করব। মাহিনা বাকি পড়েছিল, টাকা-পয়সার অভাবে। রেনুর কাছে আমার অবস্থা প্রথমে জানালাম। আব্বাকে বললে তিনি অসন্তুষ্ট হলেন মনে হলো। কিছুই বললেন না। টাকা দিয়ে আব্বা বললেন, ‘কোনো কিছুই শুনতে চাই না। বিএ পাস ভালোভাবে করতে হবে। অনেক সময় নষ্ট করেছ, ‘পাকিস্তানের আন্দোলন’ বলে কিছুই বলি নাই। এখন কিছুদিন লেখাপড়া কর।’ আব্বা-মা, ভাই-বোনদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ’রেণুর ঘরে’ এলাম বিদায় নিতে। দেখি কিছু টাকা হাতে করে দাঁড়িয়ে আছে। ‘অমঙ্গল অশ্রুজল’ বোধহয় অনেক কষ্টে বন্ধ করে রেখেছে। বলল, ‘একবার কলকাতা গেলে আর আসতে চাও না। এবার কলেজ ছুটি হলেই বাড়ি এসো।’ এভাবেই সারাজীবন ‘রেণুর ঘর’ ছিল শেখ মুজিবের নিশ্চিন্ত আশ্রয়। বঙ্গমাতাকে নিয়ে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ এবং ‘ কারাগারের রোজনামচা’ বই দুটোতে বেশ কিছু জায়গায় লেখা পেয়েছি। খুঁজে পেয়েছি দুজনের বিচ্ছেদের দুঃখ, খুঁজে পেয়েছি কিছু অপ্রকাশিত ভালোবাসা, খুঁজে পেয়েছি কিছু অম্লান স্মৃতিচারণ।

বঙ্গবন্ধু নিজে কোনদিন তাঁর জন্মদিন পালন করতেন না। কিন্তু স্ত্রী জন্মদিনে প্রত্যেকবার তাঁকে “ছোট্ট একটি উপহার” দিতেন। সেই উপহার শুধু উপহার নয় অনুপ্রেরণা এবং ভালোবাসা। বঙ্গবন্ধুর ব্যস্ততা এবং বারবার কারাগারে যাওয়া বঙ্গবন্ধুর স্বাস্থ্যের ক্ষতি করতো। আর তিনি ছোটবেলা থেকেই প্রায় অসুস্থ থাকতেন। এই ব্যপারে বঙ্গমাতা সবসময়ই চিন্তিত থাকতেন। একদিন একান্তে স্বামীকে বলেছিলেন, “জেলে থাক আপত্তি নাই, তবে স্বাস্থ্যের দিকে নজর রেখ। . . . তোমার বোঝা উচিত আমার দুনিয়ায় কেউ নাই। ” বাবা মা হারা সেই নারী যার স্বামীর জগৎ ছাড়া কিছুই নেই, সে নারী তাঁর সংগ্রামী স্বামীর কাছে আর কি প্রত্যাশা করতে পারে। তাঁর জন্য তো সব কিছুই তাঁর স্বামী। তাই তিনি প্রায়ই চিন্তিত থাকতেন। আরেকটি ঘটনা উল্লেখ করছি, বাংলাদেশ সফর করে বিমানবন্দরে বিদায় নেয়ার সময়ে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গমাতার কাছে অনুযোগ শুনলেন, “কামালের আব্বারে একটু কইয়া যান তো, উনি যেন ঠিক টাইম মতো খাওয়াদাওয়া করেন। ” ইন্দিরা গান্ধী শান্তি নিকতনে পড়তেন তাই একটু কষ্ট করে হলেও বাংলা বুঝতেন। তিনি বঙ্গবন্ধুকে বললেন, “এক্সেলেন্সি, এটা তো সাংঘাতিক অভিযোগ; আমিও প্রধানমন্ত্রী এবং বেশ ব্যস্ত থাকি। কিন্তু লাঞ্চ-ডিনার খুবই টাইমমতো করি। আপনিও লক্ষ্য রাখবেন।” তিনি সংযোজক বক্তব্যে বললেন, “সত্যিই বেঙ্গলি হাউসওয়াইফদের তুলনা হয় না। ” সত্যিই তো তাই।

রাজনীতির সাথে বঙ্গমাতার কোন সম্পর্কই ছিল না। তিনি সংসার,সন্তান,পরিবার সামলাতে ব্যস্ত ছিলেন আজীবন। তবুও রাজনীতি সম্পর্কে তাঁর বেশ ভালো জ্ঞান ছিল। বঙ্গবন্ধু একবার বললেন, “…. আমার স্ত্রী রাজনীতির ধার ধারে না। আমার সাথে পার্টিতে কোন দিন যায় নাই। সে তার সংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকে। বাইরের লোকের সাথে মেলামেশাও করে না। আমার রাজনীতির সাথে তার সম্বন্ধ নাই।” অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু প্রায়ই রাজনীতি নিয়ে সহধর্মিণীর সাথে আলোচনা করতেন, পরামর্শ নিতেন। এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু- কন্যা শেখ হাসিনা বলেন, “আন্দোলন কীভাবে করতে হবে, সেটা মায়ের কাছ থেকেই শেখা। বঙ্গমাতা ছিলেন ‘গেরিলা’…।” বঙ্গমাতা শুধু বঙ্গবন্ধু কে নয় বঙ্গবন্ধু কন্যাকেও পরামর্শ দিতেন। শুধু তাই নয় বত্রিশ নম্বর বাড়িতে প্রায়ই মানুষ আসত,আলোচনা হতো। বঙ্গমাতা তাদের এবং তাদের পরিবারের খোঁজ খবর রাখতেন। একজন মুক্তিযোদ্ধার জবানিতে শুনেছিলাম,” আমরা তখন তরুণ। বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে যাই কয়েকজন মিলে। দুপুরের সময় ছিল। তিনি ভেতরের রুমে বসা। ভেতরের রুমে মিটিং হয়, আলোচনা হয়। মাঝে মাঝে তিনি বাইরে এসে ঘুরে যেতেন। আমরা দাড়িয়ে আছি। বঙ্গবন্ধু হঠাৎ আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন,’ গরুর গোস্ত দিয়ে বুটের ডাল রান্না হয়েছে, যা, যা ভেতরে গিয়ে খেয়ে আয় ‘ আমরা ভেতরে গেলাম তাঁর স্ত্রী আমাদের গরুর মাংস দিয়ে বুটের ডাল আর পরোটা খেতে দিয়েছিলেন।” বঙ্গমাতার স্বভাবে কোমলতা আছে,স্নেহ আছে। তিনি অনেক সহযোদ্ধাদের টাকা পয়সা, গহনা দিয়েও সাহায্য করতেন।

বঙ্গমাতার অনুপ্রেরণাই বঙ্গবন্ধুকে বঙ্গবন্ধু হতে সাহায্য করেছেন। এই প্রসঙ্গে একটি ঘটনা না উল্লেখ করলেই নয়। ব্যাপারটি শিষ্য তরুণ শেখ মুজিবের রাজনৈতিক গুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নজরে পড়েছিল। ১৯৪৬-এ বিহারে দাঙ্গা উপদ্রুত অঞ্চলে তিনি শেখ মুজিবকে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে পাঠাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তার আগে টুঙ্গিপাড়ার বাড়িতে অসুস্থ স্ত্রীর অনুমতি নিতে বলেছিলেন। স্ত্রী রেণু চিঠি লিখেছিলেন, যাতে তার নির্দ্বিধ সম্মতি ছিল। চিঠির ভাষা প্রণিধানযোগ্য: “আপনি শুধু আমার স্বামী হওয়ার জন্য জন্ম নেননি, দেশের কাজ করার জন্যও জন্ম নিয়েছেন। দেশের কাজই আপনার সবচাইতে বড় কাজ। আপনি নিশ্চিত মনে সেই কাজে যান। আমার জন্য চিন্তা করবেন না। আল্লার উপর আমার ভার ছেড়ে দেন। ”

এ চিঠির মর্মার্থ অবহিত হবার পর সোহরাওয়ার্দী মন্তব্য করতে বাধ্য হয়েছিলেন, “মুজিব, সে তোমার জন্য স্রষ্টার দেয়া অতি অমূল্য দান। অনুগ্রহ করে তাকে অবহেলা করো না।” শেখ মুজিবুর রহমান কোনদিন তাঁর রেণুকে অবহেলা বা উপেক্ষা করেননি। এরূপ মন-মানসিকতার মানুষ তিনি ছিলেন না।

বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছাকে নিয়ে এতক্ষণ আলোচনা করেছি। তাঁর জীবনের ছোট বড় কিছু ঘটনা নিয়ে আলোচনা করেছি। সংক্ষিপ্ত আকারে লিখতে গেলে অনেক কিছুই অজানা রয়ে যায়। আর ইতিহাসের এই মহান ব্যক্তিত্বদের নিয়ে লিখতে গেলে শব্দ কম পরে যায়। এই আলোচনার প্রেক্ষিতে আমি বলতে পারি শেখ ফজিলাতুন্নেছা শুধু মাত্র যে বঙ্গবন্ধুর কারণে “বঙ্গমাতা” খেতাব পেয়েছেন তা নয়। তাঁর মধ্যে একজন আদর্শ নারী, একজন আদর্শ সহধর্মিণী, একজন আদর্শ গৃহবধূ, একজন আদর্শ মায়ের সকল গুন রয়েছে। যেকোনো পরিস্থিতে তিনি নির্ভীকতার পরিচয় দিয়ে বঙ্গবন্ধুর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন সবসময়। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতে তাঁর সকল দায়িত্ব পালন করেছেন শেখ ফজিলাতুন্নেছা। বঙ্গবন্ধুর চলার পথের মসৃণতা ছিলেন তিনি। তাঁর কারণেই বঙ্গবন্ধু নিশ্চিন্তায় সম্পূর্ণ মনোযোগ দিতে পেরেছেন সংগ্রামে। কারণ বঙ্গবন্ধু জানতেন পেছনে তাঁর স্ত্রী আছে ঢাল হয়ে।

সংকটে,সংগ্রামে, দুর্যোগে, দুর্বিপাকে সব সময় নির্ভীক এবং দৃঢ় প্রত্যয়ী হয়ে সকল পরিস্থিতির মোকাবেলা করেছেন বঙ্গমাতা। এমন কি জীবনের শেষ মুহূর্তেও স্বামীর পাশ ছাড়েন নি। দেশের বুক খালি করে চলে গিয়েছেন স্বামীর হাত ধরেই।
পরিশেষে বলবো,
“কখনো স্ত্রী, কখনো যোদ্ধা হয়েছ
কখনো মা,কখনো গেরিলা সেজেছ
কখনো আলোচনায় আবার কখনো সংগ্রামে,
স্বামীর পাশে থেকেছ
তবে হার মানতে শেখো নি হে,বঙ্গকন্যা।

কখনো অশ্রু, কখনো বা হাসি
কখনো বা বিচ্ছিন্ন, কখনো বা সঠিক
সংকটে- সংগ্রামে, দুর্যোগে- দুর্বিপাকে
এক নারীর প্রতিকৃতি- বঙ্গমাতা শেখ মুজিব।”

– লামিসা সানজানা (বাংলাদেশ)

Facebook Comments Box

LEAVE A RESPONSE

Your email address will not be published. Required fields are marked *