LaughaLaughi

You Create, We Nurture

Short

ত্রিনয়ন দূর্গা

দূর্গা, কোথায় গেলি? ত্রিনয়ন টা এঁকে যা..
সময় হয়ে এলো যে,
আজ মহালয়ার পূর্ণ লগ্ন..
নে নে তাড়াতাড়ি মা দূর্গার কপালে ত্রিনয়ন টা এঁকে দে সূর্য ওঠার আগে।

 

(ছবি-সংগৃহীত)

উঠোনে বসে রামবাবু মা দূর্গার চোখ আঁকছিলেন,
মায়ের ইচ্ছাই দূর্গাই প্রতিবার ত্রিনয়ন দান করেন..
তাই এবারেও অন্নথা হয়নি।
পেছনের ছোট্ট ঘরটা থেকে দূর্গা বলে উঠলো,
এই তো বাবা,আসছি,আর একটু..
মা দূর্গার ত্রিনয়ন থেকে জলন্ত আগুনে
অসুরগুলো সব জ্বলে যাচ্ছে জানো।
কি মজা,ঠিক হয়েছে,ওরা সবাই শাস্তি পেয়েছে।

রামবাবু হেসে উঠলেন,
বললেন, হ্যাঁ রে, মা যেমন ত্রিনয়ন দিয়ে অসুরদের বধ করেন,তেমনি আবার ভালো কাজ করলে সবাই কে ভালোবাসেন।
তিনি যে মঙ্গলময়ী মা।
নে,নে,কই গেলি.. তাড়াতাড়ি আয় এবার..
নয়লে বাবু এসে ঠাকুর রেডি না দেখলে খুব করে বকবে।

ছোটো দূর্গা ভয়ে তাড়াতাড়ি ছুটে এলো,
বাবা,ঠাকুর টা আজকের মধ্যে না দিলে..
ওরা বুঝি তোমাকে মারবে?জানো ওই লোকগুলো খুব  বাজে, নিষ্ঠুর।
আমার ওদের একটুও ভালোলাগে না।তুমি কেনো ওদের ঠাকুর বানিয়ে দাও?

রামবাবু বললেন,উনারা কি আমাদের মতো গরীবের কষ্ট বোঝেন রে মা,না করলে যে এখানে থাকতে দেবে না,                    থাক ওসব কথা,বাদ দে দেখি,
নে,নে তুই আঁক এবার,অনেক দেরি হলো।
আগে ঠাকুর কে প্রনাম করে নে ভালো করে।

 

(ছবি-সংগৃহীত)

দূর্গা বলে উঠলো, হ্যাঁ বাবা..করেছি..
রামবাবু বললেন বেশ করেছিস,তা হ্যাঁ রে মা,কি চাইলি মায়ের কাছে?
দূর্গা তখন একমনে কালো রঙ দিয়ে কপালে ত্রিনয়ন
আঁকছিলো।
হঠাৎ ই বলে উঠলো-  ত্রিনয়ন ।
রামবাবু চমকে উঠে বললেন সেকি?কেন!

দূর্গা বললো,বাবা..
আমার যদি ত্রিনয়ন থাকতো,
তাহলে ওই সেদিন মধু দিদিকে জঙ্গলে মোড়ল সাহেবের যে লোকেরা পুড়িয়ে মেরেছিলো..
তাদের আমি মায়ের মতো  ত্রিনয়ন দিয়ে আগুন বের করে এক নিমেষে ভস্ম করে দিতাম।

মায়ের পূজোয় ওরা ওই ছাগলগুলো নিয়ে এসে
বলি দেয়,জানো আমার খুব কষ্ট হয় তখন,
মনে হয়,আমার যদি ত্রিনয়ন থাকত,
এক্ষুনি গিয়ে ওদের মেরে আসতাম।
বলো বাবা,ঠাকুর কি কখনো এরকম চাইতে পারে?
ঠাকুর তো জন্ম দেয়,ওরা বলছিলো..
মা নাকি এতে তুস্ট হন,
বাবা,মা কেন এগুলো আটকাতে পারেননা?
মা কি তবে সত্যি ভালোবাসেন?
তুমি যে বলেছিলে মা সৃষ্টিকতৃ..!

রামবাবুর চোখ বেয়ে জল বয়ছে তখন..
একি!এতটুকু দূর্গার এত জ্ঞ্যান..
অথচ ওই নৃশংসদের কোনো জ্ঞ্যান নেই।
কেন ঠাকুর কেন?
তুমি ই বলো আমি ওকে কি জবাব দেবো এবার?

হঠাৎ ই জোর গলায় পান মুখে নিয়ে গ্ৰামের মোড়ল মশাই বলে উঠলেন –
কি হে রাম কুমোর..ঠাকুর সাজানো সব শেষ তো?
রামবাবু হকচকিয়ে উঠলেন,
এ..কি মো-ড়-ল ম-শা-ই আ-প-নি!
মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলেন..
এখনো সাজানোর অনেক বাকি!
হাত জোড় করে বলতে যাবে,কিছু সময় দেওয়ার জন্য..
এমন সময় দেখি রামবাবুর জামাটা ধরে
টানতে টানতে নিয়ে এলো মাঝ উঠোনে..
মোড়ল সাহেবের লোকেরা।
বললো,তোকে না বলেছিলাম,আজকেই চাই।
দূর্গা ভয়ে আড়স্ট হয়ে উঠেছিলো তখন।
মো‌ড়ল সাহেবের চাবুকের আঘাতে…
রামবাবুর সাদা জামা তখন রক্তে প্রায় ভিজেই গেছে।

 

(ছবি-সংগৃহীত)

দূর্গা এ অনাচার আর সহ্য করতে পারছেনা,
ওর চোখের জলে যেন মায়ের মুখ রাগে আরও লাল হয়ে উঠছে।
মায়ের ত্রিনয়ন থেকে যেন আগুনের ফুলকি বেড়িয়ে আসছে,
মাটির মূর্তি থেকে ভেসে আসছে আওয়াজ…
মা যেন বলছে, “দূর্গা,ভয় পাস না,
যা,তোর বাবাকে ওরা মেরে ফেলছে…
তুই এই অন্যায় হতে দিসনা,
আমার হাতের এই ধারালো ত্রিসুল দিয়ে বধ কর ওই নরপিশাচদের।
ওদের পাপের ঘোরা পূর্ণ হয়েছে।
যা, দূর্গা..ওই পাপিষ্ঠদের বিনাস করে নতুন মহালয়ার সূচনা কর।
আমি যে আজকের দিনের অপেক্ষায় ই ছিলাম।”

 

(ছবি-সংগৃহীত)

ছোট্ট দূর্গা যেন প্রতিবাদের আগুনে গর্জে উঠেছে।
মায়ের ত্রিশুল হাতে নিয়ে উঠোনের দিকে এগিয়ে আসছে ক্রমশ,
সে কি ভয়ঙ্কর রুপ…
কপালে যেন একই রকম ত্রিনয়ন আঁকা,
তীব্র বেগে যেন আগুনের ফুলকি বেরিয়ে আসছে কপাল থেকে।
রক্তমাখা কাতর রামবাবু যেন ভুলে গেলেন শূদ্রত্বের তকমা, হাত জোড় করে একদৃষ্টে তাকিয়ে মন্ত্র বলতে লাগলেন-

“যা দেবী সর্বঃভূতেসু মাতৃ রূপেনসংস্থিতা
নমঃস্তসে, নমঃস্তসে, নমঃস্তসে,নমো নমোঃ।
যা দেবী সর্বঃভূতেসু শক্তি রূপেনসংস্থিতা
নমঃস্তসে, নমঃস্তসে, নমঃস্তসে,নমো নমোঃ।”

(ছবি-সংগৃহীত)

দূর্গার হাতের ধারালো অস্ত্রের মুখটা তখন মোড়ল সাহেবের বুকে এসে গেঁথেছে।
ত্রিনয়ন থেকে যেন বিদ্যুতের স্ফুলিঙ্গের মতো
আগুন বেরিয়ে আসছে।
বুক চিড়ে রক্ত ঝড়ে ঝড়ে পড়ছে।
মোড়ল সাহেবের গায়ের ওপর যেন স্বয়ং ত্রিনয়ন-ই মা দূর্গা কেই দেখতে পাচ্ছেন রামবাবু।
চোখের জল আটকাতে পারলো না।
মাথা ঠুকতে ঠুকতে জোর গলায় বলে উঠলো- মা,মা গো তুমি সাক্ষাৎ দর্শন দিলে মা, আমি আজ ধন্য হলাম,
আমি আজ ধন্য হলাম মা।আমার দুহাত দিয়ে তোমার প্রতিমা গড়া,আজ সার্থক হয়েছে।”

রামবাবুর ভাঙা রেডিও থেকে তখন মহালয়ার সেই গানটা ভেসে আসছে-
“জাগো….তুমি জাগো,জাগো দূর্গা,জাগো দশপ্রহরনধারিনী,অভয়া শক্তি বলপ্রদায়িনী তুমি জাগো।”

Facebook Comments Box

LEAVE A RESPONSE

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Editorial Team of LaughaLaughi