LaughaLaughi

You Create, We Nurture

I got a story to tell

আবিস্কার

।। আবিস্কার ।।


অন্ধকারে একলা জেগে আকাশ দেখার মত আনন্দ হয়তো খুব কমই আছে।
মিটমিট করে জ্বলতে থাকা হাজার হাজার তারা,
রূপোর থালার মতো একটা চাঁদ, আর মাঝে মাঝে তাকে ঢেকে দিয়ে চলে যাওয়া কিছু শয়তান মেঘ।
আকাশের দিকে তাকিয়েই কেটে যায় ঘন্টার পর ঘন্টা,
কিভাবে একটা গোটা রাত পার হয়ে যায় ভাবাই যায় না।
এই অন্ধকারটার মধ্যে যেন একটা অন্যরকম ভালোলাগা আছে, একটা ভালবাসা আছে।

‘এখন অনেক রাত, তোমার কাঁধে আমার নিশ্বাস!’
-আকাশের দিকে চেয়ে তিতি…
এভাবে হয়তো আর এই রিহাব সেন্টারের দোলনায় বসে দোল খেতে খেতে ভোর হওয়া দেখতে পারবে না তিতি।
ডাক্তার রায় বলেছেন বাকি ট্রিটমেন্ট-টা বাড়ি থেকেই কন্টিনিউ করা যাবে।
তিতির মনে পড়ে বছরখানেক আগে এখানে নিয়ে আসার জন্য চিৎকার করে কেঁদেছিল সে সারারাত। আঙুলের নখ দিয়ে নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করে তুলেছিল।
শেষ করে দিতে চাইছিল নিজেকে।
কিন্ত আজ সব যেন অন্যরকম, সবকিছু কেমন যেন বদলে গেছে।
একবছর আগের সেই দমবন্ধ করা রাতের সাথে আজকের রাতটার কোনও মিলই নেই।
রাত পালাতে আর মাত্র কিছুক্ষণের অপেক্ষা। মেনগেটের সাইনবোর্ডটার দিকে তাকিয়ে তিতি-‘নির্মল পুনর্বাসন কেন্দ্র’।

………

তিয়াস সেন। স্কটিশ চার্চ কলেজ, জিয়োগ্রাফি অনার্স, ফার্স্ট ইয়ার।
পড়াশোনায় ব্রিলিয়ান্ট বলা চলে না তবে ওর বন্ধরা বলে তিয়াস নাকি বইয়ে মুখ গুঁজে বসে থাকে সবসময়।
শান্তশিষ্ট, একটু লাজুক তবে মিশুকে।
সিঙ্গেল চাইল্ড কিন্ত সেরকম কোনো আবদার ছিল না কোনোদিনও। যা পেয়েছে, যতটা পেয়েছে তাতেই ও খুশি।
ছোটথেকেই সবার থেকে এত্ত ভালবাসা পেয়েছে যে সেরকম কাউকে জীবনে আনার কথা ভেবে দেখেনি কোনোদিন,
তবে আছে একজন, তার বলতে না পারা প্রেম… বেস্টফ্রেন্ড অয়ন।
তিয়াসের পাগলামির একমাত্র সাক্ষ। সব ঠিকই চলছিল, সওওওবব..
তবে একদিন হঠাৎ ঝড় এলো, বাবার মোবাইলে, মায়ের সুজাতা আন্টির ম্যাসেজ দেখার পর…
মহাভারতের যুদ্ধ আঠারো দিন চলেছিল, বাবা মায়ের চলল দু মাস!
তারপর মাও বাধ্য হয়ে বিনয়কাকুর মোবাইলে ম্যাসেজ পাঠানো শুরু করলো।
মা বাবার ঘর আলাদা হয়ে গেল। দুজন দুদিকে, মাঝে তিতি পড়ে রইল একা।
একটা ডুবে যাওয়া নৌকার ভেসে থাকা পাল হয়ে।

তিতি মেনে নিতে পারেনি, হাউমাউ করে কেঁদেছিল, মা বাবাকে একবার বোঝাতে গিয়েছিল সে, লাভ হয়নি কোনও।
ভেবেছিল অয়নকে বলবে সবটা খুলে, অয়ন যদি ভরসা হয়ে এই সময়টা তার পাশে থাকতে পারে…
ডেকেছিল ঢাকুরিয়া লেকে, এসেও ছিল অয়ন, কিন্ত সেদিন তার হাত ছিল অন্যহাতে..
-“তুই কি বলবি জানি না, তবে বলেছিলাম যে আমারও কিছু বলবার আছে।
আলাপ করিয়ে দিই এ সুরঞ্জনা। আমার ইয়ে…..
আর সুরঞ্জনা এ হল তিতি আমার বেস্টফ্রেন্ড।
তোমার কথা কিচ্ছু জানাইনি শুধু ওর রিয়্যাকশনটা চেক করবো বলে।
ওর জন্যই আজকাল সময় পাই না রে তিতি। তবে কেমন দিলাম বল?”
ভ্রু নাচাতে নাচাতে জিজ্ঞেস করেছিল অয়ন..

তিতি কোনও উত্তর দিতে পারে নি, একটু হেসেই জোরে হাঁটা দিয়েছিল গোল পার্কের দিকে।
গা গোলাচ্ছিল ভীষণ, মাথা কাজ করছিল না।
বাড়ি এসে সারারাত কেঁদেছিল। একবার ভেবেছিল শেষ করে দেবে নিজেকে, সাহস হয় নি।
শেষ করার জন্যেও নাকি খুব সাহস দরকার।
অবশেষে ব্যাগ গুছিয়ে সোমলতার পিজি-তে।
ওখানেই প্রথমবার ছিলিম ধরা। ভালোলেগে গেছিল নেশাটা, সব ভুলে থাকা যায়……এভাবেই একদিন পিজি-তে ব্রাউন সুগার এল, তো আরেকদিন কোকেন।
পিজির কোনো এক দিদি এসে টিকটিকির ল্যাজের নেশাও শেখালো।
তারপর থেকে আর ভাবাতো না রাতের বেলায় বিনয় কাকুর বাড়িতে আসা, বাবার রাতে বাড়ি না ফেরা, মায়ের শীৎকার!
কিচ্ছু ভাবাতো না…
ভালো না থাকলেও বেঁচে ছিল তিতি। এভাবেই চলছিল।
হঠাৎ একদিন ছিলিম ধরার পর চোখ অন্ধকার তো হয়েছিল, তবে জ্ঞান এসেছিল নার্সিংহোমে।
পাশে বাবা, মা। ওদের দেখেই তিতির আবার গা গুলিয়ে উঠেছিল ।
তারপর দুদিন তিতির চোখ লালের আশায় হিংস্রতার সাক্ষী থেকেছিল সবাই।
তাকে রিহাব সেন্টারে আনার সময় মা খুব কেঁদেছিল বাবাকে জড়িয়ে ধরে।
হিংস্র তিতি শান্ত হয়ে একটুখানি হেসেছিল সেদিন, একটুখানি।

………..

খুব একটা বড় নয় রিহাব সেন্টারটা। থাকার মধ্যে একটা দোলনা আর একটা বড় বাগান।
তিতিকে যেখানে থাকতে হয়েছে সেই ঘরটাও বেশি বড় নয়। একটা খাট, একটা টেবিল আর টেবিলের উপর একটা নোটপ্যাড রাখা।
তিতিকে তাতে লিখতে বলা হয়েছে, যা মনে আসে। আর বলে দেওয়া হয়েছে রাতে ঘুম না এলে আকাশ দেখতে।
ওখানেই নাকি সব উত্তর জমা থাকে।
ডাক্তারবাবু নাকি প্রতি সপ্তাহে একবার আসবেন।
সপ্তাহে শুধু
শনি ও রবিবার মোবাইলটা পাওয়া যাবে হাতে। আর খুব দুষ্টুমি করলে নাকি তালাবন্ধ ঘরটায় নিয়ে যাওয়া হবে একদিনের জন্য।
তিতি শুধু শুনে গেছে….. বলেনি কিছুই।
তাকে এসব কিচ্ছু ভাবায় না। তার শুধু ছিলিম চাই, নেশা চাই, নিদেন পক্ষে একটা সিগারেট চাই।
কেউ কথা শোনে না, শুনতে চায় না।

কয়েকদিন পাগলের মতো চিৎকার করেছে তিতি, খায়নি কিছুই, কারও সাথে কথাও বলেনি সে..
এখন আবার তাকে চেপে ধরেছে নিজেকে শেষ করে দেওয়া ইচ্ছে, সেই সাহসটা যেন বাড়ছে একটু একটু করে।
এরকম জেলখানায় তো সে থাকতে চায় নি কখনো। নেশার ঘোরে না হয় এতদিন বেঁচে ছিল সে, এখন কিভাবে পারবে সে?

-“কি ভাবছ?”
সম্বিত ফিরলো তিতির। পাশ ঘুরে দেখলো একটা মেয়ে,
ওর থেকে বছর কয়েকের বড় হবে।
আবার মুখ ফিরিয়ে নিল তিতি। মেয়েটা নিজেই বলতে শুরু করলো,

-“আমি রুষা। বছর তিনেক আগের পার্কস্ট্রিট গনধর্ষণ কান্ডটা মনে আছে?
আমি ভিক্টিম ছিলাম।”

তিতি এবার ফিরে তাকালো অবাক হয়ে, সে পড়েছিল ঘটনাটার ব্যাপারে।
সত্যিই অমানবিক ঘটনা।
তিতি এবার নিজে থেকেই বলল,
-“তুমি এখানে কেন?”

-“শুরুতে তো ওই ধাক্কা! শ্বশুরবাড়ি থেকে মেনে নেয়নি তারপর, রাস্তায় বের হলেই ‘ঐ দেখ পার্কস্ট্রীট’ কথাটা শুনতে শুনতে মরে গেছিলাম ভেতর থেকে।
সব ভুলতে কোকেন ট্রাই করি।
তারপর যা হয় আরকি…..”
– “আর এখন?”
– “এখন ভালো আছি, বেশ আছি….
সত্যিকথা কি জানো তো, ভালো থাকতে গেলে কারোর সাহারা লাগে না, ‘নেচার গিভস আস এভরিথিং টু লিভ, নেচার ইস আ অনলি রিসন ফর লিভিং’,
বাকি সব তো সাময়িক আনন্দ দেয় শুধুমাত্র ।”
-“কিন্তু সমস্যা?”
– “আকাশে কখনো মেঘ দেখেছ?”
– “হ্যাঁ মানে…”
– “মেঘ যত ঘনই হোক না কেন, রোদকে আটকাতে পারে?”
-“মানে?”
– “উপায় থাকে বন্ধু…..সব সমস্যার উপায় থাকে।”

তিতি অবাক হয়ে চেয়ে রয়েছিল কিছুক্ষণ। ঘুম এসেছিল খুব সেই রাতে।
ভাবতে পারে নি কিছুই।

এভাবেই গল্প চলতো প্রতিদিন, কখনও ডাক্তারবাবু এসে গল্প শোনাতো রবার্ট ব্রুসের,
কখনও আবার সেন্টারের ভালো কাকু গল্প শোনাতো কেন্টাস্কির।
মাঝে মাঝে ঘুম আসতো না তিতির, দোলনায় গিয়ে বসতো, দেখতো মেঘ কিভাবে চাঁদকে ঢেকে যায়,
চাঁদ আবার কীভাবে মেঘের আড়াল থেকে বেড়িয়ে আসে।
দেখতো তিতি সব…
মাসখানেক পর প্রেয়ার-রুমে আলাপ হল আরও কয়েকজনের সাথে।
তাদের মধ্যে কারও মুখ অ্যাসিডে পোড়া, কেউ নিজের চোখের সামনে মা বাবাকে ডুবতে দেখেছে,
আর কেউ প্রত্যাখ্যাত হয়েছে বেশ কয়েকবার।

সবাইকে যত দেখছে, যত চিনছে, তিতি বুঝতে পারছে, সমস্যা সবার জীবনেই আসে।
আর সেখান থেকে উপায় বের করাটাই আসল শিক্ষা, ডিগ্রী দেওয়ালে ঝুলিয়ে দিলেই জীবনে সব পাওয়া হয়য়ে যায় না।
বেঁচে থাকাটাই সব নয়, সবটা মেনে নিয়ে হাসিমুখে এগিয়ে যাওয়াই সব, কারন মেঘ একদিন সরবেই, সরবেই।

………..

দেখতে দেখতে প্রায় একবছর কেটে গেল।
আজ এখানে শেষ রাত।
১৯টা বছর সেখানে কি শিখতে পারেনি তিতি যেটা এই রিহাব সেন্টার ওকে একবছরে শিখিয়ে দিল?
ভালো থাকার মানে?
কয়েকদিন আগে মা বাবা এসেছিল, কথা বলেছে ডাক্তারের সাথে।
মা বাবার ঘর নাকি আবার এক হয়ে গেছে।
সুজাতা আন্টি, বিনয় কাকু কেউ আর ওদের ভাবায় না।
ওরা এখন তিতিকে চায়, আগের মতো করে।
ডাক্তার বলেছে নিয়ে যেতে।
তিতির নাকি এখন আর সেই হিংস্রভাবটা নেই।
আর আসবেও না কোনোদিন। মা বাবা খুব খুশি।
তিতি? হ্যাঁ তিতিও…..মা বাবার জন্যে নয়, নিজের জন্য।
নিজেকে আবিস্কার করার আনন্দ তিতিকে এখন জাগিয়ে রাখে, সে ডাক্তার যতই বলুক ইনসমনিয়া।
তিতি জানে সব…সব।
নিজের প্রেমে পড়েছে যে সে।

…………

ভোর হয়ে এসেছে। তিতির বাড়ির যাওয়ার সময় হয়ে এল।
তিতির চোখে জল। ঠিক করেছে এখন থেকে মনখারাপ লাগলে সোজা চলে যাবে ছাদে….. আকাশ তো সবাইকে ধরে রাখে, সবকিছুকে আগলে রাখে।
ঠিক করেছে আবার তারা গুনবে সে।
গানও গাইবে-
‘আমি বেঁচে আছি, আমার ভালোবাসায়…ভালোবাসায়’।।

Facebook Comments Box

LEAVE A RESPONSE

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Editorial Team of LaughaLaughi