LaughaLaughi

You Create, We Nurture

I got a story to tell

সম্পর্ক-এর অন্তরালে…

সব সম্পর্করই কি নির্দিষ্ট কোনো নাম থাকে? নাকি নামহীন সম্পর্ক মানেই তা প্রেম, একটা যৌনতার ছোঁয়া?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মানুষটাকে নিয়ে আলোচনা হলে অনেক সময়ই তার বৌদি কাদম্বরী দেবীকে তার সাথে জড়িয়ে এক ধরণের রসাত্মক আলোচনা করতে পছন্দ করেন সবাই, ইশারা করেন একটা নিষিদ্ধ সম্পর্কের প্রতি।
তবে সত্যিই কি তাদের মধ্যে সেরকম কোনো গুপ্ত সম্পর্ক ছিল?
দেওর-বৌঠানের সম্পর্ককে ছাপিয়ে সেখানে কি উঁকি দিত যৌনতার খিদে? মানুষকে ভালোলাগা মানেই কি তার প্রেমে পড়ে যাওয়া?
কি সম্পর্ক ছিল রবির সাথে নতুন বৌঠানের?

জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সাথে যখন মাতঙ্গিনীর বিয়ে হল তখন তার বয়স নয়।
ঠাকুরবাড়িতে নাম বদলে দেওয়ার রীতি অনুযায়ী মাতঙ্গিনী হারিয়ে গেলেন কাদম্বরীর মধ্যে।
বাজা বলে ঠাকুরবাড়ির সবার দু’চোখের বিষ ছিলেন তিনি।
সারাক্ষণ তাকে নিয়ে চলত ফিসফাস।
কাদম্বরীর বাবাকে পাঠিয়ে দেওয়া হল গাজিপুরের জমিদারী দেখতে। বেয়াই মশাই মেয়ের বাড়িতে থাকবে সেটা যে ঠাকুরবাড়ির আত্মসম্মানে বাধে।
কাদম্বরী হয়ে উঠলেন এক্কেবারে একা।
কোনো ছেলেপুলে হয়নি কাদম্বরীর তবে ছিল একজন – ঊর্মিলা;
কাদম্বরীর ননদের মেয়ে। দু বছর বয়স। ওকে খাওয়ানো, স্নান করানো যাবতীয় সব দায়িত্ব নিয়েছিলেন তিনি।
বাড়ির পেছনের ঘোরালো লোহার সিঁড়ি দিয়ে পড়ে গেল একদিন ঊর্মিলা।
কাদম্বরীর ভালোবাসার ধন চলে গেল তাঁর কোল খালি করে।
দিয়ে গেল তাকে ঘেন্না করার আরও একটা কারণ।

ঠাকুরবাড়ির উপযুক্ত বউ হতে পারেননি কাদম্বরী দেবী।
বাজার সরকার শ্যাম গাঙ্গুলির তিন নম্বর মেয়ে ছিলেন কাদম্বরী।
বিয়েটা হয়েছিল মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের ইচ্ছেতে।
যদিও মেজ জা, ভাসুর কারও ভালোলাগে নি তাকে।
তাদের মতে জ্যোতির মতো রাজপুত্রের সাথে কাদম্বরীকে মেলানোটা হাস্যকর।
প্রাণোজ্জ্বল ঠাকুরবাড়ির দমবন্ধ ঘরটায় রবি আসতো তাঁর নতুন বৌঠানকে দেখতে।
এই রবিকে তাঁর নতুন বৌঠান ভালোবাসত খুব।
যদিও রবির আসা-যাওয়া নিয়ে অনেক খোঁটা শুনতে হত তাকে।
তবুও ভাবাত না সেসব, রবি যে তাঁর বন্ধু ছিলেন, ছিলেন তাঁর ঠাট্টা উপহাসের একমাত্র সঙ্গী।
তিন তলার ছাদে রবির সাথে মিলেই গড়ে তুললেন ‘নন্দন কানন’।
পিল্পের উপর বসানো হলো সারি সারি পাম গাছ, আশে পাশে চামেলী, গন্ধরাজ, রজনীগন্ধা, করবী, দোলনচাপা।
তার সাথে এলো নানা রকম পাখি। ঘর সাজানোর দিকে প্রথম থেকেই কাদম্বরীর প্রখর দৃষ্টি ছিল। দেখতে দেখতে ঠাকুরবাড়ির চেহারা তিনি পালটে দিলেন।
কিশোর রবীন্দ্রনাথের সৌন্দর্যবোধকে তিনি বেঁধে দিলেন সবচেয়ে উচু তারে, যা থেকে রবীন্দ্রনাথ আর কখনো সরে আসতে পারেননি।
কাদম্বরী দেবী ছিলেন রবিন্দ্রনাথের প্রতিটি কবিতার প্রথম-শ্রোতা, রবীন্দ্রনাথের উৎসাহদাত্রী, অনুভূতি আদান-প্রদানকারক, ঠাকুরবাড়িতে রবিকে বুঝতে পারার একমাত্র নিঃশ্বাস।
আর রবির কাছে কাদম্বরী? – বহুরূপী।
কখনো মায়ের মতো, কখনো দিদির মতো, কখনো শুধুই বন্ধ আবার কখনো বা বন্ধুত্বের সীমা লঙ্ঘনের সাক্ষী, ‘আদরের উপবাস’ ভাঙার সঙ্গী ।

দিনগুলো ভালোই কাটছিল, হঠাৎ রবির একদিন বিয়ে হয়ে গেল।
নতুন বউ এল তাঁর ঘরে। নতুন বৌঠানকে সময় দেওয়ার সময় কোথায় তাঁর?
কাদম্বরী হয়ে উঠলেন একা। এই বিশাল বাড়িতে এক্কেবারে একা। কিন্ত ওই আদরের উপবাস? একসাথে সাজানো নন্দন কানন? কবিতা রচনা হলেই তাঁর ঘরে ছুটে আসা…সব কি মিথ্যে?
সব? কোথায় রবি? রবি যে তাঁর ঘরে আসে না বেশ কয়েকদিন।
নতুন কিছু কি লেখেনি সে? কাদম্বরী ছুটলেন তাঁর ঘরে;
চোখ রাখলেন তাঁর অনিন্দ্যসুন্দর হস্তাক্ষরে –
“সহসা আলোতে এসে গেছে যেন থেমে- শরমে মরিতে চায় অঞ্চল-আড়ালে।”

এই দুই লাইন তাঁর গলা চেপে ধরল নিঃশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে এল তাঁর।
নিজেকে কোনোমতে সামলে নিয়ে তিনি চোখ রাখলেন টেবিলে উপুর করা রবির কবিতার খাতায়।
চোখে পড়ল মাত্র দুলাইন-
“হেতা হতে যাও পুরাতন! হেথায় নতুন খেলা আরম্ভ হয়েছে !”

কিছু যেন ভেঙে গেল তাঁর মধ্যে বিশাল শব্দ করে।
খুব বারিষ এল। খুব!

একদিন জ্যোতির পকেট থেকে তিনি আবিস্কার করলেন চিঠি।
প্রেমপ্রত্র। জানতে পারলেন জ্যোতির অবৈধ সম্পর্কের কথা, তার সন্তানের কথা।
বুঝে গেলেন জ্যোতির জীবনে তিনি এক্কেবারে শূন্য।
আশা রইল না আর কিছুই। অবশেষে ১৮৮৪-এর ১৯শে এপ্রিল আত্মহত্যার চেষ্টায় আফিম খেলেন কাদম্বরী দেবী।
মারা গেলেন দু দিন পর- ২১শে এপ্রিল ।
সত্যিকথা বলতে সব সম্পর্কেই প্রথমে বন্ধু হয়ে ওঠাটা খুব জরুরি। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের থেকে এই বন্ধুত্বটা কখনোই পাননি কাদম্বরী দেবী।
ঠাকুরবাড়িতে তাঁর একমাত্র কাছের মানুষ ছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
সকালবেলার গান থেকে শুরু করে বিকেলবেলার নন্দনকানন;
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তাঁর একমাত্র সঙ্গী। সেখান থেকেই শুরু এক ভালোবাসার;
নিঃস্বার্থ ভালোবাসার। তাঁর নিঃসঙ্গতা ভুলে যাবার সঙ্গী। রবির তাঁর থেকে দূরে সরে যাওয়াটা যেমন তাকে মেরে ফেলেছিল ভেতর থেকে, জ্যোতির প্রেমপত্রটা তাঁর বাঁচার শেষ আলোটুকুও নিভিয়ে দিয়েছিল দপ করে।

প্রতিটি মানুষের ভেতরই একটা বন্ধুসত্ত্বা থাকে, যা বন্ধু চায়, বন্ধুত্ব চায় অপরের থেকে(সম্পরকের নাম যাই হোক না কেন)।
কাদম্বরীও তাই চেয়েছিলেন। তাঁর এই চাহিদার সাথে নিষিদ্ধ প্রেম, যৌনতা মিলিয়ে ফেললে চলবে…?

Facebook Comments Box

LEAVE A RESPONSE

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Editorial Team of LaughaLaughi