LaughaLaughi

You Create, We Nurture

I got a story to tell

শেষ ট্যাক্সি

গতকালের মতো আজকেও মধুমিতার দেরী হয়ে গেছে অফিস থেকে বেড়তে। ওভার টাইমের জন্য রোজ প্রায় রাত করে বাড়ি ফিরতে হয় তাকে। একটি বেসরকারি অফিসে কর্মরতা সে, মাত্র চব্বিশ বছর বয়সেই সংসারের দায়িত্ব মধুমিতার কাঁধে এসে পড়েছে। সদস্য বলতে বয়স্ক বাবা, মা আর ছোট বোন। বয়সের সাথে মধুমিতার মা’এর সেলাইয়ের কাজ বন্ধ। অসুস্থ বাবার চিকিৎসা, বোনের পড়াশোনা আর সংসারের যাবতীয় খরচ মধুমিতার আয় থেকে হয়। রাত হয়ে গেলেও ওভার টাইম তাকে করতেই হয়, যাতে সংসারে আর একটু আর্থিক স্বাচ্ছন্দ বৃদ্ধি পায়।

সকালে অফিসে বেড়নোর সময় আকাশটা মেঘলা ছিল একটা গুমোট পরিবেশ। সন্ধ্যে থেকে ঝোড়ো হাওয়া আর অঝোরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। মধুমিতা যখন কাজ শেষ করে অফিস থেকে বেড়িয়েছে ঘড়িতে তখন ১০:৩০টা, গতকাল দেরী হয়ে গেলেও লাস্ট বাসে বাড়ি ফিরতে পেরে ছিল মধুমিতা। আজ রাস্তা একেবারেই জনশূন্য, কয়েকটা প্রাইভেট গাড়ি চোখের সামনে দিয়ে বেড়িয়ে যাচ্ছে, কিন্তু পাবলিক ট্রান্সপোর্ট একেবারে নেই। রাস্তার নিয়ন আলো গুলো বৃষ্টির দাপটে ঝাপসা হয়ে আছে। ঝড়ের বেগ কমলেও বৃষ্টির গতিবেগ বাড়ছে। আধ ঘন্টা অপেক্ষা করে বাস না পেয়ে ক্যাব বুক করে বাড়ি ফিরবে বলে ভাবলো মধুমিতা, ফোনের চার্জ শেষ হয়ে যায় তার। ছাতা সম্বল করে একা দাঁড়িয়ে আছে মধুমিতা।

বাস স্টান্ড থেকে কিছুটা দূরে একটি বার আর গত দশ মিনিট ধরে মধুমিতা লক্ষ করছে সেই বারের সামনে মটর বাইকের বসে দুই যুবক তার দিকে কুদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ছেলে দুটোর অদ্ভুত চাউনি। ইতস্ততঃ বোধ করছে মধুমিতা। বাইকে করে এক দুবার মধুমিতার সামনে দিয়ে ঘুরে আবার দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে অদ্ভুত অঙ্গ ভঙ্গি করছে দুজন। মদ্যপ অবস্থায় বেশ কিছুক্ষণ ধরেই তারা মধুমিতা কে উত্তক্ত করছে। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে অসহায় মধুমিতা, ভয় পাচ্ছিলো মানব রুপী পিশাচদের।

দূর থেকে ঝাপসা হেডলাইটের আলো চোখে এসে পড়ে মধুমিতার। সে দেখে একটা ট্যাক্সি এসে দাঁড়িয়েছে তার সামনে।

“চেতলা যাবেন দাদা? ”

উত্তরে ক্ষীণ গলায় সে বলে, “হ্যাঁ যাবো, বসুন।”

মধ্য বয়স্ক ছিপছিপে চেহারা, বেশ লম্বা, ট্যাক্সি চালক কে চেনা লাগছে মধুমিতার। কৌতূহল বশতঃ জিজ্ঞাসা করে, “আপনাকে আগে কোথাও দেখেছি আমি? ”

চাপা স্বরে উত্তর দেয়, “আমি নবীন, চেতলা ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে পার্কিং। ”

“আচ্ছা, হয়তো সেই জন্যই, আজ আপনি সময় না আসলে! ”

ট্যাক্সিতে বসে একটু স্বস্তি পায় মধুমিতা। আর বিন্দু মাত্র দেরী হয়ে গেলে তার সাথে কিছু দূর্ঘটনা ঘটতে পারতো তা কল্পনা করে চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসছে মধুমিতার। ট্যাক্সিটা ঝাঁকুনি দিয়ে দাঁড়াতেই চমকে ওঠে মধুমিতা। জানালার ধারে জলীয় শীতল হাওয়ায় চোখ দুটো বুজে গিয়েছিল তার।

“কতো হয়েছে দাদা? ”

“দেড়শো টাকা। ”

পরের দিন সকালে ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে আসে মধুমিতা। এসে দেখে মধুমিতার চেনা ট্যাক্সি চালক রবি দাড়িয়ে আছে। দেরী হয়ে গেলে বাস ছেড়ে রবির ট্যাক্সিতে অফিসে যায় মধুমিতা। আজকেও দেরী হয়ে যাওয়ায় তার ট্যাক্সিতেই যেতে হবে তাকে ।

“গতকাল যা বৃষ্টি হয়েছে, কেউ একটাও ট্রিপ করতে পারি নি।”

“ও! তবে এই স্ট্যান্ডের নবীন ড্রাইভার আমায় রাতে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছেন।”

“কী বলছেন দিদি, আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে নিশ্চয়ই।”

“না, না ভুল কেন হবে! কাল উনি অনেক বড়ো উপকার করেছেন আমার।”

“কিন্তু নবীন, সে তো দুমাস আগেই গত হয়েছে। ওদের পরিবারটা একেবারে শেষ হয়ে গেল। ওর সতেরো বছরের মেয়ে একদিন রাতে টিউশন পড়ে ফিরছিল, আপনার অফিসের ওই এক রাস্তা। নবীন রাতে ওর মেয়েকে নিয়ে একেবারে পার্কিং এ গাড়ি রেখে বাড়ি চলে যেত। তবে সেই দিন বোধহয় দেরী হয়ে গিয়েছিল নবীনের। সেদিন মেয়েটাকে সারা রাত পাওয়া যায় নি। পরের দিন সকালে একটা সাদা চাদরে ঢাকা অবস্থায় ফুটফুটে মেয়েটার নিথর দেহটা অ্যাম্বুলেন্সে করে বাড়িতে এসেছিল। নৃশংস ভাবে খুন করা হয়েছিল তাকে। মেয়ের ক্ষত বিক্ষত দেহ দেখে চিৎকার করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে নবীন। স্ট্রোক হয়েছিল নবীনের। আর বৌদি মানসিক হাসপাতালে ভর্তি।

রবির কথাগুলো হতবাক হয়ে শোনে মধুমিতা, গাড়িটা দাঁড়াতেই সম্বিত ফেরে মধুমিতা। নিজের চোখ কে বিশ্বাস করবে না রবির কথাগুলোয় মেনে নেবে? কী করবে বুঝতে পারছেনা সে। নিজেকে সামলে পার্স থেকে ভাড়ার টাকা দিতে গিয়ে দেখে গতকালের টাকাগুলো এক রকম ভাবে তার পার্সে রয়েছে। হতবম্ভ হয়ে যায় মধুমিতা। সে বুঝতে পারে কোনো ভুল সে করে নি। গতকাল যে তাকে চরম বিপদের হাত থেকে বাঁচিয়ে ছিল সেই নবীন। চোখের কোনের জলটা মুছে অফিসে ঢুকে গেলো মধুমিতা।

সমাপ্ত

Facebook Comments Box

LEAVE A RESPONSE

Your email address will not be published. Required fields are marked *

A foodie, in love with pen and paper, above that loves being lethargic.